আদিবাসী

তুরিদের চৈতাবালি ও বৈশাখ

মধ্য বিকেল। গাছের নিচে বসা লবানু শিং। আদিবাসী তুরি গোত্রের মহত সে। কথা বলছেন এলোমেলো। একই কথা বার বার বলে যাচ্ছেন। আবার হঠ্যাৎ করেই যেন খেয়াল হারিয়ে ফেলছেন।
পাশের হালজা গ্রামে আদিবাসী কড়াদের পাড়া। সেখানের রঞ্জন কড়া লবানুর বন্ধু। রঞ্জনের মেয়ের বিয়ে ছিল গতরাতে। মেয়ের বিয়েতে রঞ্জন দাওয়াত করে লবানুকে। কড়া রীতিতে বিয়ের পরে রাতভর চলে ঝুমটা নাচ। মাদলের শব্দ যত বাড়তে থাকে ঝুমটা নাচও তত জমতে থাকে। সাত থেকে দশ। দশ থেকে পনের জন। হাত ধরাধরি করে বিয়েতে উদাসী ঢঙে নাচে আদিবাসী নারীরা। নাচের ফাঁকে ফাঁকে চলে হাড়িয়া খাওয়া। হাড়িয়া না খেলে আদিবাসীদের উৎসব যেন জমেই না। হাড়িয়া খাওয়া আদিবাসীদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্দ অংশ।
হাড়িয়ার নেশা এখনো কাটেনি লবানুর। তাই আজ তার কাজে যাওয়া হয়নি। ফলে বাড়ির উনুনেও রান্না চড়েনি। লবানুর সহধর্মিনী খিরো বালা। রাতের জন্য আশপাশ থেকে শাকপাতা সংগ্রহ করে এনেছেন। পাশের বাড়ি থেকে চাল ধার করে শাকপাতা দিয়েই চালিয়ে নিবেন এ বেলা।
হাড়িয়া খাওয়ার রীতি রক্ষা করতে গিয়ে এভাবেই লবানুর মতো অনেক আদিবাসীরই হরহামেসাই কাজে যাওয়া বন্ধ থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন পূজা আর উৎসবগুলোতে গোটা পাড়ার লোকদেরই কাজ বন্ধ থাকে। কিন্ত এ নিয়ে তুরিদের কোনো আক্ষেপ নেই। দারিদ্র্যতার কথা চিন্তা করে তুরিসহ অন্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা কখনও তাদের উৎসব বন্ধ রাখে না। তারা মনে করে কাজ করে যা উর্পাজন করছে তো সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়। আগামীকাল কীভাবে চলবে তা তাদের ঠাকুরই ভালো জানে। তারা বিশ্বাস করে  মানুষের হাতে কিছু নেই। তাই সচেতনতার নামে পূর্বপুরুষদের হাড়িয়া খাওয়ার রীতি ভাঙতে নারাজ অধিকাংশ আদিবাসী।
আমাদের আলাপ চলে খিরো বালার সঙ্গে। সে জানাল তুরি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা পুরুষদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে শিং আর মেয়েদের নামের শেষে বালা শব্দটি ব্যবহার করে। তাদের পূর্বপুরুষরা দিনাজপুরের লোহাডাংগায় বসত গেড়েছে ব্রিটিশ আমলে। এসেছে ভারতের দুমকা থেকে।  ঝুমটা নাচের গানেও পাওয়া যায় দুমকার অস্তিত্ব। তুরি নারীদের পছন্দ রুপার ঝুমকা (রুপার দুল), হাসেলী (মালা), বাজু, বিছা প্রভৃতি। এ নিয়েই ঝুমটা নাচের গানটি খিরো বালা আমাদের শোনায় :
‘কিনে দেব ঝুমকা
ত লেয়ে যাব দুমকা’।
ভাবার্থ : কিনে দেব জুকমা তারপর নিয়ে যাব দুমকা।

যতই আমরা এগোই ততই নির্জনতা আমাদের ঘিরে ধরে। সারি নদীর স্বচ্ছ জলরাশির উপর দিয়ে ছুটে চলে আমাদের নৌকা। হঠাৎ পাশ দিয়ে ছুটে যায় একটি স্পীডবোট। তার ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের নৌকা দোলে। আমরাও দুলি মনের আনন্দে।

খিরো বালা জানালো ভারতের দুমকা থেকে আসলেও বর্তমানে আদিবাসী তুরিদের সংখ্যা বাংলাদেশেই বেশি। লোহাডাংগা ছাড়াও দিনাজপুরের রামসাগর, বোটের হাট, জামালপুর, পুলহাট, খানপুর, মহেশপুর, বড়গ্রাম, সাদিপুর, মুরাদপুর, হাসিলা, গোদাগাড়ি আর নাজিরগঞ্জে আছে তুরি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। তুরিরা সাঁওতাল বা অন্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মতো ধর্মান্তরিত হয়নি এখনও। বরং নানা দারিদ্র্যতার মাঝেও আঁকড়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি আর আচারগুলো। ধর্মান্তারিত প্রশ্নে খিরো বালার সাফ জবাব, ‘টাকার জন্য জাতিটা নষ্ট করুম কেনে’।
কথা বলতে বলতেই চারপাশে অন্ধকার নামে। লবানুর বাড়িতে মাদুর পেতে আমাদের বসতে দেয় খিরো বালা। মাটি আর ছনে ছাওয়া তিনটি ঘর নিয়েই লবানুর বাড়ি। উঠানের একপাশে একটি জুইফুল গাছ । সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে গাছটি। পাশেই একটি তুলসি গাছ। তুরিদের কাছে তুলসি ঠাকুর। গাছের সামনে খানিকটা উঁচু মাটির ঢিবি।  জায়গাটি একেবার পরিষ্কার। তুরিদের কাছে এটি  তুলসি থান।
লবানুর ছেলে বিরেন শিং এর স্ত্রী জয়ন্তি বালা। বিয়ে হয়েছে বছরখানেক। আমরা দেখলাম জয়ন্তি মাটির প্রদীপ হাতে তুলসি ঠাকুরকে ভক্তি দিচ্ছে। তুরি ভাষায় এটি ‘সান্দবাতি’। প্রদীপ জ্বালিয়ে পানি ছিটিয়ে উলু ধ্বনি দিয়ে তুলসি ঠাকুরকে ভক্তি দেয় সে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের কাছে স্বামী, সন্তান আর সকলের জন্য মঙ্গল কামনা। খিরো বালা জানাল তাদের সম্প্রদায়ে তুলসি ঠাকুরকে সকাল সন্ধ্যা ভক্তি দিতে হয় শুধুই পরিবারের নারীদের। ভক্তি দেয়ার সময় তারা  মনে মনে বলে :
‘তুলসি তুলসি মাধবী লতা
কৃষ্ণ ঠাকুরক থানম
সন্ধ্যাবাতি দেলিও’।
ভাবার্থ : তুলসী তুলসী মাধবী লতা, তুলসীর থানে দিয়েছি, কৃষ্ণনর বাতি।
খিরো জানালো পূজার জন্য ফুল লাগে তাই তারা তুলসির পাশেই জবা কিংবা জুইফুল গাছ লাগিয়ে রাখে। জুইফুলকে তুরিরা বলে দলানী ফুল। তুলসি ঠাকুরকে সন্ধ্যায় প্রদীপ আর সকালে শুধুই ফুল দিয়েই ভক্তি দিতে হয়। সকালের ফুল দেয়াকে তুরিরা বলে জলফুল দেয়া।
আমরা একমনে শুনতে থাকি খিরো বালার কথা। খিরো বলতে থাকে। সকালে উঠে তুরি নারীরা এটো ঘর পরিষ্কার করে থালাবাসন ধুয়ে নিজে গোসল করে নেয়। অতঃপর তুলসি ঠাকুরের পূজার থানটিকে (জায়গাটিকে) পরিষ্কার করে মাটি দিয়ে লেপে দেয়।  একটি কাসার গ্লাস বা পটে পানি নিয়ে তুলসির একটি পাতা ছিড়ে ঐ পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে পাতাটি ডান হাতে ডান কানের পাশ দিয়ে মাথায় স্পর্শ করায়। এদের বিশ্বাস এতে তাদের শুদ্ধি ঘটে। অতঃপর গ্লাসের পানিটি ছিটিয়ে ফুল দিয়ে ভক্তি দেয়া হয়। এভাবে সূর্যদোয় আর সূর্যাস্ত উভয় সময়ে চলে ঠাকুর ভক্তির পর্ব।
ঘরের ভেতরে মাদলের শব্দ। খানিক পরেই যেন শব্দটা হারিয়ে গেল। লবানুর ছেলে বিরেন দেখে নিচ্ছে বাদ্যগুলো। সামনেই চৈতাবালি আর বৈশাখের অনুষ্ঠান। তাই খানিকটা যেন হাত পাকিয়ে নিচ্ছে। তুরিদের এ পাড়ায় বিরেনদের একটি গানের দল আছে। পূজা আর বিয়ের উৎসবে আশপাশের আদিবাসী গ্রাম থেকে ডাক পড়ে দলটির। মাদলে তাল তুলে আদিবাসী নারীদের নাচিয়ে বেড়ায় বিরেনরা।
কথায় কথায় খিরো বালা জানাল মেয়ে ইচিলি বালার বিয়ের কথা। নিজের বিয়েতে  ৫১ টাকা পণ পেলেও মেয়ের বিয়েতে ৫০০০ টাকা যৌতুক দিতে হয়েছে খিরো বালাকে। আদিবাসী তুরিদের বিয়েতে পণ প্রথা চালু থাকলেও সময়ের গতিতে এখন অনেকেই যৌতুক নিয়ে বিয়ে করছেন। আশপাশের বাঙালি সমাজের যৌতুক প্রথা গ্রাস করছে আদিবাসী তুরিদের পণ প্রথাকে।
খিরো জানালো তুরিদের বিয়েতে কনের বাড়িতে অন্য আদিবাসীদের মতোই কলা গাছ দিয়ে মাড়োয়া সাজাতে হয়। বর পক্ষ আসে মধ্যরাতে। তাদের প্রথম দূরে কোনো জায়গায় বসিয়ে জলপানের ব্যবস্থা করা হয়। অতঃপর মহতসহ উভয় পক্ষের দশজন আলোচনা করে নানা বিষয়ে। আলোচনা শেষে বরের গায়ে দুর্বা ঘাস, ধান ছিটিয়ে প্রদীপ আর ধুপ জ্বালিয়ে বরণ করে নেয় কনের মা। বরণ করার পর পরই বর তার দুলা ভাইয়ের কাধে চড়ে বসে। সেখানে বসেই বর তার সঙ্গে আনা মিষ্টি মেয়ের মায়ের আচলে তুলে দেয়। মেয়ের মা তা গ্রহণ করলে বরকে মাড়োয়ার পিড়িতে বসানো হয়। আরেকটি পিড়িতে বসানো হয় কনেকে। তুরিদের বিয়ের নিয়ম অনুসারে বরের দুলাভাইসহ দুজন বরের পিড়ি ধরে মেয়ের চারপাশে পাঁচপাক ঘুরে। প্রতি পাকেই বর কনেকে সিঁন্দুর পরায়। অতঃপর পিড়িতে বসা কনেকেও বরের চারপাশে পাঁচপাক ঘোরানো হয়। এরপর চলে মালা বদল পর্ব। মালা বদলের মধ্য দিয়েই তুরিদের  বিয়ে শেষ হয়। বিয়ের পরে চলে দান পর্ব। দানের পরে শুরু হয় দশের খাওয়া পর্ব। খাওয়ার পরেই চলে হাড়িয়া খাওয়া আর ঝুমটা নাচ। খিরো বালা গেয়ে ওঠে :
‘কি আয়া ভেলো গে
সাক বেগম জেরি গেল্
ধুইয়া উরি গেল্
ভোলের সিবা ভোলের’।
আদিবাসী তুরিরা বিশ্বাস করে বিবাহিত নারীরা সিঁদুর না পরলে তাদের স্বামীর আয়ু কমে যায়।
আমাদের আসরে যোগ দেয় বিরেন শিং। সামনে কি অনুষ্ঠান। এরকম প্রশ্নে বিরেন জানাল প্রথমে চৈতাবালি পরে বৈশাখ। চৈত্র মাসের শেষ পাঁচদিন আদিবাসী তুরিরা পালন করে চৈতাবালির অনুষ্ঠান। শুরুর দিন থেকেই এরা ছাতুগুড় খেয়ে নাচগান করে। চৈত্রের শেষদিন এরা বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে এরা চৈত্রকে বিদায় দেয়। বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে নাচগান পর্ব। চৈত্রের পরের দিনই বৈশাখ।
বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ মাংস খাওয়া। পুরো একমাস এরা খায় শুধুই নিরামিষ। প্রতি রাতে তুরি পাড়াতে চলে কীর্তণ। কীর্তণ করে শুধুই পুরুষেরা। এ সময় দূর দূরান্ত থেকে নানা বিশ্বাসের আদিবাসীরা ভিড় জমায় তুরি পাড়ায়। বৈশাখের শেষের দিকে এরা প্রতি বাড়ি থেকে চাউল তুলে একত্রে খিচুরি রান্না করে খায়। বৈশাখে ভগবানের কৃপালাভের আশায় চলে এমন  আচার।
বিরেনের সঙ্গে কথা জমে ওঠে। ততক্ষণে রাত বেড়েছে অনেক। বিরেনের কাছ থেকে চৈতাবালি আর বৈশাখের নিমন্ত্রণ নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরি।
যখন ফিরছি তখন তুরি পাড়া একেবারেই নিশ্চুপ। একটি বাড়িতে কোনো এক মা তুরিদের খট্টা ভাষায় গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে তার বাচ্চাকে। দূর থেকে ভেসে আসছে গানের সূর। আমরা থমকে দাঁড়াই। কান পেতে রই আদিবাসী সেই সূরের দিকে :
‘তারক পাতা তেরকি
খেজুর পাতা দনা
নাচ গেয়ে ময়না
ভাতারে দেতো আয়না’।

ছবি : সালেক খোকন

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২১ এপ্রিল ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button