গারোদের আদি বিয়ে (প্রথম পর্ব)
বছর কয়েক আগের কথা। গারোদের বিয়েসহ আদি রীতিগুলোর তথ্য সংগ্রহে গিয়েছিলাম হালুয়াঘাটের আচকিপড়ায়, হরিপদর বাড়িতে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১০৫। ডামুকী রিছিল ও কৃষ্ণ মোহন সাংমার ছোট ছেলে তিনি। মায়ের টাইটেল লাভ করায় নাম হয়েছে হরিপদ রিছিল। চা পানের বিরতিতে হরিপদের সঙ্গে চলে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা। তাঁর ভাঁজ খাওয়া চামড়ার পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। উৎসব ও অনুষ্ঠানে গারোদের আদি রীতি ও আচারগুলোর কথা প্রথম শুনি তার মুখেই।
হরিপদের ছোট মেয়ে তুলি চিসিম। তুলি ও তাঁর স্বামী রণজিৎ রুগাই এখন হরিপদের সম্পত্তি দেখাশোনা ও পরিবারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করেন। কেননা গারো সমাজে পরিবারের ছোট মেয়েকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হয়।
রাতের খাবার শেষে গারোদের আদি বিয়ের আচার নিয়ে আড্ডা চলে তুলি ও রণজিতের সঙ্গে। তাঁরা অকপটে বললেন, কীভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে গারোদের আদি বিয়ের আচারগুলো বদলে গেল—সে কাহিনী। জানা গেল, গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক এখনো আগলে রেখেছে মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের কিছু গারো পরিবার। সুমনা চিসিম, তুলি ও রণজিতের সহযোগিতায় পরে আমরা পা রাখি মধুপুরের চুনিয়া গ্রামটিতে। তাঁদের সঙ্গে কথা হয় গারোদের আদি বিয়েরীতি ও লোকাচার নিয়ে। চুনিয়া গ্রামের গারোদের মুখে শোনা আদি বিয়ের নানা তথ্যগুলোই আমাদের সমৃদ্ধ করে।
গারোরা নিজেদের আচ্ছিক মান্দি বা পাহাড়ি মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করে। কেননা তাদের ধারণা গারো নামটি অন্য কোনো জাতির দেওয়া। আদিকালে তারা যখন বিচরণ ভূমিতে মুণ্ডুশিকার করে বেড়াত, তখন অন্য জাতির লোকেরা তাদের জেদি, একগুঁয়ে বা গাড়োয়া বলে ডাকত। কালক্রমে সে গাড়োয়া শব্দ থেকেই গারো নামটি এসেছে বলে কথিত রয়েছে। আবার নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গারোদের আদি বাসস্থানের নাম গারু আ সং বা গারোদের দেশ। মূলত এ থেকেই গারো নামকরণের উদ্ভব। তবে সমতলের গারোরা নিজেদের শুধুই মান্দি বা মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়।
গারোদের সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মাকে কেন্দ্র করে। এটা প্রাচীন সমাজব্যবস্থার প্রকৃষ্ট নিদর্শন বলা যায়। জীবিকার তাগিদে প্রাচীনকালে গারো পুরুষরা ফলমূল সংগ্রহ কিংবা শিকারে বেরিয়ে কখনো কখনো ফিরে আসতে পারত না। হিংস্র জীবজন্তুর কবলে পড়ে মারা যেত। তখন সন্তান মায়ের তত্ত্বাবধানে মায়ের পরিচয়েই বড় হতো। সে থেকেই গারো সমাজে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এদের সমাজে সন্তানের পরিচয় হয় মায়ের পরিচয়ে এবং মা সকল সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে। মাহারী অর্থাৎ বংশগতিকে এরা মাচং বলে। চাচ্ছি শব্দের অর্থ আত্মীয়। মূলত গারোদের আত্মীয় সম্পর্কযুক্ত পাঁচটি গোত্র, যেমন—সাংমা, মারাক, মমিন, শিরা ও আরেং কে চাচ্ছি ধরা হয়ে থাকে। এ ছাড়া গারোদের সতেরটি সম্প্রদায় রয়েছে।
গারো সমাজ মাতৃপ্রধান। সন্তানের বংশধারা মায়ের দিক থেকে গণনা করা হয় এবং মেয়েরাই পরিবারের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারীনি হয়। ছেলেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেনা। বিয়ের পর ছেলে শ্বশুড়-শাশুড়ির এবং স্ত্রীর একান্ত আপনজন হিসেবে ওই পরিবারের একজন হয়ে যায়। তবে একটি গারো পরিবারে যদি পাঁচটি মেয়ে থাকে তবে সবাই সমভাবে পারিবারিক সম্পত্তির অধিকারিণী হয় না। পরিবারের একটি মাত্র মেয়ে সমুদয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়। গারো সমাজে পরিবারের উত্তরাধিকার লাভকারী নির্বাচিত মেয়েকে নকনা বলা হয়।
পরিবারের প্রথমজন বা সবার ছোট মেয়েকে নকনা নির্বাচন করা হয়। বিয়ের পর এ মেয়ে স্বামীসহ মায়ের বাড়িতেই বসবাস করে এবং পিতামাতার মৃত্যুর পর সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়। সম্পত্তির ভোগদখল, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরবর্তী নকনার হাতে সকল কিছু হস্তান্তর করার গুরুদায়িত্বও তার। তবে অধিকাংশ পিতামাতাই কিছু সম্পত্তি অন্যান্য মেয়েদেরও দিয়ে যান। অবশ্য নকনার অংশে থাকে সম্পত্তির সিংহভাগ। তবে বিয়ের পর নকনা যদি পিতামাতার সঙ্গে বসবাস না করে, যদি পিতামাতাকে দেখাশোনা না করে তবে ছোট মেয়ে নকনার অধিকার হারায়। সে সে ক্ষেত্রে অন্য আরেক মেয়েকে নকনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গারো সমাজে নকনার স্বামীকে বলা হয় নক্রম অর্থাৎ ঘরের খুঁটি। সাধারণত নক্রম পিতার নিকটতম ভাগ্নে হয়ে থাকে। নকনার পিতা-মাতা ও আত্মীয়রাই নক্রম নির্বাচন করে থাকে। তাকে ঘরজামাই হিসেবেই নেওয়া হয়। নকনা নক্রমকে নিয়ে নিজবাড়িতে মায়ের পরিবারে থাকে। কিন্তু পরিবারের অন্য মেয়েরা বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে চলে যায়। তবে গারো সমাজে স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্বামী সম্পত্তির ভোগদখল কিংবা ইচ্ছানুরূপ ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার রাখে।
এ আদিবাসী সমাজে একই গোত্র, উপগোত্র ও মাহারীতে বিয়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একই মাহারীতে বিয়েকে এরা মা দং বা মাকে বিয়ে করা বোঝায়। এমনটা ঘটলে ওই দম্পতিকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। আবার ভিন্ন মাহারী ও একই গোত্রের বিয়ে বাগ দং বা আপন আত্মীয়কে বিয়ে করা বোঝায়। এইরূপ বিয়েকেও গারো সমাজে অপরাধের চোখে দেখা হয়। আবার অগারোদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে সমাজচ্যুত করার বিধান কঠোরভাবে নেমে চলে গারোরা।
গারো সমাজে বিয়ে-সংক্রান্ত বেশ কিছু নিয়ম আগে থেকেই বেশ কঠোরভাবেই মানতে হয়। নিয়মগুলো পালন না করলে কঠোর শাস্তির বিধানও আছে। নিয়মগুলো :
০১. গারো নারী সাধারণত পিতার মাচং হতে স্বামী গ্রহণ করবে।
০২. গারো পুরুষ সাধারণত প্রথম সম্পর্কেও মামাতো ভগ্নিকে বিয়ে করে। প্রথম সম্পর্কের না থাকলে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা নিকটবর্তী সম্পর্কের হতে হবে।
০৩. বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রী থেকে কোনো সন্তান লাভ না করলে, তার শ্যালিকা বা স্ত্রীর স্বগোত্রের অন্য কাউকে পত্নীরূপে গ্রহণ করতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে।
০৪. বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর ছোট ভাইদের একজনকে স্বামীরূপে গ্রহণ করতে পারবে।
০৫. যুবক পুরুষ বৃদ্ধা স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রীগোত্রের একজন তরুণীকে দ্বিতীয়া স্ত্রীরূপে এবং বৃদ্ধা স্ত্রীর কন্যাকেও দাবি করতে পারে।
০৬. বিপত্নীক তার স্ত্রীর আত্মীয় বা গোষ্ঠীর অনুমতি ছাড়া যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে না। সে যদি তার স্ত্রীর আত্মীয়দের না বলে নিজের ইচ্ছে মতো বিয়ে করে, তবে তার মাতা বা মাতা মৃত হলে তার মানকবর্গ পত্নীর আত্মীয়কে ষাট টাকা জরিমানা দেবে। দ্বিতীয়া পত্নী অন্য মাচং-এর হলে, সে কখনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হতে পারে না।
০৭. বিবাহিত পুরুষ ব্যাভিচার করেও যদি তার পত্নীর সঙ্গেই বসবাস করে, তাহলে তার পত্নীর মাচং বা অভিযুক্তার মাচং মামলা দায়ের করতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বামীর মানকগণ (পুরুষের মাতৃগোষ্ঠীয় স্ত্রীলোকগণ) স্ত্রীর চাচ্ছিগণকে পনের টাকা হতে ত্রিশ টাকা জরিমানা প্রদান করবে।
০৮. মৃত পত্নীর শ্রাদ্ধ হওয়ার পূর্বেই বিপত্নীক যদি কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌন সংসর্গ ঘটায় এবং তা যদি প্রমাণিত হয় তবে বিপত্নীকের মানকবর্গ মৃতার আত্মীয়গণকে মিমাংরাশি বা দিলাংরাশি নামক জরিমানা দিতে বাধ্য থাকে।
০৯. স্ত্রী যদি স্বামীর যৌন সহবাসের দাবি অগ্রাহ্য ও তাকে ত্যাগ করে তাহলে উক্ত স্ত্রী স্বামীর মানকগণকে টরম পি-য়া নামক জরিমানা দিতে বাধ্য থাকে।
১০. বিয়ের বাগদান ঘোষণার পর কোনো পক্ষ যদি তা ভঙ্গ করে অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে ভঙ্গকারীকে জরিমানা দিতে হয়। জরিমানার পরিমাণ বিচারে নির্ধারিত হয়।
গারো সমাজে বিয়ে-সংক্রান্ত বিষয়ে দুটি দল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। মেয়ের বড় ভাই, ছোট ভাই ও মামাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি দল। একে চ্রা-পান্থে বলা হয়। বিয়েতে ধর্মীয়, সামাজিক ও আইন-সংক্রান্ত ব্যাপারে মেয়ের পক্ষাবলম্বন করা এবং তার স্বার্থরক্ষা করাই এ দলের কাজ। অন্য দলটি ছেলের বড়বোন ও ছোটবোনের স্বামী, মেসোমশাই, মাসিমা, বড় বোন, ছোট বোনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এদের ফা-গাচি বলে। ছেলের স্বার্থরক্ষা করাই এ দলটির কর্তব্য থাকে। (চলবে)
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৮ আগস্ট ২০১৭
© 2017 – 2018, https:.