আদিবাসী

নানা বিশ্বাসে আদিবাসীদের মিথ

ভাদ্র মাস। তাল পাকানো গরম চারদিকে। গ্রামের লোকজন বারকয়েক ঘাম গোসল দিয়ে গাছের ছায়ায় খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছে। কালিয়াগঞ্জ গ্রামটি বেশ ছায়াঘেরা। পাশেই ব্রিটিশ আমলের গহিন সবুজ শালবন। শোনা যায়, গোটা গ্রামটিই এক সময় ছিল জঙ্গল। আর সে সময় থেকেই এখানে বাস করছে নানা সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকত এরা। গোত্রে গোত্রে ভাগ হয়ে স্বাধীনভাবে পালন করত পূর্বপুরুষদের আদি সংস্কৃতি। বাঙালি থাকলেও দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এই গ্রামটিতে এখনও আদিবাসীদের সংখ্যাই বেশি। প্রতি শনি আর বৃহস্পতিবার এখানকার গ্রাম্য হাটে ঢল নামে নানা ভাষাভাষী মানুষের। সাঁওতালদের আধিক্য থাকলেও গোত্রভেদে বাস করছে মুণ্ডা, ওরাও, ভুনজার, শিং, মাহালি আর কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা।

আমরা বের হয়েছি আদি মানুষদের খোঁজে। কালিয়াগঞ্জ যখন পেঁৗছলাম তখন মধ্য দুপুর। ভাদ্র থেকে কার্তিক এখানকার আদিবাসীদের অভাবের মাস। আর এই অভাবের মধ্যেই তাদের পালন করতে হয় নানা ধরনের পূজার আনুষ্ঠানিকতা। বিকেল হতেই চারপাশে থেমে থেমে বাজছিল মাদল, ঢোল আর মন্দিরা। ওরাও, শিং, মুণ্ডা আর কড়া সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে পুরোদমে চলছে ‘কারমা পূজার’ আয়োজন। জানা গেল এটি মূলত গাছের পূজা। বিরল প্রজাতির কারমা গাছের (স্থানীয়দের ভাষায় ‘খিল কদম’ গাছ) পূজা করে তারা। কড়া, ওরাও, মুণ্ডা আর ভুনজার সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মধ্যে এ পূজা নিয়ে প্রচলিত আছে অভিন্ন কাহিনী।কাহিনীটা এরকম:

    শিকাররত এক সাঁওতাল
শিকাররত এক সাঁওতাল

কারাম আর ধারাম ছিল দুই ভাই। কারাম বড় আর ধারাম ছোট। তাদের একমাত্র আদরের বোনের নাম পারাবেতি। একবার ভাদ্র মাসে গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে ধান গাড়ার ‘হাউলি’র (কাজের বিনিময়ে খাওয়ার দাওয়াত) ডাক দেয়। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে কারাম আর ধারামও যায় সেখানে। ভোরবেলা কিছু চারা লাগিয়ে সকালের নাশতা বা পনতা (পান্তা) খেতে দুই ভাই কলাপাতা নিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু কারাম আর ধারামের কাছে এসেই পান্তা শেষ হয়ে যায়। পান্তা খেতে না পেরে দুই ভাই বড়ই দুঃখ পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বড় ভাই কারাম ছোটকে সান্ত্বনা দেয় দুপুরের খাবার পাওয়ার আশায়। দুই ভাই আবার কাজে ফিরে যায়। ধান গাড়া শেষ হলে দুপুরের দিকে আবারও কলাপাতা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে বসে পড়ে লাইনে। কিন্তু এবারও ঘটল একই ঘটনা। তাদের কাছ পর্যন্ত এসেই খাবার শেষ হয়ে গেল। এবার তারা খুবই কষ্ট পেল। প্রচণ্ড রাগে ও কষ্টে ছোট ভাই চাইল তার গাড়া ধানের চারাগুলো তুলে ফেলতে। বড় ভাই কারাম তাকে শান্ত করে বাড়ির দিকে রওনা হয়। পথেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় এক বটগাছের। তাদের দুঃখের কথা শুনে বটগাছ বলে, ‘তোদের কারমা কপাল জের গেল’ (তোমাদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে)। সে উপদেশ দেয় সাত সমুদ্র লংকা পার হয়ে কর্মভাগ্য নিয়ে আসার। বটগাছের কথা বিশ্বাস করে কারাম আর ধারাম বাড়ি থেকে খুদভাজা নিয়ে রওনা হয় কর্মভাগ্য আনতে। কিছুদূর যেতেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় একটি কুলগাছের। কারাম-ধারামের কথা শুনে সেও জানায় তার দুঃখের কথা। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসার জন্য দুই ভাইকে সে অনুরোধ করে। যেতে যেতেই কারাম-ধারামের দেখা হয় একটি ডুমুর গাছের সঙ্গে। ডুমুর গাছ তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে দুঃখ করে বলে, তার সুদৃশ্য ফল পেকে যায় কিন্তু মানুষ ও পাখি সেদিকে ফিরেও তাকায় না। এ নিয়ে তার অনেক দুঃখ। সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী। নদীর তীরে দুটি হাতি মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে, তারা জানে না আর কতদিন তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কাদায় ঢাকা থাকবে। দুই ভাইকে তারা অনুরোধ করে তাদের ভাগ্যটিও জেনে আসার। নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই কারাম-ধারাম লংকার সমুদ্রের কাছে এসে পেঁৗছায়। বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চিন্তায় তারা সমুদ্র পাড়ে বসে থাকে। এ সময় সমুদ্রে একটি বড় কুমিরের গলায় সাতদিন ধরে কাঁটা বিঁধে থাকায় সে কারাম-ধারামের সাহায্য চায়। সমুদ্র পার করানো ও নিয়ে আসার শর্তে কারাম-ধারাম কুমিরের গলার কাঁটা বের করে দেয়। কুমিরের পিঠে চড়ে দুই ভাই লংকার সমুদ্র পার হয়েই দেখা পায় কর্মভাগ্যের। কর্মভাগ্যের সারা শরীর তখন পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম যখনই তা স্পর্শ করল তখনই সেটা গাছ হয়ে গেল। এতে কারাম-ধারামের মধ্যে অন্য রকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে ফিরতে থাকল।ফেরার পথে হাতি দুটি তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে কারাম-ধারাম বলল, তোমাদের এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে। হাতি দুটি তাদের কারাম_ধারামের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মিনতি করল। কারাম-ধারাম তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসল। এরপর ডুমুর গাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলল, তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলস ধন আছে সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুর গাছ কারাম-ধারামকে সাত কলস ধন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করল। তারা সাত কলস ধন হাতির পিঠে তুলে নিল। কুলগাছের সঙ্গে দেখা হতেই কারাম-ধারাম তাকেও একই কথা বলল। সেও তার গোড়ার মাটির নিচের সাত কলস ধন তুলে নেওয়ার মিনতি করল। কারাম-ধারাম তাই করল। এভাবে তারা কর্মভাগ্য নিয়ে সেই বটগাছের কাছে চলে এল। বটগাছ লংকা পার হয়ে আনা কর্মভাগ্যরূপী গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতিকে এন
ে পূজা করার নির্দেশ দিল। সে সময় থেকেই কারমা পূজার প্রচলন হয় এবং গাছটির নামকরণ হয় কারমা গাছ। আদিবাসীরা আজও বিশ্বাস করে কারমা পূজা তাদের অভাবমুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা।
শুধু গাছ নয়, আদিবাসীরা গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্যও বিশেষ ধরনের পূজা করে থাকে। সম্প্রদায় ভেদে মাহালিরা ‘গারয়া’ পূজা, মুণ্ডারা ‘ঘটবঙ্গা’, সাঁওতালরা ‘সহরায়’ আর ভূমিজরা ‘বাদনা’ পূজার মাধ্যমে গবাদিপশুর মঙ্গল কামনা করে থাকে। চমৎকার ভঙ্গিতে আব্রাহাম শুরু করে এ পূজার পৌরাণিক কাহিনীটি। শ্রীকৃষ্ণ একবার কোনো কারণবশত বৃন্দাবনবাসীকে ইন্দ্রপূজা করতে নিষেধ করেন। এতে দেবতা ইন্দ্র রেগে গিয়ে দিবারাত্রি মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টির ফলে বৃন্দাবনে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। বন্যায় বৃন্দাবনবাসীর দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বৃন্দাবনবাসীকে এই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন গিরিকে বৃন্দাবনের উপরে ছাতার মতো করে ব্যবহার করে বৃষ্টিমুক্ত করেন। এতে দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত হন। মূলত এ ঘটনার পর থেকেই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনবাসীকে কার্তিক মাসে অমাবস্যার পরদিন গিরি গোবর্ধন এবং গো-জাতির পূজা করতে উপদেশ দেন। সে থেকেই পালিত হচ্ছে এ ধরনের পূজা।
যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা সূর্য ও চন্দ্রকেও দেবতা হিসেবে পূজা করে আসছে। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় আদিবাসীরা পালন করে বিশেষ এক ধরনের পূজার আনুষ্ঠানিকতা। গ্রহণের সময় উপবাস থেকে উঠানে ধূপ জ্বালিয়ে তুলসী ঠাকুরকে ভক্তি করে এরা। এরপর বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে ঢাক-ঢোল আর থালা-বাটি বাজিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে_ ‘ছাড় পাপী, ছাড়া পাপী, হে ভগবান, ছাড় ভগবান’!
যুগে যুগে আদিবাসীরা নিজেদের বিশ্বাসকে অর্পণ করেছে নানা প্রাকৃতিক শক্তির ওপর। ফলে কাহিনীগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে সূর্য, চন্দ্র, পাহাড়, গাছ প্রভৃতি। এসব পৌরাণিক কাহিনীর বিশ্বাসকে ঘিরেই আদিবাসী ভাষায় তৈরি হয়েছে আদিবাসী গান, কবিতা আর ছড়া। মূলত কল্পকাহিনীগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে আদিবাসীদের জাতিসত্তাকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সমকালের কালের খেয়ায়  ৮ জানুয়ারি ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button