কলাম

জয় বাংলার জয়

‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। খুব শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। গণমাধ্যমকে এমনটাই জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর হলেও এমন সংবাদ আমাদের প্রেরণা দেয়, আন্দোলিত করে।১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগেই রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি। ছাত্রআন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়টাতেও এই স্লোগান দিয়েছিলেন ছাত্রনেতারা। একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু মূল নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করেছিল একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস অর্জনের পথ ছিল কণ্ঠ আকাশে তুলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া। তাদের বীরত্ব প্রকাশের ভাষাটিও ছিল ‘জয় বাংলা’।

দুই বছর আগে উচ্চ আদালতের এক রায়ে জাতীয় দিবস, সরকারি অনুষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চারণের ওপর জোর দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে ওই সময় আদালত বলে, ‘জয় বাংলা’ জাতীয় ঐক্যের স্লোগান। ‘জয় বাংলা’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় স্লোগান এবং জয় বাংলা ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত। উচ্চ আদালতের ওই নির্দেশনার আলোকেই সরকার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের এমন রায় কার্যকর করতে কেন দুই বছর সময় লাগল? এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কখন ও কোথায় জয় বাংলা স্লোগান ব্যবহার করতে হবে? মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন এভাবে ‘তিন-চারটি ক্যাটাগরির কথা জাজমেন্টে আছে। সাংবিধানিক পদধারীরা, রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে এটা বলবেন। এছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-ইউনিভার্সিটিসহ তাদের কোনো সভা-সেমিনার যদি হয়, অ্যাসেম্বলি বা যে কোনো ধরনের সমাবেশ হলে সেখানে জয় বাংলা স্লোগান দিতে হবে। এটা জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করবে। এটাই কেবিনেটের সিদ্ধান্ত।’

এমন সিদ্ধান্তে আনন্দিত মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান, ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশ আরেক পাকিস্তান বনে যায়। জিয়াউর রহমানের আমলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম ও জয় বাংলা স্লোগান দিতে পারত না। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার অপরাধে অনেকের ওপরই নেমে আসত অত্যাচারের খড়গ।

কথা হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবুর সঙ্গে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন চার নম্বর সেক্টরে। জয় বাংলা স্লোগান প্রসঙ্গে তিনি অকপটে বলেন‘‘একাত্তরে যখন স্পিরিটের প্রয়োজন হয়েছে আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলেছি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনও দিয়েছে ‘জয় বাংলা’ বলে। এই স্লোগান দিয়েই আমরা অপারেশন শুরু করেছি। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের জন্যও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানই ছিল আতঙ্ক। সরকার এটিকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেএটা আশার কথা। আমি মনে করি ধর্মনিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি খুবই পজেটিভ উদ্যোগ। ভারতে বিভিন্ন বাহিনীতে ‘জয় হিন্দ’ বলার প্রচলন রয়েছে। তাহলে রক্তে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে আমরা কেন একে অপরকে বলি না ‘জয় বাংলা’? সরকারের উচিত হবে এই স্লোগান সব ক্ষেত্রে নিশ্চিত করারও উদ্যোগ নেওয়া।’’

 এ নিয়ে কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আলম বেগও। ক্যাপ্টেন বেগ নামে তিনি অধিক পরিচিত। একাত্তরে নয় নম্বর সেক্টরের শমশেরনগর সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সমগ্র সাতক্ষীরা অঞ্চলে গেরিলা, সম্মুখ ও নৌকমান্ডো যুদ্ধসমূহ পরিচালনা করেন তিনি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

 ‘‘জয় বাংলা স্লোগানই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রথম দিকে সবাই ছিল আইডিওলজিক্যাল ফ্রিডম ফাইটার। যারা বুক দিয়ে বিশ্বাস করত বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পাকিস্তানিরা আসছে অন্যের দেশে। জোর করে একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মাতবরি করতে আসছে। আর আমাদের দেশেই আমরা। নদীনালা, খালবিল, পাহাড় সব চেনা। এখানে আমরাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও শুনেছেন ৯০ হাজার ওয়েল ইকুয়েপড সেনা সারেন্ডার করেছে। একমাত্র যদি তারা কাপুরুষ না হয়। এমন নয় যে তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবুও সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানি সেনারাই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই হয়েছে এটা। এই দেশ আমার মায়ের দেশ। মাকে মুক্ত করাই তখন ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। প্রতিটি মুুক্তিযোদ্ধার বুকে তখন ছিল এই আগুন। আর সাহস ছিল ওই স্লোগান। তাই আমি বলি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই তো আমরা দেশ জয় করেছি। সে অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগানই ছিল জাতীয় স্লোগান।’’

 কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বিভক্তির রাজনীতির কারণেই জয় বাংলা স্লোগানকে দলীয় স্লোগান হিসেবে দেখিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নেতা এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ। এ নিয়ে ১২ ডিসেম্বর ২০২০ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার ভাষ্য ছিল এমন ‘‘স্বাধীনতার পরও কিন্তু আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জয় বাংলা স্লোগান দিতাম। যে জাসদ একসময় জয়বাংলা স্লোগান দিত, তারা সেই স্লোগান দেওয়া বন্ধ করে দেয়। জাসদ তো আওয়ামী লীগ থেকেই বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল করেছিল ১৯৭২ সালে। এরপর বিভিন্ন দল এটাকে দলীয় স্লোগান হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। যা ছিল সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।’’ কিন্তু জাসদ নেতাদের বক্তব্য, সদ্য স্বাধীন দেশে শেখ মুজিবের সরকারের বিরোধিতা করে নতুন দল জাসদের উত্থান হলে সেই দলটি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করেনি সত্য, কিন্তু তারা ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগানও দেয়নি। ১৯৭৫-এ জাতির জনক শেখ মুজিবকে হত্যার পরই জয় বাংলার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানের প্রচলন শুরু হয়। যারা বাংলাদেশে বিশ্বাসী নন, যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করে এবং যারা ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তখন তারাই এই স্লোগানের প্রচলন ঘটায়। যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়াউর রহমান।বিশ্বের প্রায় ষাটটি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। আমাদের ছিল না। ‘জয় বাংলা’ আমাদের জাতীয় ঐক্য ও প্রেরণার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মিশে থাকা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকেই করা হচ্ছে জাতীয় স্লোগান। এটি যেমন আশা জাগানিয়া খবর তেমনি গৌরবেরও বিষয়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button