আদিবাসী

হাজং বিয়ে: মালা বদলের পর আঙুলে ‘মানিক আংটি’

হাজং সমাজে চার ধরনের বিয়ের প্রচলন রয়েছে, যেমন—স্বাভাবিক বিয়ে, হাঙা বিয়ে, দায়পড়া বিয়ে ও দাইমারা বা ডাঙো হান্দা বিয়ে। পারিবারের প্রধান নিজের ছেলে বা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে পারিবারিক আলোচনাসাপেক্ষে বর ও কনেপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিয়ের প্রস্তাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে যে বিয়ে সম্পন্ন হয়, তাকে স্বাভাবিক বিয়ে বলে। বিয়ের কথা পাকাপাকি হলে মঙ্গলাচরণ করা হয়। একে হাজংরা বলে ‘গনসুয়া’। আবার সমাজে কোনা নারী-পুরুষের দ্বিতীয় বিয়েকে ‘হাঙা’ বলে। এ বিয়ে সাধারণত বিয়ের মতোই হয়ে থাকে। তবে সেখানে ধর্ম বাবা-মা থাকে না। একইভাবে স্বাভাবিক বিয়ের নিয়মের মতো ষোল ঘট ও ষোল মুচির প্রয়োজন পড়ে না। বর মাথায় মুকুট পরিধান, স্ত্রীর সিঁদুর, শঙ্খের চুড়ি পরিধান করার অধিকার নেই। এমনকি বিশেষ সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানেও এ দম্পতির প্রবেশের অধিকার থাকে না।

হাজংদের দায়পড়া এক প্রকার প্রণয়ঘটিত বিয়ে। প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে ভালোবেসে ঘর থেকে পালিয়ে এ বিয়ে করে। এ ধরনের বিয়েতে বিশেষ ব্যবস্থা মেনে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত, অর্থদণ্ড এবং ভোজের আয়োজন করতে হয়। মেয়ের বেলায় সিঁথিতে সিঁদুর ধারণ থেকে বিরত থাকতে হয়। আবার কোনো বিবাহিত পুরুষ নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কোনো মহিলাকে গোপনে ভালোবেসে থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা করে থাকলে, সেই মহিলা যদি ওই পুরুষের ঘরে আশ্রয় নেয়, তবে তাকে সামাজিক বিচারে দায় পড়া স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে হয়।

এ আদিবাসী সমাজে নারী যদি পুরুষ দ্বারা প্রতারিত হয়, তখন নারী বাধ্য হয়ে পুরুষের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সময় সামাজিক বিচারের মাধ্যমে তাদের বাধ্যগত মিলন করে দেওয়া হয়। হাজংরা একে ‘দাইমারা’ বলে। আবার পুরুষ যদি নারী দ্বারা প্রতারিত হয়ে নারীর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং বিচারের মাধ্যমে তাদের মিলন করা হয়। তখন এটাকে ডাঙো হান্দা বিয়ে বলে।

হাজং বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার চারটি পর্ব বা ভাগ রয়েছে। এগুলো হলো—গোয়া খাওয়া, অধিবাস, বিয়া ও পাকপরশ বা জ্ঞাতি ভোজন।

পান-সুপারিকে হাজং ভাষায় গোয়া বলে। হাজং সমাজে ঘটক বা যাহুর ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না। বিয়েতে উভয় পক্ষের মাঝে আলোচনা চূড়ান্ত হলে বরপক্ষ, ঘটক (যাহু) মারফত বাতাসা, পান-সুপারি, কনের জন্য লালপাড়ের সাদা শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, শঙ্খের চুড়ি ও এক কৌটা সিঁদুর পাঠিয়ে দেয় কনের বাড়িতে, যা রাখা হয় কলাপাতায় মুড়িয়ে। এরপর ঘটক কনের মার কাছে বিয়ে বিষয়ে কিছু বলার থাকলে বলতে বলেন। তার কথা শেষ হলে ঘটকের অনুমতিক্রমে পানসুপারি ও বাতাসা গ্রহণ এবং কাপড়, চুড়ি ইত্যাদি পরিধান করে কনে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে। তবে এ পর্বে কনে কোনোক্রমেই সিঁথিতে সিঁদুর পরতে পারে না। বিয়ের এ পর্বটিকে ‘গোয়া খাওয়া’ পর্ব বলে।

বিয়ের দ্বিতীয় পর্বটিকে হাজংরা বলে অধিবাস। হাজংদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করার অধিকার রাখে একমাত্র ধর্ম মা-বাবা ও আইড়ো। যা আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হয়। সাধারণত পাঁচজন বা তিনজন সধবা মহিলা বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানিকতা পালনে বর ও কনেকে নির্দেশ ও সহায়তা করে। এ আইড়ো ছাড়া হাজং বিয়ের কাজ কেউ সম্পন্ন করতে পারে না। অধিবাস পর্বের দিনে বাড়িতে ধর্ম মা-বাবা, অধিকারী, আইড়ো (পাঁচজন বা তিনজন সধবা মহিলা) গীতালু, পাচক ও গ্রামের মানুষদের পান-সুপারি দিয়ে বিয়ের দাওয়াত ও বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানানো হয়। তখন তারা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

হাজং বিয়ের মূল পর্বের আনুষ্ঠানিকতাকে বিয়া বলে। ওই দিন বর-কনেসহ ধর্ম মা-বাবাকে উপোস থাকতে হয়। সধবা মহিলারা বরের দুহাত, দুপাশে রাখার পর পাটকাঠি দিয়ে মেপে ওই মাপে চার কোনাকৃতির বিয়েকুঞ্জ নির্মাণ করে। কুঞ্জে চার কোনার গর্তে দুটি পান-সুপারি, তেল, সিঁদুর দিয়ে চার গর্তে চারটি কলাগাছ পুঁতে দেয় তারা। ঈশানকোণের কলাগাছটির নাম থাকে বামকলাগাছ, নৈঋকোণের কলাগাছটির নাম উলুমান কলা, বায়ুকোণের কলাগাছের নাম বৃক্ষণ কলা আর অগ্নিকোণের কলাগাছটির নাম বর্তমান কলা। অতঃপর সুতা দিয়ে কলাগাছগুলোকে সাত পাকে পেঁচানো হয়। কুঞ্জের ভেতরে আঁকা হয় আলপনা। পাশাপাশি ১৬টি ঘট ও মুছি স্থাপন করা হয়। ঘট ও মুছিগুলোরও পৃথক পৃথক নামকরণ করা থাকে। যেমন—সন্মুখে বৃন্দাপতি, তার বায়ে সুন্দরী, তার বায়ে সাম্যজয়া, তার বায়ে বড় রেখা, তার সনে বন্ধুপ্রিয়া, তার বায়ে চিত্ররেখা, তার সনে মধুরেখা, তার বায়ে সুভদ্রা, তার সনে হরপ্রিয়, তার বায়ে পদ্মাদেবী, তার সনে চম্পকলতা, তার বায়ে লজ্যারোমা, তার সনে বিদ্যাদেবী, তার বায়ে কন্দ্রভদ্র, তার সনে প্রিয় বলি এবং তার বায়ে বিশাখা।

বিয়ের এই পর্বে আইড়োরা নাপিত দিয়ে বর-কনে ও ধর্ম মা বাবার ক্ষৌরকর্ম সম্পন্ন করে নেয়। পরে উলুধ্বনি, বাদ্যি-বাজনা ও গীতালুদের গীত চলতে থাকে। বিয়ের বিভিন্ন পর্বে গীতালুরা ভিন্ন ভিন্ন গীত পরিবেশন করে। গীতলু গীত পর্বে পদ্মা-বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর-চাঁদ-সাগরের কাহিনী আর গোপিনী গীত পর্বে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার কাহিনী গাওয়া হয়।

তেমনি কয়েকটি হাজং গীত :

১.

দেবী কয় শুনিক ফনা

হ-মতে তয় ভাগনা মুলা

আহারে হায়

কি দিয়া ময় ঋঝিগে ডাকায় রে

দেবীলা হুকুম পাইয়া

নারোদমুনি যায় লর দিয়া

আহারে ঋঝি ডাফরাগে

আনে লগে লগে

আহিবারে ঋঝি গিলা

মন্ডপানি হামারে যাইয়া

আহারে হায়

কলা কলা রাম কলা

পুতিত তরা সনালা কলা

আহারে হায়

নানান ফুল দিয়া সাজাও উমাগা তোরা।

২.

রাঙা পাথিন নীল ডরা

আয়রো গিলা যায় জোরা জোরা

হায়রে হায়

কিরে আয়রো গিলা যায় জয়জুখা দিয়া

কতক আয়রো কালা কালা

কতক আয়রো দিবা গে ভালা

হায়রে হায়

আয়রো ঘিলা যায় জখা দিয়ারে

তাকছা বিয়া কিছু দূর যায়

ডাঙর বটগাছ লাগত পায়

হায়রে হায়

উদাতে আয়রো গিলা একতেপা জিরাইরে

আর অর্ধেক পথ যাইয়া

ডাঙর গাংরা লাগত পায়

হায়রে

উদাতে আয়রে গিলা কলহারা নামালে।

এ সময় বর-কনের গায়ে হলুদ ও শর্ষেতেল মর্দন করা হয়। অতঃপর নতুন ঘট ও কলমির ডাল ভেজানো জল দিয়ে বর-কনেকে বিয়ে কুঞ্জের চারদিক সাতবার ঘোরানো হয়। একে হাজংরা ‘করাল ঘুরা’ বলে। এরপর বর-কনের মালা বদল হয় এবং একে অপরকে আংটি পরিয়ে দেয়। এই আংটিকে ‘মানিক আংটি’ বলে। শেষে কনে বরের উদ্দেশে হাত তুলে প্রণাম করে ফুল দূর্বা ছিটিয়ে দেয়।

বরের পরিহিত চাদর ও কনের ওড়নাকে বলে ‘ঘটন কাপড়’। এ সময় বর কনের ঘটন কাপড়ে পান ও সুপারি বেঁধে দেওয়া হয়। এটি ‘লবণ গাঁথি’। এর পরপরই বর-কনের মাথায় মুকুট পরিয়ে দেয়। শেষে বর তার হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরায়।

হাজংদের বিয়ের আসরে বরের চাদর ও কনের শাড়ির আঁচল একত্রে গিট বেঁধে দেওয়া হয়। পরে পুরোহিত গোত্রের ব্রাহ্মণ দিয়ে মন্ত্র পরিয়ে চন্দ্র, সূর্য, রাধাকৃষ্ণ, ষোড়শ গোপিনী ও হোমাগ্নিকে সাক্ষী রেখে বিয়ের কাজ সমাপ্ত করেন।

অ-পুরোহিত গোত্রে কনের সহোদর ভাই, না থাকলে পিসাতো, কাকাতো ভাই কন্যা সম্প্রদান করে থাকে। ধর্ম মা-বাবা আশীর্বাদ দিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে। হাজং সমাজে ধর্ম মা-বাবা এ দাম্পত্য জীবনের ধারক-বাহক ও প্রধান সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হয়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ অক্টোবর ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button