আদিবাসী

পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই রয়েছে নৃত্য

চলছে মাদল-ঢোলের বাদ্য। তালে তালে নাচছে একদল নারী। পায়ে নুপূর জড়ানো। খোপায় ঝুলছে নানা রঙের ফুল। কণ্ঠ আকাশে তুলে হাত ধরাধরি করে নাচছে তারা। মাঝে মধ্যেই গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন প্রিয় পানীয় হাঁড়িয়াতে। সমবেত কন্ঠে আদিবাসী সুর-

আতো গাতি কুরি কোড়া
মায়া জালাং ছাড়া কিদেই
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে…
সাঁওতালী ভাষায় গানটির ভাবার্থ-
গ্রামের যত যুবক-যুবতী আছে
মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে
ছিলাম আমি, এখন বোঙ্গার জ্বালা
ছিঁড়লো মায়া, আমার যাওয়ার পালা।
কদম ফুলের ইশারায় দিস ডাক,
আসবো আমি মিথ্যে নয় এ হাঁক।

গ্রামের নাম মহেশপুর। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রাম এটি। সাঁওতালদের আধিক্য থাকলেও এখানটাতেই পাড়াভেদে বাস করে নানা বিশ্বাসের আদিবাসীরা। সাঁওতালদের গ্রামপ্রধান বা মহত দালু সরেনের বাড়িতে চলছে ঝুমুর নাচের আসর। তারই আমন্ত্রণে আমরা এসেছি গ্রামটিতে।

কেন এই নাচের আয়োজন? উত্তরে দালু বলেন, বছরের যে কোনো সময় এবং যে কোনো স্থানে ঝুমুর নাচ হতে পারে। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গানের তালে তালে এ নাচ চলে। এ নাচের আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। দাঁড় ঝুমুর, টাঁড় ঝুমুর, ভাদুরিয়া ঝুমুর, নাচনী ঝুমুর প্রভৃতি। ঝুমুর নাচে কোথাও দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা, কোথাও বৃষ্টির আহ্বান এবং কোথাও নর-নারীর প্রেম বিনিময়ের কথা ব্যক্ত হয়। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঝুম্ ঝুম্ শব্দ তুলে এই নাচের উদ্ভব বলেই এ নৃত্যের নামকরণ করা হয়েছে ঝুমুর। সাঁওতাল ছাড়াও ওরাওঁ, মাহাতো, লোহার, কুর্মী, ভূমিজ, ভুইঞা প্রভৃতি আদিবাসী সমাজে ঝুমুর নাচ ও গানের প্রচলন রয়েছে।
নাচ-গানের ফাঁকে ফাঁকে আমরা আলাপ জমাই আদিবাসীদের নৃত্য নিয়ে।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, নৃত্য ঐশ্বরিক দান। দেবতাদের সহায়তায়ই তা মানব সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। এ নিয়ে সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। কাহিনীটি-
সৃষ্টির শুরুর দিকের কথা। সাঁওতালরা তখন কোনো দেবদেবীর পূজা করত না। ফলে নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের কাছে অজানা। একবার দুজন সাঁওতাল যুবক গেল গহীন জঙ্গলে। সূর্য ডুবতেই চারদিকে তখন অন্ধকার নামল। তারা রয়ে গেলো বনের মধ্যেই। ওই রাতেই তারা শুনতে পেল গান ও নৃত্যের শব্দ। এই শব্দ তাদের কাছে একেবারেই নতুন। তারা শব্দ ধরে এগোতে থাকে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই তারা তো ভয়ে অস্থির। দুজনই একটি উচু গাছে উঠে দেখল- মরেকো, জাহের এরা, মারাংবুরো ও গোঁসাই-এই তিন স্বর্গীয় দেবতা নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নৃত্য করছে। হঠাৎ এক দেবতা থেমে গেলেন। বললেন, আশেপাশে মানুষের গন্ধ। তার কথা শুনে দেবতা জাহের এরা নির্দেশ করলেন, তাদের কোনো ক্ষতি কর না। বরং তাদের এখানেই নিয়ে আসো। যুবক দুজনকে আনা হলো এবং তারা সারারাত দেবতাদের সঙ্গে নাচল। ভোর বেলা তাদের দুটো ঢোল দিয়ে দেবতারা নির্দেশ করলেন, তোমরা মানব কুলের মাঝে ফিরে গিয়ে সব বল। তোমরা যেমন এখানে করলে তা যেন সবাই শিখে এবং আমাদের সম্মান দেখিয়ে পূজা করে। এভাবেই সাঁওতাল সমাজে নৃত্য ও গীতের বিস্তার ঘটে।
সাঁওতালদের নৃত্যগুলোর মধ্যে লাগরেঞ, দোন, ঝিকা, জাতুর, রিনজা, বাহা, ঝুমুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এরা পূর্ণিমা রাতে লাগরেঞ নৃত্য, বিবাহ অনুষ্ঠানে দোন, ঝিকা, ফসল কাটার উৎসবে জাতুর, বৃষ্টির আহ্বানের জন্য রিনজা, বসন্তকে বরণ করে নিতে বাহা নৃত্যের আয়োজন করে থাকে।

আবার নৃত্যে মনিপুরী আদিবাসীদের খ্যাতি বিশ্বময়। এদের বিশ্বাস, পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই রয়েছে নৃত্য। দেবতা ও দেবীকে মনিপুরী ভাষায় বলে লাইবংথু ও লাইনুরা। এরা মনে করে দেবতা ও দেবীদের চেষ্টার ফসল এই পৃথিবী। এ নিয়ে মনিপুরী সমাজে প্রচলিত আছে একটি লোককাহিনী। কাহিনীটি: সর্বপ্রথমে চারদিকে ছিল কেবল পানি আর পানি। স্থলের চিহ্নমাত্র ছিল না। ঈশ্বর ইচ্ছা করলেন পৃথিবী সৃষ্টি করবেন। আর অমনি সাতজন দেবী সেই পানির উপর নৃত্য শুরু করলেন। তাদের নৃত্যের তালে মুগ্ধ হয় নয়জন দেবতা। তারা নৃত্যের তালে তালে স্বর্গ থেকে ঢিল ছুঁড়তে থাকলেন। আর এভাবেই সেই ঢিলের মাটি জড়ো হয়েই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই নৃত্য মনিপুরীদের কাছে অতি পবিত্র।

গারোদের নৃত্যের অবতারণা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। নৃত্যের ভাব-বিভাবের মধ্যে দেহবিক্ষেপ ও অঙ্গসঞ্চালনই প্রধান। এর মাধ্যমে গারোরা পশুপাখির অনুকৃতি, খাদ্য গ্রহণ, বৃষ্টির আহবান, ফসল কাটা, বোনা, দেবদেবীর কাছে প্রার্থনাসহ নানা কিছু ব্যক্ত করে। সাঁওতালদের মতো গারোদের বেশির ভাগ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় জুম চাষকে কেন্দ্র করে। প্রায় প্রতি মাসেই গারোদের দুএকটি নৃত্যের আয়োজন চলে। এদের নৃত্যগুলোর মধ্যে ঘোরির আ, মংসি আ, গিন্দেগালা, কিলপুআ, আমব্রে রুরু আ, দুকরু সুআ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

গারোদের বিশ্বাস, কয়েকজন অপদেবতা তাদের শস্য নষ্ট করে। এরা হলেন- বাং, বাকওয়েন, রাক্কাসি, মিসকাল, চু আল। এদের হাত থেকে রক্ষা পেতে গারোরা ঘোরির আ, চামে মিককাং নি অ, জিক সেককাং ইত্যাদি নৃত্যের আয়োজন করে। এ ধরনের নৃত্যের সময় সকলের হাতে থাকে তীর, ধনুক, বল্লম। নৃত্যের তালে তালে অস্ত্রশস্ত্র দেখিয়ে এরা অপদেবতাকে ভয় দেখায় যাতে তারা ফসল বিনষ্ট না করে। একই সঙ্গে অস্ত্রের কলাকৌশলই এসব নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাজবংশী সমাজ। ব্রতনাচের মাধ্যমে তাদের সংসার ধর্ম ও পরিবারের সুখ সমৃদ্ধির কামনা করা হয়। দুর্গাপূজা, কার্তিক পূজা ও কালী পূজার সময় রাজবংশী যুবক ও রমণীরা কখনো বিধাব ও বৈরাগীরা ধূপদানীতে ধূপ জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে ঢাক-কাঁসারের তালে নৃত্য করেন। একে বলা হয় ধূপ নাচ। রংপুরের কোনো কোনো অঞ্চলে চৈত্র বৈশাখ মাসে খরা দেখা দিলে রাজবংশী গ্রামের মেয়েরা একত্রে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল-ডাল তুলেন। তাদের মধ্যে একজন রাজা হয় ও একজন রাণী। রাজা রাণীর মাথায় একজন ছেড়া ছাতা বা গ্রাম্য মাথাল ধরেন। অপর একজন ভাঙা টিন বাজান এবং সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা গীত গান ও নৃত্য করেন।

এদের বিয়ের পরদিন যখন বধূকে নিয়ে বর তার নিজ গৃহে ফিরে আসেন তখন বরের বাড়িতে বধূকে বরণ করার জন্য রমণীগন বধূবরণ নৃত্য করেন। ধান, দূর্বা, ফুল ইত্যাদি বর-কনের মাথায় ছিটিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় আর্শীবাদ করা হয় এ নৃত্যে। এ সময় এরা থালা নৃত্য, রেকাবী নৃত্য ও কলস নৃত্য পরিবেশন করে। এছাড়া শিবপূজার গাজন নৃত্যের সময় রং মেখে সঙ সেজে যুবকেরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে নৃত্য করেন। যুবকেরা মহিলার বেশ ধারণ করেন। তাদের গৌরী বলে। এ নৃত্যের মূদ্রায় রাধা-কৃষ্ণের মান-অভিমান, চন্ডিদাস- রজকিনির প্রেম প্রভৃতি প্রকাশ পায়। এ ছাড়াও এরা পারিবারিক মঙ্গল, সমস্যা থেকে মুক্তি ও গ্রামের মঙ্গল কামনায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে জল ঢেলে কাদামাটি নৃত্য করে থাকেন। তবে এদের অনেক নৃত্যই আজ লুপ্তপ্রায়।
রাখাইন আদিবাসী তরুণীরা দলবদ্ধ হয়ে আধুনিক ব্যালে নৃত্যের ন্যায় কিছু নৃত্য পরিবেশন করে। এ নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রায় রাখাইনদের সমাজ জীবনের জন্ম, বাল্যকাল ও বয়ঃপ্রাপ্তি, বিভিন্ন খেলাধুলা, উৎসব পার্বণসমুহের চিত্র ফুটে উঠে। রাখাইন ভাষায় নৃত্যগুলোকে সেইং ডেইং, আজিং জিকে, আরাছামাংগী, হেং, য়েইং, সাং গ্রেং, রাঠা ছোয়ে হেং নৃত্য। এছাড়া প্রত্যেক এলাকায় বর্ষারম্ভে দেবতাদেরকে তুষ্ট করতে এরা নেৎ নৃত্য, ওয়াং-গাবা উৎসবে নাগ নৃত্য, অভিনয়ের মাধ্যমে ঙাচে নৃত্য ও ধর্মীয় পুরোহিতের মৃত্য দেহকে শ্রদ্ধ জানাতে ডুং, ছেইং নৃত্যের আয়োজন করে।

ঢোলের ছন্দে আমরা খেয়াল ফিরে পাই। আসরে তখন সাঁওতাল রমণীর বিরহের গান চলছে। সবাই নিশ্চুপ। কান পেতে রই সাঁওতালী কন্ঠের দিকে।
গানটি;
আখেড়ামে বাদ্য বাজে কতই সখি ঝুমুর খেলে
ঝুমুর ঝুমুর বাজনা বাজে
আখেড়ামে খেলিব ঝুমুর
সখি খেলিব ঝুমুর।
ওরে যৌবন আমার যৌবন
হামার কাহা ছেড়কে গেলিরে
যৌবন হামার।
ভাবার্থ: আসরে ঢোল মাদল বাজছে। সখি-সখা মনের আনন্দে নাচ গান করছে। এক বান্ধবী তার বান্ধবকে না পাওয়ায় দুঃখ করে বলছে- আমার যৌবন রাখতে পারছি না।
আদিবাসীদের বিশ্বাস, নৃত্যের তাল এবং গানের সুরে আছে অতিমাত্রায় সারবস্তু এবং ম্যাজিক বা ঐন্দ্রজালিক শক্তি। জীবনধারণের সকল ক্ষেত্রে এ শক্তি প্রয়োগ করতে পারলেই তাদের মঙ্গল অনিবার্য। এ কারণেই আদিবাসীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটি পূজা-পার্বণ, ব্রত-অনুষ্ঠানে রয়েছে নৃত্য ও গীতের ব্যবহার।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সারাবাংলা ডটনেটে, প্রকাশকাল:  সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button