আদিবাসী

মায়ের বোন নদী

আদিবাসী লোককথা

কোন এক কালের কথা। পাহাড়ের পাশে ছিল ছোট্ট এক গ্রাম। সে গ্রামেই বাস করত দুই বোনতুইচংগী নোয়েংগী। তুইচংগী বড়। নোয়েংগী ছোট। অপরূপা সুন্দরী তারা। দু’জনে বেজায় ভাব। টইটই করে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের এপাশ থেকে ওপাশে। ভোর হলেই ছোটে পাহাড়ে। নাম না জানা নানা গাছের নানা রঙের ফুল কুড়ায়। সে ফুলে মালা গেঁথে এক বোন পরিয়ে দেয় অন্য বোনের খোঁপায়।

শুধু কি তাই, একজন অন্যজনকে ফেলে খাওয়াও মুখে নেয় না। ছোট বোনের মন খারাপ তো বড় বোনের মুখও ভার! এমন মিল দেখে গ্রামের লোকদের মুখে মুখে দুই বোনের কথা। মেয়েদের প্রশংসা শুনে তাদের বাবা-মার মুখেও হাসি। আনন্দে চোখ ভিজিয়ে মা আর্শীবাদ করেন, ‘তোদের বন্ধনটা যেন চিরদিনই অটুট থাকে।’

একবার ঘটল এক ঘটনা। জুম চাষের সময় তখন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নানা ধরনের ফসল লাগাচ্ছে সবাই। তা দেখে নোয়েংগী ও তুইচংগীরও জুম চাষের ইচ্ছা জাগে। পাহাড়ের গায়ে তারাও বীজ বুনবে আর এত্তো এত্তো ফসল ফলাবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। একদিন পাহাড়ের গহীন অরণ্যে গিয়ে দুইবোন জংলাগাছ কেটে কেটে জুমের জমি তৈরি করতে থাকল।

চৈত্র মাস। প্রচণ্ড গরম তখন। কাজ করতে করতে ছোট বোন নোয়েংগীর প্রচণ্ড পিপাসা পায়। যেখানে কাজ করছিল তার আশপাশের কোথাও কোনো জল নেই। জলের অভাবে নোয়েংগীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। এক সময় সে জ্ঞানও হারায়।

ছোট বোনের এ হাল দেখে বড় বোন তুইচংগী ছটফট করে। জলের খোঁজে গহীন অরণ্যের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। কিন্তু কোথাও জলের সন্ধান পায় না। তাহলে, কীভাবে বাঁচাবে আদরের বোন নোয়েংগীকে? এসব ভেবে বোনের পাশে বসে তুইচংগী কাঁদছিল।

এমন সময় স্বর্গ থেকে নেমে এলো এক বৃদ্ধ। চুল দাড়ি সব তার ধবধবে সাদা। মুখের চামড়া ভাঁজখাওয়া। সাদা বড় ভ্রুতে ঢেকে গেছে তার চোখ দুটো। দেখতে একেবারে অন্যরকম। বৃদ্ধ তুইচংগীর কান্না থামালেন। তারপর তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে কানে কানে বলে যান একটি মন্ত্র। মন্ত্র শিখিয়েই তিনি আকাশে মিলিয়ে গেলেন।

তুইচংগীর মুখে তখন হাসি। মন্ত্রবলে সে নদী হয়ে যায়। সে নদীর জল পান করে জীবন ফিরে পায় ছোটবোন নোয়েংগী। কিন্তু তুইচংগী আর মানুষরূপে ফিরতে পারে না। কেননা মন্ত্রের কঠিন শর্তই ছিল এমন। সব জেনেই ছোটবোনের জীবন বাঁচাতে তুইচংগী নিজেকে উৎসর্গ করেন নদীরূপে।

জ্ঞান ফিরেই নোয়েংগী দেখলো, বড় বোন তুইচংগী কোথাও নেই! বোনকে না পেয়ে মনের দুঃখে সে নদীর পাড়ে বসে কাঁদতে থাকল। তার চোখের পানিতে তখন নদীর জলও যায় বেড়ে। সে জলে ভাটির দেশ যায় ডুবে।

অসময়ে এমন প্লাবন দেখে ভাটি অঞ্চলের রাজা খুবই চিন্তিত হয়ে পরেন। তিনি একদিন পানসী সাজিয়ে রওনা হলেন নদীর জলের উৎস সন্ধানে।

দশ দিন দশ রাত কেটে যায়। অবশেষে রাজা এসে পৌঁছে এক পাহাড়ের পাদদেশে। ভীষণ অবাক হয়ে তিনি দেখলেন, এক অপরূপা সুন্দরী কাঁদছে। তার চোখের সে জল গড়িয়ে নদী পথে চলে যাচ্ছে ভাটির দেশে। রাজা নোয়েংগীর কান্না থামিয়ে তার সবকথা শুনলেন। তারপর তাকে বিয়ে করে রানী বানিয়ে নিয়ে গেলেন নিজ রাজ্যে।

রাজার ছিল আরও তিন রানী। কিন্তু তাদের ঘরে কোনো সন্তান ছিল না। নোয়েংগীকে তিন রানী ভালভাবে মেনে নেয় না। অপবাদ আর কটুক্তি করে নানা অজুহাতে। নোয়েংগী এসব মেনে নেয় হাসিমুখে। রাজার কাছেও কোনো অভিযোগ করে না। বরং বড় বোনের মতোই তিন রানীকে শ্রদ্ধা করতে থাকে। সব দেখে রাজাও নোয়েংগীর প্রতি মুগ্ধ হয়।

দিন পেরিয়ে মাস এলো। বছরও গেলো কেটে। নোয়েংগীর ঘরে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক ছেলে। এই ছেলেই হবে ভবিষ্যত রাজা। তখন অন্য রানীদের কদর যাবে কমে। এই ভয়ে তিন রানী ভয়ানক এক বুদ্ধি আঁটে। ছেলে জন্মানোর খবর রাজার কানে যাওয়ার আগেই শিশুটিকে তারা ফেলে দিয়ে আসে সেই নদীতে।

কিন্তু নদী হলো তার মায়ের বোন তুইচংগী। বোনের ছেলে কি নদীতে মরতে পারে? নদীর ছোঁয়ায় শিশু ছেলেটি প্রাণ ফিরে পায়। নদী তাকে ভাসিয়ে রাখে। নদীর বুকেই সে বড় হয়। গান গায় আর সুন্দর, সুঠাম রাজপুত্রের চেহারা নিয়েই বড় হতে থাকে।

রানীদের এ কাজে নোয়েংগী মুষড়ে পড়ে। তাদের ভয়ে রাজাকে কিছুই জানাতে পারে না। ফলে সন্তান হারানোর কষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলে একসময় সে পাথর হয়ে যায়। এভাবে কেটে যায় অনেক বছর। নদীর সান্নিধ্যে বোনের ছেলেটি তখন যুবক। বিদ্যাবুদ্ধি আর কথাবার্তায় প্রকৃত রাজপুত্র হয়ে উঠেছে।

একদিন নদীরূপী তুইচংগী কথা বলে ওঠে। সব ঘটনা খুলে বলে বোনের ছেলেকে। তারপর তাকে পাঠায় রাজদরবারে। নির্দেশ দিয়ে তুইচংগী বলে, ‘নাচ-গান আর নিজের বিদ্যার বহর দেখাবে রাজাকে।’

ছেলেটি তাই করে। রাজ দরবারে রাজা তার সুন্দর চেহারা, নাচ-গান আর মধুর কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা তোমার। তুমি আসলে কে?

ছেলেটি উত্তর দেয়, ‘মহারাজ, আমি আপনার ছেলে?’

উত্তর শুনে রাজা রাগান্বিত হন। হুংকার দিয়ে বলেন, ‘আমার রাজ্যে মিথ্যাবাদীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সত্যি করে বল, তুমি কে?’

ছেলে তখন নদীরূপী তুইচংগীর কাছে শোনা সব ঘটনা রাজাকে খুলে বলল। সব শুনে রাজা তো অবাক। তিনি ডেকে পাঠালেন রানী নোয়েংগীকে। রানী কাঁদতে কাঁদতে অন্য রানীদের অপকর্মের সব ঘটনা বলতে থাকে।

নোয়েংগী ও সন্তানের কষ্টের করুণ কাহিনী শুনে রাজার চোখেও জল আসে। ব্যাথিত হন তিনি। দুষ্টু তিন রানীকে বনবাসে পাঠানোর হুকুম দেন। আর রাজপুত্র ও নোয়েংগীকে নিয়ে পরম সুখে দিন কাটাতে থাকলেন। ছোটবোনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে তুইচংগী। তার সন্তানের জীবনও রক্ষা করেছে সে। তাই নদীরূপী তুইচংগীকে রাজা স্মরণ করেন পরম কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধার সঙ্গে।

এ কারণেই লুসাই পাহাড় থেকে উদ্ভুত কর্ণফুলী নদীরই শাখা নদী তুইচং কেবল নদী নয়, লুসাই আদিবাসী সমাজের কাছে অতি পবিত্র স্থান।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ০৪ জুন ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button