কলাম

ভালো মানের বই থাকুক বইমেলায়

শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সবার কাছে এটি পরিচিত একটি শব্দেই—বইমেলা। এই মেলার পরিধি বাড়ছে বছর বছর। তার সঙ্গে বাড়ছে স্টলের সংখ্যাও। প্রতিবছরই মেলাকে ঘিরে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বই বিক্রির সর্বোচ্চ রেকর্ডও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শুরুর দিকে বইমেলার এই আয়োজনটা কেমন ছিল? সে ইতিহাসটাও জেনে রাখা ভালো।

অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি নাম—চিত্তরঞ্জন সাহা। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে উনিই গ্রন্থমেলার সূচনা করেন। সেটি হয়েছিল বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউন প্রাঙ্গণের বটতলায়, এক টুকরো চটের ওপর। কলকাতা থেকে আনা মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে তিনি বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। ৩২টি বই-ই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে যা মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ওই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বইমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমিকে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। অতঃপর ১৯৮৪ সালে মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলাই এখন বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে।

এবার বইমেলার সময়টাতে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। মেলার আয়োজন, স্টল বিন্যাস আর পরিবেশও বেশ অন্যরকম বলে ঘোষণা দিয়েছে মেলা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মেলায় যে শিশু, নারী, পুরুষ আসে, তাদের জন্য যে পানির ব্যবস্থা, চা-কফির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সেটিও কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, স্টলে ঘুরতে ঘুরতে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বসার সুব্যবস্থাও রাখতে হবে।

প্রায় প্রতিবছরই বাংলা একাডেমি কোনো না কোনো প্রকাশনী সংস্থা বন্ধ করে দেন উগ্রবাদী বই প্রকাশের অভিযোগে। ফলে ওই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত অন্য লেখকদের বইগুলোও তখন হুমকির মুখে পড়ে। এ বিষয়টির দিকে খেয়াল করা উচিত বলে মনে করছি।

বইয়ের পাঠক বেড়েছে নাকি কমেছে? এ নিয়ে নানা রকম মতামত ছিল ও আছে। পাঠক বৃদ্ধির মাপকাঠি হিসেবে কেউ কেউ মেলায় বিক্রির হিসাব তুলে ধরেন।

বইমেলা চলাকালে প্রাঙ্গণের ভেতরের দিককার প্রকাশকদের মুখ ভার থাকে। সামনের কিংবা নামীদামি প্রকাশকরা বিক্রির কথায় কিঞ্চিত মুচকি হাসেন। কেউ কেউ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বলে থাকেন, ‘ভাই মেলায় বিক্রি নাই। প্রকাশনা শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।’ কিন্তু আসলেই কি তাই?

এখনও এমন খবর পাওয়া যায় না যে, শুরু হওয়া কোনো প্রকাশনা সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বরং এবারের বইমেলায়ও প্রকাশনী সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে। সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক তৈরির কর্মসূচি বেড়েছে বহুগুণ। একইভাবে বেড়েছে বই কেনার সংখ্যাও। প্রতিবছর শুধু অনলাইনেই বিক্রি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বই। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও পাবলিক লাইব্রেরি বই কেনে প্রতিবছরই। বড় বড় এনজিও ও বেসরকারি সংস্থা প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক টাকার বই কিনছে। সরকারিভাবে প্রতি জেলায় এবং অনেক উপজেলাতেও বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে এবং সেগুলোতে অংশ নিচ্ছেন নামীদামি প্রকাশকরা। ইদানীং বেশ কিছু প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইমেলার আয়োজন করছে। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পাঠক তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। বলা যায়, অনেক প্রকাশনী সংস্থাই এখন পাঠক তৈরিতেও কাজ করছে আন্তরিকতার সঙ্গে।

তবে এখনো আমরা দেখি অনেক প্রকাশক বই করছেন মেলাকে ঘিরে। এই দায় লেখকেরও। মেলা ছাড়া বাকি সময়টাতে অধিকাংশ প্রকাশকই খুব কম বই বের করে। এতে মেলাকে ঘিরে নতুন বই প্রকাশের তোড়জোড়ে সম্পাদনার কাজটি একেবারেই হয় না। ফলে রঙচোঙা প্রচ্ছদ নিয়ে যে বইটি মেলায় প্রকাশিত হয়, সেটি পাঠককে তেমন আন্দোলিত করে না। বরং বই কিনে পাঠক প্রায়ই ঠকে যায়। এভাবে পাঠকও বইমেলায় মানসম্মত বই কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

যেকোনো লেখক তার পাণ্ডুলিপিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। ওই পাণ্ডুলিপির বিষয় বিবেচনা ও সম্পাদনা করে সেটিকে পাঠ উপযোগী করে উপস্থাপনের দায়িত্বটি থাকে প্রকাশকের। তা না হলে পাঠক প্রতারিত হবে এবং একসময় বইমেলা তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে।

দেশে সত্যিকারভাবে কি পাঠ বেড়েছে? কিংবা আমরা কি পারছি পাঠক তৈরি করতে? এই দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি প্রকাশকের এবং লেখকেরও। বইমেলায় বই বেরিয়েছে এমন নব্বই ভাগ লেখকই নিয়মিত পত্রিকায় লিখেন না। ফলে লেখার মাধ্যমে পাঠক তৈরির যে চেষ্টা, তা থেকে তারা পিছিয়ে থাকেন। এমন লেখকের বই শুধু তার পরিচিতজনদের হাতেই সেলফি তোলার প্রয়োজনে শোভা পায়।

প্রতিবছরের মতো এবারও বইমেলায় হাজার হাজার বই হয়তো প্রকাশিত হবে। কিন্তু তার মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন—বাংলা একাডেমির উচিত সেটিও বের করে প্রকাশ করা। একইভাবে বইয়ের বিষয় নির্বাচন ও সম্পাদনা না করা হলে যত বড় বইমেলার আয়োজনই করা হোক না কেন, শিল্প-সাহিত্যের তেমন কোনো উন্নতি ঘটবে না। বরং পাঠক এক সময় প্রতারিত হওয়ার ভয়ে বইমেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর এর দায় বহন করতে হবে লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। তাই এ বছর বইমেলায় আমাদের প্রত্যাশা একটাই—বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে ভালো মানের বইয়ের সংখ্যাও বাড়ুক। ভালো মানের বই থাকুক বইমেলায়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button