আদিবাসী

এক গারো নারীর কথা

‘ভারত ভাগ হওয়ার পর আমরা বাংলাদেশের সীমান্ত অংশে পড়ে যাই। এর আগে আমরা ছিলাম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রূগা নামক গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই সে গ্রামের বর্ণনা শুনেছি বাবা মার মুখে। গল্পের মতো শুনে শুনেই মনের ভেতর রূগা গ্রামের একটি ছবি এঁকে ফেলি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে আসি মেঘালয়ে। আশ্রয় নেই মেঘালয় রাজ্যের ডিমাপাড়া রিফিউজি ক্যাম্পের পাশে, এক আখিং নকমা’র (গ্রাম প্রধান) ভিটায়। বাবা মা সে সময় আমাদেরকে নিয়ে যায় রূগা গ্রামটি দেখাতে। পায়ে হেঁটে পার হই প্রায় ৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। এবড়ো-থেবড়ো পাহাড় বেয়ে বেয়ে পথ চলা। নদীর কিনারে আঁকাবাঁকা জঙ্গল। দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝড়ে পড়া ঝর্ণা থেকে উৎপত্তি ছোট্ট নদীটির। স্বচ্ছ পানিতে নিমজ্জিত পাথর আর পাথর। অন্ধকার গুহার মতো রাস্তায় পথ চলছি। কেমন ভয় ভয় লাগছিল। বাঘ-ভাল্লুক এসে পড়লে বেরুনোর পথ নেই। এমনই ভয়ঙ্কর সে রাস্তা। এমন সব রাস্তা পেরিয়ে আমরা রূগা গ্রামে পৌঁছাই। অদ্ভুত সুন্দর সে গ্রাম। এ জন্মে এমন সুন্দর গ্রাম আমি দেখিনি। চারিদিকেই পাহাড়। যেন পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে  গ্রামটিকে। মাঝখানে ধান ক্ষেত। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি। সারি সারি সুপারি গাছ। মনে মনে রূগা নিয়ে যে ছবি এঁকেছিলাম বাস্তবে তা ছিল আরো অনেক সুন্দর। নিজের চোখে গারো গ্রাম দেখার সে আনন্দ সত্যি আজো মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় দৃশ্যগুলো।’

শৈশবের স্মরণীয় এক স্মৃতির কথা এভাবেই বলছিলেন এক গারো নারী। নাম সুমনা চিসিম। বয়স পঞ্চাশের মতো। পরিবারে ৬ ভাই ৬ বোন। বাবা হরিপদ রিছিল শতায়ু পূর্ণ করে বেঁচে থাকলেও এবছরই স্বর্গীয় হয়েছেন মাতা প্রেমলতা চিসিম। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আচকিপাড়ায়। সুমনা চিসিম প্রথম পড়াশুনা  শুরু করেন নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি মিশন স্কুলে। অতঃপর সরকারি তিতুমীর কলেজ এবং ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিষয়ে জগন্নাথ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন।
পড়াশুনার মাঝেই তিনি কাজ করেন দেশি-বিদেশি এনজিওতে। প্রথমে ৪ বছর সিআর ডাব্লিউ আরসি’র একটি প্রকল্পের কাজে কাটান জামালপুরে। অতঃপর ঢাকায় ফুড ফর দি হাংরি ইন্টারন্যাশনালে, কারিতাস বাংলাদেশে এবং বর্তমানে আরডিআরএস বাংলাদেশ-এর আদিবাসী ক্ষমতায়ন প্রকল্পে কাজ করছেন দিনাজপুরে। এক বিকেলে দিনাজপুরের কড়াদের পাড়ায় বসে সুমনা চিসিমের সঙ্গে চলে নানা বিষয়ে কথোপকথন।শিশু বয়সে প্রথম স্কুলে গিয়ে সুমনাও খুঁজে পাননি নিজের মায়ের ভাষাটিকে। ফলে প্রথম দিকে ভরকে যান তিনি। সুমনার ভাষায় ‘আমার ক্লাস টিচার ছিলেন একজন বাঙালি। স্বভাবতই আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে, ভাষা বুঝতে না পারায় সঠিক উত্তর দিতে পারতাম না। বাঙালি ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করত। আমি বুঝতাম না কেন তারা হাসে। টিচারদেরকে ‘তুমি’ দিয়ে সম্বোধন করতাম। ‘তুমি’ ‘আপনি’র ব্যবহার জানা ছিল না। আমার বড় বোন মিলন চিসিম ঐ স্কুলের ৯ম শ্রেণীতে পড়ত। সে প্রতিদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিত। তাতে আমি আস্তে আস্তে বাংলা ভাষা আয়ত্ব করি। ফলে ১ম ষান্মাসিক পরীক্ষাতেই আমি ১ম স্থান অধিকার করি । তখন থেকেই আমার মনে শিক্ষার প্রতি এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়।’
সুমনা জানালেন সামাজিকভাবে ঘরের বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে গারো নারীদের কোনো বাধা নেই। তাছাড়া গারো সমাজে নারী পুরুষের কিছুটা বৈষম্য রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে নারীরা সম্পত্তির অধিকার পায় কিন্তু পুরুষরা পায় না। গারো সমাজ মাতৃসূত্রীয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মা’র পদবি নিয়ে থাকি। মা সম্পত্তির অধিকারী। মা’র সম্পত্তি মেয়েরাই পায়। মা’র নামের সম্পত্তি ছেলেকে দেয়া যায় না। তবে সবার ছোট মেয়ে বেশি পায়। কেননা সবার ছোট মেয়েকেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়।’
কথার পিঠে কথা চলে। গারো নারীদের পছন্দের অলংকার নিয়ে কথা উঠতেই এক চিলতে হাসি, অতঃপর উত্তরে সুমনা জানালেন রিকমাচু (গলায় পরে), দাংগা সরা, রেপ্পা সরা, সিক্কি সরা (গলায় পরে) রূপা দিয়ে তৈরি, রূব্বক (গলায় পরে) হাতির দাত দিয়ে তৈরি, স্রেফ (কানে পরে), নারিক্কি (কানে পরে), সাংগং (হাতে পরে) প্রভৃতি অলংকারের কথা। গারোদের একই গোত্রে বিয়ে হয় না। যেমন চিসিম চিসিম বিয়ে হবে না। মা’র পদবী পায় বলেই বিয়ের পরেও গারো নারীদের পদবী পরিবর্তন হয় না। বরং অন্য গোত্রের কোনো ছেলেকে এরা জামাই করে নিয়ে আসে।
অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো সুমনা চিসিমও মায়ের ঘুম পাড়ানি গান আর বাবার মুখে গল্প শুনে শিশু বয়সেই শিখে ফেলেন গারো ভাষাটি। গারোদের লিখিত কোনো বর্ণ নেই। তবু সুমনার কাছে মায়ের মুখে শোনা গারো ভাষাই প্রিয়। আমাদের অনুরোধে সুমনা তার মায়ের মুখে শোনা একটি গান ধরেন :
চা’আনা রেবো, চা’আনা রেবো,
সা’আ চা’আগেন  সা’আ চা’আগেন
ওয়াকনি বেন থ’আ, ওয়াকনি বেন থ’আ
চা’আই ওক্খাগেন চা’ই ওক্খাগেন।
অর্থাৎ
খেতে আস, খেতে আস
কে খাবে, কে খাবে
শুকরের মাংস সুস্বাদু, শুকরের মাংস সুস্বাদু
খেয়ে পেট ভরবে, খেয়ে পেট ভরবে।
গারোদের ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে কথা হলে সুমনা অকপটে স্বীকার করেন ধর্মান্তরিত হয়ে গারোরা হারিয়ে ফেলছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচারগুলো। তিনি বলেন, ‘আমাদের আদি পুরুষদের রেখে যাওয়া অনেক আচারগুলো এখন রূপকথার গল্পের মতো হয়ে যাচ্ছে। অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির চাপে সব হারিয়ে যাচ্ছে। এখন গারোরা নিজেরাই জানে না কি তাদের আচার অনুষ্ঠান, কি তাদের মূল্যবোধ।’
গারো সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়ে সুমনা চিসিম বলেন, ‘গারোদের একটু পিছন ফিরে দেখতে হবে। আমরা কি ছিলাম, কেমন ছিলামÑ তা উপলব্ধি করতে না পারলে নিজেকে জানা যাবে না। নিজের সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে কখনও তা রক্ষা করা যায় না। এজন্য প্রথমেই গারো পরিবারগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। গারো গান শোনানো, গল্প বলা ও অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়েই গারো সংস্কৃতি রক্ষা করা যেতে পারে।’
সুমনা তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে গারোসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নারীদের সমস্যাগুলো জানালেন। উত্তরবঙ্গের জাতিগোষ্ঠীর অনেক নারীই স্থানীয় বাঙালি দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয়। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিলে মিলে না ন্যায় বিচার। বরং নানা হুমকির সম্মুখীন হতে হয় পরিবারটিকে। ফলে অনেক নারীই বেছে নেয় মৃত্যুকে।  তাছাড়া বাল্যবিবাহ হচ্ছে অহরহই। এতে মেয়েরা অল্প বয়সেই পুষ্টিহীন শিশু জন্ম দেয় ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। গারো নারীরা অনেকে কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে বিউটি পার্লার, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বিদেশিদের বাসাবাড়িতে কাজ করে এরা। মালিক দ্বারা নানা ধরনের হয়রানির স্বীকার হওয়া ছাড়াও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না গারোরা। অনেকে অসৎ চক্রে পড়ে নারী পাচারের স্বীকার হচ্ছে ও পতিতালয়ে বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া নানা প্রলোভন দেখিয়ে ও জোর করে বিয়ের মাধ্যমে অনেক নারীকে ধর্মান্তরিতও করা হয়েছে।
বৈষম্যের কথা উঠতেই সুমনা চিসিম জানালেন অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মাত্রই সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের স্বীকার। সাধারণত কোনো সম্প্রদায়ের নাম শুনলেই প্রথম প্রতিক্রিয়া, ওরা ব্যাঙ খায়, সাপ খায়, মদ খেয়ে যেখানে সেখানে পড়ে  থাকে, শিক্ষাদীক্ষা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। লেখাপড়া জানা থাকলেও ওরা অন্য জাতিগোষ্ঠী। সভ্যসমাজ সর্ম্পকে তাদের জ্ঞান নেই। এভাবেই শুরু হয় বৈষম্য। নারী মাত্রই কম বুঝে, কম জানে, বড় দায়িত্ব নিতে পারবে না এমন ট্রাডিশন্যাল বিশ্বাস মানুষের রক্তে যেন মিশে আছে। দাতা গোষ্ঠি চাপ দেয়া সত্বেও উচ্চ পদে নারীদের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে।  আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর সংখ্যা আরও করুণ। তাই অন্য জাতিগোষ্ঠকে সম্মান করতে না পারলে ন্যূনতম শ্রদ্ধা যদি তাদের প্রতি না থাকে তবে কোনোদিনই এ বৈষম্য কমবে না বরং বাড়বে।
নানা বৈষম্যের পরেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে পরিবর্তন এসেছে বলে এই গারো নারী মনে করেন। আগে নানা সম্প্রদায়ের অভিভাবকগণ কখনো সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, এখন তারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বুঝতে শিখেছে তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর কথা।
‘আদিবাসী’ নামকরণ নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুমনা খানিকটা মলিন মুখে বলেন, ‘আমরা ঐ নামেই অভ্যস্ত। সরকার ইচ্ছা করলে সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু এতে গারো হিসেবে আমাদের তেমন কি আসে যায়। আমরা এ ভূখ-ে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে আসছি, তাছাড়া আমরা কোনো জাতির সঙ্গে সংমিশ্রণের সৃষ্টি হইনি। আমাদেরকে বলা হয়ে থাকে ওরিজিন। আদিম ও প্রকৃতি ঘেষা মানুষ আমরা। যে নামেই সরকার ডাকুক না কেন আমরা আমাদের পরিচয়েই পরিচিতি পাব। আমাকে কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সরকার এসে পরিচয় দিবে না, আমাকেই আমার পরিচয় দিতে হবে।’
সুমনা চিসিমের কথাগুলোতে গোটা দেশে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীর নারীদের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। সুমনার ইচ্ছে তাদের সচেতনতা আর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কাজ করে যাওয়ার। সুমনার মতো জাতিগোষ্ঠীর নারীরা এভাবেই হয়ত একদিন প্রতিষ্ঠা করবে নিজেদের অধিকারগুলোকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ০৫ অক্টোবর ২০১১ তে

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button