আদিবাসী

সাদা পাহাড়ের হাজং গ্রামে

আদিবাসী জীবনকথা

একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে আসাম। দুইয়ের মাঝখানে সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে গারো পাহাড়। ছোট-বড় পাহাড়ের মালা যেন এঁকেবেঁকে পথ করে চলেছে দূর থেকে দূরে। সমতল অঞ্চলের মানুষ দূর থেকে সেদিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। দিগন্তবিস্তারী নীলাঞ্জন রেখার মতো দেখতে। তা মুগ্ধ করে সবাইকে। পর্বত নয়, পাহাড়। তবু তার শোভা এতটুকু কম নয়।

গারো পাহাড় ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে চলে গিয়েছে। হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা আর জামালপুর এসে মিশেছে পাহাড়ের অংশ। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি লোকের মুখে মুখে পাহাড়ি অঞ্চল নামে পরিচিত। গারো জনগোষ্ঠীর বসবাস থেকেই এই গারো পাহাড়ের নামের উৎপত্তি। কিন্তু এখানে শুধু গারোই নয়, সুদীর্ঘকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে হাজং, বানাই, ডালু, কোচ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। কিন্তু সে দীর্ঘকাল যে কতকাল, তার সঠিক কোনো হিসাব আমাদের হাতে নেই। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক সত্যেন সেন গারো পাহাড় এবং সেখানে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এভাবেই।
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা। আঁকাবাঁকা আর ভঙ্গুর রাস্তা পেরিয়ে সুসং দুর্গাপুরে পা রাখতেই সব ক্লান্তি যেন হারিয়ে যায়। বিরিশিরি বাসস্ট্যান্ড পেরোতেই মিশনের সম্মুখে শতবর্ষী রেইনট্রিগুলো নজর এড়ায় না। একসময় এই গাছগুলোকেই কেটে ফেলার চেষ্টা চলেছে। গাছখেকোদের হিংস্র নজর পড়েছিল গাছগুলোর ওপর। শেষে স্থানীয় বাঙালি ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতিবাদ আর সাংবাদিকদের লেখনীর কারণেই রক্ষা পায় কালের সাক্ষী রেইনট্রিগুলো।

কিন্তু দুর্গাপুরে এ রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস নতুন নয়। হাতি-খেদা আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের মতো কৃষক আন্দোলনেও বাঙালি ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কৃষকদের সংগ্রামের কথা আজও ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

দুর্গাপুরের নাট্যকর্মী গোপাল। এ এলাকার সব তার চেনা। নাটক করার কারণে স্থানীয় বাঙালি ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে বেশ পরিচিত। তাকে সঙ্গে নিয়েই আমরা যাব হাজং আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে। তেমনটাই পরিকল্পনা। একটি মোটরসাইকেল নিয়ে মিশন গেটে অপেক্ষা করছিল গোপাল। দুর্গাপুরের গ্রামগুলো স্বল্প সময়ে ঘুরে বেড়াতে মোটরসাইকেল ছাড়া গতি নেই। দুপুরের দিকে আমরা বেরিয়ে পড়ি হাজং গ্রামের উদ্দেশে।

সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে আমরা বিপিনগঞ্জের রাস্তা ধরে এগোই। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। কিন্তু চারপাশে মনছোঁয়া সবুজ। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের নাচন। ভঙ্গুর রাস্তা পেরিয়ে পর্যটকেরা এসেছে চিনামাটির সাদা পাহাড়গুলোকে দেখতে। গোপাল জানাল, এই বিপিনগঞ্জেই রয়েছে চিনামাটির ৮টির মতো পাহাড়। ওপাশে ভারতের মেঘালয়। একটি চিনামাটির পাহাড়ে চোখ পড়তেই দেখি অন্য ঢঙের কিছু বাড়ি। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বসেছে মাটি আর ছনে ঢাকা ঘরগুলো। এটি একটি হাজং গ্রাম। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঘর করে বাস করছে হাজং আদিবাসীরা।

পাহাড়ের কাছে আসতেই থেমে যায় মোটরসাইকেল। আমরা হাজং-গ্রামে পা রাখি। এ আদিবাসীদের ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটিভাবে সাজানো। বাড়ির উঠানে কয়েক ধরনের ফুলের গাছ। একপাশে ছোট্ট একটি মাটির ঘর। দেখে বোঝা যায় এটি তাদের পূজাঘর। একটি বাড়িতে ঢুকি। ওই বাড়ির লোকেরা গোপালের পরিচিত। বাড়ির কর্ত্রী সুপতা হাজং আমাদের বসতে দেন, হাসিমুখে কথাও বলেন। তার স্বভাবসুলভ আচরণ মন কেড়ে নেয়। হাজংরা খুব সহজেই বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে পারে।

সুপতা হাজংয়ের পরনে অন্য রকম পোশাক। হাঁটুর নিচ থেকে কোমর অবধি এক প্রস্থ কাপড়ে বাঁধা। হাজং ভাষায় এটি ‘হাজং পাঠিং’। হাজং পুরুষরা ফতুয়ার মতো গোল কলার জামা ও ধুতি পরতে পছন্দ করে। সুপতা জানান, হাজংদের এই পোশাক তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।
একসময় এরা নিজেদের তাঁতে বোনা কাপড় পরত। সময়ের হাওয়ায় বদলে গেছে অনেক কিছু। দামে সস্তা হওয়ায় হাজং মেয়েরা এখন সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি ব্লাইজ পরিধান করে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের আদি পোশাকগুলো।

কথা হয় হাজংদের নাম নিয়ে। ‘হাজং’ শব্দটি কাছাড়ী শব্দ ‘হাজো’ থেকে এসেছে। কাছাড়ী ভাষায় ‘হা’ অর্থ পাহাড় এবং ‘জ’ অর্থ পর্বত। পাহাড়-পর্বতে বসবাস করে বলে এদের কাছাড়ী ভাষায় ‘হাজো’ বলা হয়। এই হাজো থেকেই হাজং শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু সুপতার মতো অন্য হাজংদের বিশ্বাস, হাজং নামটি গারোদের দেওয়া। গারো ভাষায় ‘হা’ অর্থ মাটি আর ‘জং’ অর্থ কীট বা পোকা। শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায়, মাটির পোকা। একসময় হাজংরা বেশ ভালো কৃষিকাজ জানত। দুর্গম পাহাড়ি জমিও এ আদিবাসীদের শ্রম আর ঘামে হয়ে ওঠে চাষাবাদের উপযোগী। তাই গারোরা তাদের নাম দিয়েছে হাজং বা মাটির পোকা। গারোদের মতো কোচ আদিবাসীরাও এদের বলে ‘হাচং’। কোচ ভাষায়ও ‘হা’ অর্থ মাটি আর ‘চং’ অর্থ পোকা।

দুর্গাপুর ছাড়াও কমলাকান্দা, ধোবাউড়া, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহেরপুর, ধরমপাশায় হাজংদের বসবাস বেশি। সুপতা হাজংয়ের বাড়ির ধারঘেঁষা রাস্তায় আমার পাহাড়ের ওপরের দিকটায় উঠতে থাকি। এ আদিবাসীরা পাহাড়ের ধার দিয়ে চলাচলের জন্য তৈরি করেছে বিশেষ ধরনের রাস্তা। মাটির রাস্তার ঢালুতে বাঁশের ফালি বিছানো। সে পথেই উঠে আসি একেবারে ওপরে। পা রাখি একটি বাড়ির উঠানে।

এই বাড়ির কর্তা মোহনবাশি হাজং। বয়স পঁচাত্তর। এ বয়সেই বাড়ির উঠানে বসে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করছেন কিছু একটা। মুচকি হেসে বসতে দেন আমাদের। কী বানাচ্ছেন? প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেন, খালাই। বাঁশের তৈরি মাছ ধরার ফাঁদকে তারা বলে খালাই। দুই ছেলে কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বাড়তি আয়ের জন্য মোহনবাশি নিজে খালাই তৈরি করে বিক্রি করেন নিকটবর্তী বাজারে।কাজের ফাঁকে আলাপ জমাই তার সঙ্গে। মোহনবাশি জানালেন হাজংদের গোত্রভাগের প্রসঙ্গ। এ আদিবাসী সমাজে গোত্র রয়েছে দুটি। তার ভাষায়, ‘বায়্যাবছড়ি ও পরমার্থী’। মোহনবাশি নিজে বায়্যাবছড়ি গোত্রের হাজং। সামাজিক পদমর্যাদায় এরা উচ্চ শ্রেণিভুক্ত। সাধারণত এই শ্রেণির হাজংরা মাংস ও মদ স্পর্শ করেন না।

হাজংদের ধর্ম কী? মোহনবাশি বলেন, ‘সনাতন হিন্দু আমরা, দেব-দেবী পূজী।’ এ আদিবাসীরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। শিব ও দুর্গা এদের প্রধান দেব-দেবী। গোত্র ভাগ থাকলেও পূজা-পার্বণ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান সব গোত্রের হাজংরাই একত্রে উদ্যাপন করে। তা ছাড়া বায়্যাবছড়ি ও পরমার্থী গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনেও নেই কোনো বিধিনিষেধ।

উঠানে বসে আলাপ এগোচ্ছিল। একটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নিরফলা হাজং। তার নিজের বাচ্চাকে শরীরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন বিশেষ কায়দায়। নিরফলা মোহনবাশির ছেলের বউ। এখানকার গারো সমাজে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও হাজং সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। তবে তা বাঙালিদের মতো নয়। হাজং মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাদের মতামত নেওয়া হয়। এ আদিবাসী সমাজেও অন্যদের মতো সমাজপ্রধান বা সরদার বা মাতব্বর থাকে। সমাজপ্রধানকে মান্য করার রীতি হাজং সংস্কৃতির একটি অংশ।

একটি থালায় কয়েকটি বিস্কুট আর কাঁসার গ্লাসে পানি নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে দেয় নিরফলা হাজং। অতিথি আপ্যায়ন। খেতে খেতে আলাপ জমে। বিয়ে নিয়ে মোহনবাশির মনে জমে থাকা স্মৃতিকে খানিকটা উসকে দিই আমরা। তিনি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন হাজং বিয়ের আচারগুলোর কথা।

এ আদিবাসী বিয়ে বেশ অন্য রকম। বিয়েতে মন্ত্রপাঠের কোনো নিয়ম নেই। বিয়ের দিন বাড়ির উঠানে চতুর্ভুজের মতো একটি সীমানা চিহ্নিত করা হয়। এর চার কোণে পুঁতে দেওয়া হয় চারটি কলাগাছ। চারপাশে বসানো হয় ষোলোটির মতো মাটির প্রদীপ। বেশ কিছু পানিভর্তি মাটির পাত্র চারপাশে সাজিয়ে রাখা হয়। বিয়ের সময়ে বর-কনেকে চতুর্ভুজের মাঝেই বসানো হয়। অতঃপর কনে বরের চারপাশে সাতপাক ঘুরে তার বাঁ পাশে পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই দুই পক্ষের সমাজপ্রধানরা মাটির পাত্রভর্তি পানি বর-কনের গায়ে ঢেলে দেন। হাজং সমাজে পানি ঢেলে দেওয়ার মধ্য দিয়েই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়।

এদের বিবাহবিচ্ছেদের সময়ও পালন করতে হয় বিশেষ আচার। কী সেই আচার? মোহনবাশি জানালেন তাদের সমাজে গর্ভবতী অবস্থায় কোনো মেয়েকে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ। বিচ্ছেদের দিনে ডাকা হয় উভয় পক্ষের সমাজপ্রধানদের।

তাদের সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী দুজনে কিছুসংখ্যক পান হাত দিয়ে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলে। এভাবে প্রতীকী অর্থে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। অতঃপর সবার সম্মুখে এরা পরস্পর পরস্পরকে মা-বাবা বলে সম্বোধন করে। ঠিক তখনই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

বিপিনগঞ্জের হাজংদের কাছে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব এসেছে বহুবার। জমি মিলবে, মিলবে চিকিৎসাসেবা। ছেলেমেয়ের শিক্ষা শেষে দেওয়া হবে চাকরি। তবু হাজংদের মন গলে না। নিজের জাত-ধর্মকে বিক্রি করতে রাজি নয় তারা। দারিদ্র্য আর নানা দুঃখ-কষ্ট হাজংদের নিত্য সঙ্গী। তবু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এ আদিবাসীরা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি আর সংগ্রামের কাহিনিগুলোকে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: ৩১ আগস্ট ২০২৩

© 2024, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button