আদিবাসী

পাঁড়ু রাজার কথা ও আদিবাসী বিদ্রোহ

কাউকে না পেয়ে পুলিশ ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় কুমুদিনী হাজংকে জোর করে তাদের সঙ্গে টানতে টানতে নিয়ে চলে। কিছুটা এগোতেই একদল কৃষকের সঙ্গে তারা মুখোমুখি হয়। কৃষকেরা সংখ্যায় ছিল ত্রিশ-চল্লিশ। তাদের মধ্যে দশ-বারোজন মেয়ে। অন্য গ্রামে একটি সভা শেষ করে তারা ফিরছিল। প্রায় সবার হাতেই বল্লম। সামনের সারিতেই ছিলেন রাশিমণি হাজং। কৃষকসমিতির জংগী কর্মী হিসেবে সকলের কাছে তিনি ছিলেন বিশেষ পরিচিত। কুমুদিনীর চিৎকার শুনে গর্জে ওঠে সবাই। রাশিমণি ছুটে গিয়ে বাঘিনীর মতই পুলিশের ওপর প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের একটা রাইফেল গর্জে ওঠে। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাশিমণি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

আকাশটা আজ গোমড়ামুখো। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। দিনভর চলছে রোদবৃষ্টির খেলা। দিনটি ছিলজুন মাসের ত্রিশ তারিখ। আমরা যাব রাজারামপুর চনকালী গ্রামে। দিনাজপুর শহর থেকে তা কিলো দশেক ভেতরে। এ দিনেই ওখানে চলে নানা আয়োজন। প্রকৃতজনদের ওই আয়োজন দেখতেই আমরা পা বাড়াই।
চনকালীতে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারের বাস। এ দিনটি সাঁওতালদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভাষায়, ‘সানতাল বিদ্রোহ দিবস’। অনেকেই বলেন, ‘সিদু ও কানহু দিবস’।
যখন পৌঁছি শ্রদ্ধানিবেদন পর্বটি তখন শেষ। রঙ-বেরঙের ফুলে আবৃত গ্রামের কোণের স্মৃতিসৌধটি। হঠাৎ মাদলের ছন্দ। সবাই জড়ো হয় একটি মাঠে। সেখানে গেঁড়ে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি কলাগাছ। মাদলের তালে তালে মাঠে নামে বিশ-পঁচিশজন আদিবাসী। সবার হাতে তীর-ধনুক। দূরে থাকা কলাগাছকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়ে তারা। সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ রব ওঠে। সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে আদিবাসীদের ওইদিনের অনুষ্ঠানগুলো আমরা দেখি খুব কাছ থেকে।
সাঁওতাল বিদ্রোহেরও আগে বিদ্রোহ করেছিলেন সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু রাজা। সেটি ঘটেছিল দিনাজপুরের বিরল উপজেলার গিরিডোবা গ্রামে। এমন খবরটি জানান স্থানীয় আদিবাসী সমিতির সভাপতি বিমল মার্ডি। পাঁড়ু রাজার সংগ্রামের কাহিনি তেমন জানা নেই বিমলের। তিনি শুধু বলে দিলেন ওই গ্রামের ঠিকানাটি।
গিরিডোবায় পৌঁছেই আমরা খুঁজে পাই গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি দালু সরেনকে। তার মুখে শুনি পাঁড়ু রাজার নানা তথ্য।
পাঁড়ুদের ছিল জমিজমা আর বিশাল পশুসম্পদ। তার ছোট ভাইয়ের নাম ‘চারু’। পাঁড়ুর বাড়িতেই ধুমধামের সঙ্গে চলত পূজা পার্বণের নানা আনুষ্ঠানিকতা। নানা ভাবে তিনি সাহায্য করতেন স্থানীয় সাঁওতালদের। তাই সবাই তাকে রাজা বলে মানত। এভাবেই সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু হয়ে যায় ‘পাঁড়ু রাজা’।

পাড়ুঁ রাজার নাতি জাগনা
পাড়ুঁ রাজার নাতি জাগনা

জমির কর নিয়ে একবার পাঁড়ু বিদ্রোহ করে বসেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। বন্ধ করে দেন খাজনা দেওয়া। তার নির্দেশে আশপাশের কয়েক হাজার সাঁওতালও তাই করে। বিদ্রোহীদের থামাতে এগিয়ে আসে স্থানীয় দারোগা-পুলিশ। কিন্তু সাঁওতালদের দুঃসাহসিক শক্তির কাছে তারা দাঁড়াতেও পারে না। ক্রমেই পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহের কথা কলিকাতার লাট সাহেবের দরবার পর্যন্ত পৌঁছায়। হুংকার দিয়ে ওঠে ব্রিটিশ লাট। সৈন্য পাঠিয়ে প্রচণ্ড গোলাবর্ষনে উড়িয়ে দেয় পাঁড়ু রাজার ভিটা বাড়ি। বন্দী করা হয় সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ুসহ অন্যান্য বিদ্রোহীদের। নাচোল বিদ্রোহেরও পূর্বে পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহটি ছিল একটি দুর্দান্ত সাঁওতাল অভ্যুত্থান।

পাঁড়ু রাজার ছিল এক ছেলে। নাম ‘দুবায় মার্ডি’। আবার দুবায় মার্ডির ছিল দুই ছেলে। তার মধ্যে যাগতু মার্ডি মারা যাওয়ায় জাগনা মার্ডিই বর্তমানে পাঁড়ু রাজার বেঁচে থাকা একমাত্র বংশধর। পাঁড়ুর কোনো স্মৃতি চিহেৃর খোঁজ মিলল না তার কাছে। পাঁড়ুর বিদ্রোহের ইতিহাস তাদের কাছে গল্প মাত্র। নিজের জাতি সত্তাকে বির্সজন দিয়ে তারা আজ গ্রহণ করেছে খ্রিস্টান ধর্ম। ফলে পাঁড়ু রাজার ভিটায় এখন আর ঢাক-ঢোল আর মন্দিরা বাজে না। সাঁওতালী নৃত্যের উল্লাসে হয় না কোন পূজার আনুষ্ঠানিকতা।
কিন্তু আমরা প্রায় স্থির হয়ে যাই পাঁড়ু রাজার শেষ পরিণতির কথা জেনে। বন্দি হওয়ার পর পাঁড়ুর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ লাট। এক সময় পাঁড়ুকে ছেড়েও দেয়া হয়। কিন্তু পরে স্থানীয় হাকিম সর্দারকে দিয়ে সংগ্রামী ওই সাঁওতাল সর্দারকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করানো হয়। পাঁড়ু রাজার মৃত্যুর পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় গিরিডোবার সাঁওতালরা। সময়ের স্রোতে ইতিহাসের পাতা থেকেও প্রায় হারিয়ে গিয়েছে পাঁড়ুর মতো বিদ্রোহীর নাম।
সাঁওতালদের মতো মহাজন ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এদেশের হাজংদেরও গৌরবোজ্জল ভূমিকা রয়েছে। রাজা বিদ্রোহ, হাতিখেদা আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে হাজংরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
এক সময় সুসং রাজা বা জমিদাররা ছিলো গারো পাহাড়ের বিপুল অরণ্য সম্পদের মালিক। এ থেকে তাদের প্রচুর আয় হত। এছাড়া তাদের আরেকটি আয়ের পথ ছিল হাতির ব্যবসা। গারো পাহাড়ে দলে দলে হাতি নিঃশঙ্কচিত্তে বিচরণ করত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই বন্য হাতিদের ধরবার ব্যবস্থা করা হত। প্রচলিত ভাষায় এর নাম হাতি-খেদা। ওই সময় শত শত লোককে অনেক দূর থেকে হাতির দলকে ঘেরাও করে, উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ও নানা রকম বিকট আওয়াজ তুলে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসতে হতো।
হাতি ধরাতে পারদর্শী ছিল হাজংরা। তাই সুসংরাজ বংশের রাজা কিশোর হাতি ধরার জন্য ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনেক হাজং পরিবারকে দুর্গাপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি করান। এরা রাজার বা জমিদারের হুকুম মাত্রই হাতিখেদা পেতে হাতি ধরে দিত। হাতি ধরলে রাজার লাভ হত কিন্তু হাতির আক্রমণে অনেক হাজং প্রাণও হারাত। এ কাজের জন্য তাদের কোনো পারিশ্রমিকও দেয়া হতো না। বরং হাতি ধরার কাজে না আসলে রাজা-জমিদাররা তাদের উপর অত্যাচার চালাত।
সে সময় মনা সর্দার দুর্গাপুরে কৃষক বিদ্রোহের ডাক দেন। ফলে ক্ষিপ্ত হয় জমিদাররা। মনা সর্দারকে তারা বুনো হাতির পায়ের তলায় পিষে হত্যা করে। এতে ফুঁসে ওঠে হাজং কৃষকরা। একযোগে তারা আক্রমণ করে সুসং জমিদার বাহিনীর ওপর। ফলে জমিদার-পরিবার প্রাণ বাঁচাতে নেত্রকোণায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহীরা বিজয়পুর, ধেনকী, ভরতপুর, আড়াপাড়া, ফারাংপাড়া, চেংনী প্রভৃতি স্থানের সব হাতিখোদা ধ্বংস করে দেয়। এ বিদ্রোহ চলে পাঁচ বছর। ফলে হাতিখেদা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু এরপরেও গারো পাহাড় অঞ্চলে শান্তি আসেনি। জমিদার ও মহাজনেরা চালু করে ‘টংক প্রথা’। টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। এটি স্থানীয় নাম। হোক বা না হোক কড়ার মতো ধান দিতে হবে। টংক জমির উপর কৃষকদের কোন স্বত্ত্ব ছিল না। এই প্রথা চুক্তিবর্গা, ফুরণ প্রভৃতি নামে ময়মনসিংহ জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দ্দি প্রভৃতি অঞ্চলে চালু ছিল।
এ প্রথা অনুসারে উৎপন্ন ফসল যা-ই হোক না কেন, চাষীকে একটা নির্দিষ্ট পারমাণ ধান দিতেই হতো। যদি কোনো কারণে ফসল সম্পুর্ণভাবে নষ্টও হয়ে যায় তখন বাজার থেকে ধান কিনে জমিদারের পাওনা চুকিয়ে দিতে হতো। জমিদার যে কোনো সময় কৃষকের হাত থেকে জমি ছাড়িয়ে নিতেও পারতো। তখন ধানের দর ছিল প্রতিমণ সোয়া দুই টাকা। টংক প্রথানানুসারে সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে পনের মণ। অথচ ওই সময় জোত জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। ফলে, প্রতি সোয়া একরে কৃষকদের বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগার থেকে সতের টাকা পর্যন্ত। এভাবে দুর্গাপুরের হাজংরা ক্রমেই জমি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে।

টংক আন্দোলনে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ
টংক আন্দোলনে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ

কমরেড মণি সিংহ মেহনতি কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে টংক আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকলেন। টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ত্ব, জোত স্বত্ত্ব নিরিখ মতো খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রভৃতি ছিল টংক বিদ্রোহের মূল দাবি। টংক আন্দোলনে প্রথম শহিদ হন রাসমণি ও সুরেন্দ্র হাজং। টংক আন্দোলন নিয়ে মণি সিংহ ও সত্যেন সেন এর বিভিন্ন লেখা এবং কুমুদিনী হাজংয়ের বক্তব্য থেকে আমরা ওইদিনকার রক্তক্ষয়ী ঘটনাটির কথা জানতে পারি।
সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রামে জন্ম কুমুদিনী হাজংয়ের। তার বাবা অতিথ চন্দ্র ছিলেন একজন হাতিখেদা বিদ্রোহী। ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে। কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী ও তিন ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং টংক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বহেরাতলী গ্রামটির জংগী কৃষকেরাও আন্দোলনে অংশ নিতেন। ফলে কৃর্তপক্ষের বিষ নজর ছিল গ্রামটির দিকে।
১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সকাল বেলা। পুলিশের একটি দল বিরিশিরি থেকে বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু তার পূর্বেই লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই আত্মগোপন করে আড়াপাড়ায় মণি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যায়। কাউকে না পেয়ে পুলিশ ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় কুমুদিনী হাজংকে জোর করে তাদের সঙ্গে টানতে টানতে নিয়ে চলে। কিছুটা এগোতেই একদল কৃষকের সঙ্গে তারা মুখোমুখি হয়। কৃষকেরা সংখ্যায় ছিল ত্রিশ-চল্লিশ। তাদের মধ্যে দশ-বারোজন মেয়ে। অন্য গ্রামে একটি সভা শেষ করে তারা ফিরছিল। প্রায় সবার হাতেই বল্লম। সামনের সারিতেই ছিলেন রাশিমণি হাজং।
কৃষকসমিতির জংগী কর্মী হিসেবে সকলের কাছে তিনি ছিলেন বিশেষ পরিচিত। কুমুদিনীর চিৎকার শুনে গর্জে ওঠে সবাই। রাশিমণি ছুটে গিয়ে বাঘিনীর মতই পুলিশের ওপর প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের একটা রাইফেল গর্জে ওঠে। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাশিমণি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রাশিমণির পিছন পিছন ছুটে এসেছিলেন কৃষককর্মী সুরেন্দ্র হাজং। ওরা তাকেও গুলি করে। চোখের সামনে পর পর দুটি মৃত্যু। জঙ্গি কৃষকরা তখন ভীম গর্জনে আকাশ কাঁপিয়ে বল্লম হাতে পুলিশদের তাড়া করে। দিশেহারা পুলিশদের মধ্যে দু’জন ছুটে আসা কৃষকদের বল্লমের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।
নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমণি হাজংদের মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উৎস।
টংক এলাকায় হাজংদের পাশাপাশি গারোরাও বসবাস করত। কিন্তু তাদের বড় একটি অংশ ছিল খ্রিষ্টান। এরা শুধুমাত্র খ্রিষ্টান মিশনারীদের নির্দেশই মেনে চলত। ফলে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের টংক প্রথা বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে একক ও মূল ভূমিকা রেখেছিল শুধুমাত্র হাজংরাই। এ কারণে এই আন্দোলনকে হাজং আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু টংক আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও এর পূর্বে গারোরা নানা বিদ্রোহ ও সংগ্রামে যুক্ত ছিল। এরা ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিল কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত। এয়োদশ শতাব্দীর শেষে সুসং রাজ্য পতনের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে গারোদের স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব লোপ পায়।
গারোদের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন ছপাতি নকমা। সুসং দুর্গাপুরের শঙ্করপুর গ্রামের ‘আকিং নকমা’ বা গ্রাম প্রধান ছিলেন ছপাতি। তার ছিল অসীম সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি সুসং, শেরপুর, কড়ইবাড়ি প্রভৃতি জমিদারী এলাকার গারো, হাজং, কোচ, হদি, বানাই প্রভৃতি আদিবাসীদের মাঝে গণসংযোগও শুরু করেন।
কিন্তু তার এই পরিকল্পনা জমিদাররা টের পেয়ে যায়। ফলে নানাভাবে তারা ছপাতির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। এতে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় ছপাতির স্বপ্ন।
১৮০২ সালের কথা। সে সময় ব্রিটিশরা শেরপুর ও সুসং জমিদারদের পার্বত্য অঞ্চল থেকে কোনো রাজস্ব পেত না। ফলে এ নিয়ে জমিদারদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ছপাতি তখন ময়মনসিংহ গিয়ে দেখা করেন তদানীন্তন জেলা কালেক্টরের সঙ্গে। প্রস্তাব করেন, জমিদারদের কবলমুক্ত করে আদিবাসীদের পার্বত্য এলাকাকে ভিন্ন একটি জেলায় রূপ দিলে তিনিই ওই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নেবেন। ছপাতির প্রস্তাব কালেক্টর মঞ্জুর করলেও বোর্ড অব রেভিনিউতে গারোরাজ্য স্থাপনের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
তিনি তখন সুসং দুর্গাপুর হতে শেরপুর পর্যন্ত গারোদের মাঝে গণজাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকেন। এদিকে, দশসালা বন্দোবস্তে ব্রিটিশরা ময়মনসিংহের পার্বত্য এলাকার বার্ষিক রাজস্ব ধার্য করে দেয় মাত্র বারো টাকা। কিন্তু জমিদাররা নিরীহ আদিবাসী প্রজাদের কাছ থেকে নানাবিধ বে-আইনি করের অজুহাতে আদায় করতো বিশ হাজার টাকারও বেশি।
এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা আদিবাসীরা একসময় জমিদারদের বিরুদ্ধে একজোট হয়। তারা খাজনা প্রদানও বন্ধ করে দেয়। তাদের নেতৃত্ব দেন টিপু গারো। কে এই টিপু গারো? ১৮০২ সালের পরের কথা। করম শাহ্ নামক এক ব্যক্তির বাউল ধর্মমতে বিশ্বাসী হতে থাকে শেরপুরের গারোরা। এ ধর্মমতের প্রধান ভিত্তি ছিল সাম্যবাদ। সেসময় সুসং দুর্গাপুরের লেটিয়াকান্দা গ্রামের টিপু গারোও সাম্যবাদী মতে বিশ্বাসী হন। করমশাহ’র মৃত্যু হলে টিপুই বাউল ধর্মমত প্রচারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে একবার শেরপুরের গারোদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় জমিদার বাহিনীর। সেসময় টিপুর নেতৃত্বে প্রায় সহস্রাধিক বিদ্রোহী গারো শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে এক নতুন গারোরাজ্য স্থাপন করে। কিন্তু গারোদের ওই স্বাধীন রাজত্বকাল মাত্র দুবছরের মতো স্থায়ী হয়।
১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইংরেজদের একটি সৈন্যদল রংপুর থেকে আসে জামালপুরে। ওই সৈন্যদলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয় টিপু গারোদের। সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শেরপুর ছেড়ে দেয় গারোরা। টিপুকে বন্দি করা হয় গড়দলিফা থেকে। ইংরেজদের বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কারাবাসকালেই টিপু মৃত্যুবরণ করেন।
টিপুর বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর আঘাত ব্রিটিশ সরকারকে নাড়িয়ে দেয়। ফলে ইংরেজরা আদিবাসীদের করের বোঝা আংশিক মওকুফ করে। কিন্তু তবুও গারোদের পুঞ্জিভূত অসন্তোষ দূর হয় না।
গুমানু সরকার ও উজির সরকার নামে টিপুর দুই অনুসারী ছিল। টিপুর মৃত্যুর পর এরা শেরপুর জমিদারবাড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তার পূর্বেই তাদের বন্দি করা হয়। এরপর শুরু হয় জানকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং’র নেতৃত্বে নকমা বিদ্রোহ। বিদ্রোহী গারোদের একটি দল নিয়ে জানকু শেরপুরের পশ্চিম কড়ইবাড়িতে এবং অপর একটি দল নিয়ে দুবরাজ নালিতাবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। সেসময় বিদ্রোহীরা শেরপুর থানা জ্বালিয়ে দেয়।
সংবাদ পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট গেরেট ময়মনসিংহ থেকে সৈন্য নিয়ে আসেন নালিতাবাড়িতে। রাতের আঁধারে দুবরাজ সদলবলে আক্রমণ চালায় তাদের ওপর। এতে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে যায় গেরেট। নিহত হয় ইংরেজদের বহু সৈন্য।
এই ‘দুঃসংবাদে’ কেঁপে ওঠে ব্রিটিশরা। বিদ্রোহ দমন করতে আরও অস্ত্র-শস্ত্রে বলীয়ান সৈন্যবাহিনীসহ পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন সীলকে। বিদ্রোহী গারোরা আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালায় প্রায় দু’মাস। সেসময় ইংরেজ সৈন্যরা জ্বালিয়ে দিতে থাকে গারো গ্রামগুলো। ফলে নিরূপায় গারো নকমাদের অনেকেই আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু জানকে ও দুবরাজ পাথাং এর আর কোনো সন্ধান মেলেনি।
ব্রিটিশ শাসক ও জমিদারদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গারোরা বিভিন্ন সময়ে জমিদারি এলাকাসমুহে সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। ১৮৭১ সালের দিকে একদল গারো ইংরেজ জরিপ-দলের কয়েকজনকে হত্যাও করে। এরপর ১৮৮২ সালে গারোরা পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিলে ব্রিটিশ শাসকরা তা থামিয়ে দেয়।
এরপর আসেন সোনারাম সাংমা। তিনি সরকারি চাকুরি করতেন। ১৮৮৯ সালে সরকারি চাকুরি ছেড়ে সোনারাম গারোদেরকে তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে থাকেন। এভাবে তিনি ১৮৯৯ সাল থেকে সংগ্রাম শুরু করেন। লুপ্ত হওয়া বা দখল হওয়া জমিগুলো উদ্ধার, অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ, জমিদারদের জমি দখল করা প্রতিরোধ করা ও রির্জাভ ফরেস্ট করা থেকে বিরত থাকার জন্য ১৯০০ সালে সিনখারি গ্রামে জড়ো হয় হাজার হাজার গারো। তারা সভা করে সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া লিখিতভাবে জানাতে থাকে।
প্রবল চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার দাবি-দাওয়া আংশিক মেনে নেয়। ১৯০৭ সালে সরকার রির্জাভ ফরেস্ট না করা ও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ না করানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তীতে সোনারাম সাংমা অসুস্থ হয়ে ১৯১৬ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে মারা যান। আজো নানা দাবি আদায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গারো আদিবাসীরা টিপু গারো ও সোনারামের মতো বীরদের স্মরণ করে।
এরকম অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামে আদিবাসীদের বীরত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও সিপাহি বিদ্রোহকেও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও প্রায় সহস্রাধিক আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শহিদ হয়েছেন প্রায় পঞ্চাশজন। তাই যুদ্ধ-সংগ্রামে আদিবাসীদের আত্মত্যাগের ইতিহাসটি চিরকালই গৌরবোজ্জল হয়ে থাকবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: ৩০ জুলাই ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button