মুক্তিযুদ্ধ

অপারেশন জ্যাকপট: চাঁদপুর অ্যাটাক

১৯৭১ সালে নৌ-কমান্ডোরা চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে অ্যাটাক করে। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন জ্যাকপট’। কেমন ছিল তাদের ট্রেনিং? কীভাবে তারা এতগুলো বন্দরে একই সময়ে অ্যাটাক করলেন? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)-এর মুখোমুখি হয়েছিলাম একবার। তিনি যুক্ত ছিলেন চাঁদপুর নদীবন্দর অ্যাটাকে। আলাপচারিতার শুরুতেই অপারেশন জ্যাকপটের ট্রেনিং বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

তার ভাষায়,‘আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পালিয়ে চলে আসেন দিল্লিতে। প্রবাসী সরকার তাদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ। তাই নেভাল ইউনিট প্রয়োজন। এ কারণে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্দেশ্যেই ইন্ডিয়ান নেভির তিনজন অফিসারসহ সাবমেরিনার রহমত উল্লাহ (বীরপ্রতীক) আসেন আমাদের হাতিমারা ক্যাম্পে। নৌ-কমান্ডো হিসেবে কারা যোগ দিতে প্রস্তুত? অনেকে হাত তুলল। কিন্তু তারা বেছে নিল পোর্ট এরিয়ায় ছেলেদের। সাঁতার জানতে হবে, বিদেশিরা ট্রেনিং দেবে তাই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া হতে হবেএমনটাই ছিল যোগ্যতা। প্রাথমিকভাবে ৭০-৮০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপরই বলা হলোএটা হবে সুইসাইডাল স্কোয়াড। অনেকেই তখন হাত নামিয়ে নিল। অতঃপর ফিটনেস দেখে সিলেকশন করা হয় ৩০-৩২ জনকে। আমিসহ টিকে যাই চাঁদপুরের ১৩ জন। আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পলাশীতে, ভাগিরথী নদীর তীরে। ১৪ মে ১৯৭১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনিং শুরু হয়। সুইসাইডাল স্কোয়াড। তাই আগেই বন্ডে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। উল্টো বা চিৎ হয়ে সাঁতার কাটা, পায়ে ফিনস পড়ে শুধু চোখ-নাক ভাসিয়ে পানিতে মাছ বা সাপের মতো নিঃশব্দে চলা, জুডো-কারাতে ট্রেনিং, ম্যাপ রিডিং, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি শেখানো হয় ট্রেনিংয়ে। জাহাজ উড়ানোর ওয়াটার টাইট মাইনগুলো একেকটা ছিল ৫ থেকে ৬ কেজি। অপারেশনে সেগুলোই জাহাজে ফিট করতে হবে। তাই বুকে দুই-তিনটা ইট বেঁধে আমাদের সে কৌশলই শেখানো হয় ভাগিরথী নদীর জলে। বিশজন করে একেকটি গ্রুপ ছিল। এইচ গ্রুপে আমি, ওই গ্রুপের কমান্ডও করতাম। ট্রেনিং চলে ৩১ জুলাই ১৯৭১ পর্যন্ত। ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত, লে. কমান্ডার জিএম মার্টিস, লে. কপিল, কে সিং ও ক্যাপ্টেন সমীর কুমার দাশের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং হয় নৌ-কমান্ডোদের। ট্রেনিং করান কে এম দাস, ভট্টাচার্জ, কফিল, সিসিং, নানাবুজ প্রমুখ। ট্রেনিংয়ের বিষয়টি খুবই গোপনীয় ছিল। ধরেই নেওয়া হয়েছিল অপারেশনে আমরা ম্যাকসিমাম মারা যাব। মাইন ছাড়া অস্ত্র ছিল শুধুমাত্র একটি কমান্ডো নাইফ। কিন্তু বুকে ছিল দেশপ্রেম আর মাতৃভূমিকে মুক্ত করার তীব্র বাসনা।’

ট্রেনিং শেষে পরিকল্পনা হয় অপারেশন জ্যাকপটের। সেই ইতিহাস শুনি এই বীরপ্রতীকের মুখে। তিনি বলেন ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ (দাউদকান্দি ফেরিঘাটসহ) নদীবন্দরে একই ডেট ও টাইমে অপারেশন চালাতে হবে। তিনশোর মধ্য থেকে সিলেকশন করা হয় ১৬০ জনকে। চট্টগ্রামের জন্য ৬০ জন, মোংলার জন্য ৬০ জন, চঁাঁদপুরে ২০ জন ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন করে নৌ-কমান্ডো গ্রুপ তৈরি করা হয়। ফ্রান্স ফেরত সাবমেরিনার এ ডাব্লিউ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে (বীরউত্তম ও বীরবিক্রম) চট্টগ্রাম, আহসান উল্লাহকে (বীরবিক্রম) মোংলায়, বদিউল আলমকে (বীরউত্তম) চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আবেদুর রহমানকে। ছোটভাই শামসুলসহ আমাকে রাখা হয় চাঁদপুরের গ্রুপে। ৯ আগস্ট ১৯৭১। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জএই তিনটি গ্রুপকে সামরিক বিমানে আনা হয় আগরতলায়, শালবনের ভেতর নিউ ট্র্যানজিট ক্যাম্পে। একদিন পরেই দেওয়া হয় আর্মস অ্যামুনেশনপ্রত্যেকের জন্য একটা লিমপেড মাইন, একটা কমান্ডো নাইফ, একজোড়া ফিনস, থ্রি-নট-থ্রিসহ কিছু অস্ত্র এবং প্রত্যেক গ্রুপের জন্য একটা টু ব্যান্ডের রেডিও। বলা হলো ওই রেডিওর মাধ্যমেই সিগন্যাল পাঠানো হবে। কুমিল্লার ময়নামতি হয়ে আমরা চাঁদপুর আসি ১১ আগস্টে। প্রথমে উঠি নিজ বাড়ি দাশাদিতে, মেঘনা নদীর পাড়ে। কিন্তু যেতে হবে চাঁদপুরের দক্ষিণে, ডাকাতিয়া নদীর কাছাকাছি। ওই দিকটাতেই থাকে অধিকাংশ লঞ্চ ও স্টিমারগুলো। করিম খাঁ নামে এক মামার বাড়ি ছিল রঘুনাথপুরে। বাবার পরামর্শে পরদিন ইলিশ ধরার তিনটি নৌকায় ওখানে গিয়ে উঠি। অতঃপর রেডিওতে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকি। নির্দেশ ছিল প্রত্যেকদিন তোমরা আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র ধইরা রাখবা। ওটার মাধ্যমে সিগন্যাল পাবা। কেমন সিগন্যাল? আকাশবাণীতে সকাল সাত বা সাড়ে সাতটায় বাজবে একটি গান ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান।’ এ গান হলেই অপারেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পর আরেকটা গান বাজবে ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ^শুরবাড়ি।’ এই গানটি হলেই বুঝতে হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং ওই দিন শেষে রাত বারোটার পর অবশ্যই অ্যাটাক করতে হবে। ১৩ আগস্ট সকালে বাজল প্রথম গানটি। আমি, নুরুল্লাহ পাটওয়ারী, বদিউল আলম সঙ্গে সঙ্গে পাটের ব্যাপারী সেজে রেইকি করতে বেরোই। ২৪ ঘণ্টা পর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট চূড়ান্ত নির্দেশনার গানটি বাজার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন সেটি না বেজে বাজল ১৫ আগস্ট সকালে। ফলে রাত বারোটার পরই আমরা অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিই। লঞ্চ টার্মিনাল ও স্টিমার ঘাটসহ ছয়টা টার্গেট প্লেস ঠিক করে ফেলি। তিনটা মাইন লাগিয়ে ফাটাতে পারলে একটা জাহাজ হানড্রেড পারসেন্ট ডুবে যায়। সেটি করতে লাগবে তিনজন নৌ-কমান্ডো। তাই তিনজন করে ৬টা গ্রুপে টার্গেট ভাগ করে নিই। বাকি ২ জন থাকবে রেসকিউ টিমে। আমার সঙ্গে থাকে খুলনার আফসার আর সাতক্ষীরার গফুর মাস্টার। টার্গেট প্লেস ছিল লন্ডনঘাট জেটি। ওখানে পাকিস্তানি সেনারা আর্মস অ্যামুনেশন আর মালামাল নামাত। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ডাকাতিয়া নদী দিয়ে নামি। পায়ে ফিনস, পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার। বুকে গামছা দিয়ে মাইন পেঁচিয়ে চিৎ সাঁতারে এগোই। কিছুক্ষণ পরপরই দেখে নিই দিকটা। এভাবে লন্ডনঘাটে এসেই জেটিতে মাইন সেট করে দিই। ৪৫ মিনিট পরই বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই ওই সময়ের মধ্যেই সরে পড়তে হবে। পুরো বর্ষা ছিল তখন। মুখার্জি ঘাটে পাহাড়ায় ছিল পাকিস্তানি সেনারা। নদী দিয়ে কী যায় বলেই ওরা পানিতে দুইটা ফায়ার করে। তখন ডুব দিয়ে দূরে গিয়ে উঠি আমরা। এর কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনঘাটসহ বিভিন্ন জাহাজে লাগানো অন্যান্য গ্রুপের মাইনগুলো একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে। কথা ছিল বহরিয়া গ্রামের মাঝামাঝিতে মাছ ধরার দুটি নৌকা নিয়ে থাকবে রেসকিউ টিমের দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে গানবোট নিয়ে চারপাশে টহল দিতে থাকে। ওদের ভয়ে রেসকিউ টিমের দুজন নৌকা ছেড়ে গ্রামের ভেতর আত্মগোপন করে। ফলে ফিরে এসে আমরা নৌকা না পেয়ে বিপদে পড়ি। তখন যে যার মতো সরে পড়ি।’

নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা গেলে দেশটা অনেক এগোবে এমনটাই মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীরপ্রতীক)। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন ‘একাত্তরে আমরা সুইসাইড স্কোয়াডে গিয়েছিলাম। একটা দেশ আর পতাকা এনে দিয়েছি। সেই পতাকা তোমরা রক্ষা করো। কী পেলাম, কী পেলাম নাএ নিয়ে ব্যস্ত থেকো না। নিজের কাজটা সততার সঙ্গে করো। তবেই দেখবে একদিন দেশটা সোনার বাংলা হবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button