কলাম

পর্যটক যখন পরিবেশবিনাশী

ঋতুবৈচিত্র্যে বাংলাদেশ সত্যি অপরূপ। শীতে যে পাহাড় দেখলে শুষ্ক ও রুক্ষ মনে হয়; বর্ষার পর সেসব পাহাড়ই সবুজ স্নিগ্ধতায় সজীব হয়ে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যের যেমন শেষ নেই, তেমনি এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর জায়গারও অভাব নেই। একেক জায়গার প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার আমাদের মনকে একেকভাবে স্পর্শ করে।

ভ্রমণের অভিযান শুধু পর্বতের চূড়া আর সমুদ্রের তরঙ্গ ফেনাই নয়; ভ্রমণ সেখানেও, যেখানে নিভৃতে একটি ছোট্ট মটরফুল তার আশ্চর্য নীল রং মেলে ফোটে, দূর জনপদের ছোট্ট বাজারের প্রান্তে ক্লান্ত বৃদ্ধা একডালি শামুক বেচতে বসে, ছোট্ট পুঁটিমাছটি মৃতচোখে তাকিয়ে থাকে খ্যাপলা জালের খোঁপে।

ভ্রমণপ্রেমীদের এমন ভাবনাগুলো আমাদের যেমন আশাবাদী করে তোলে, তেমনি এ দেশে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকেও ইঙ্গিত করে। কিন্তু ভ্রমণকারী বা পর্যটকরা কতটা সচেতন আর পরিবেশবান্ধব থাকছেন? সেই প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায় সব সময়।

নাগরিক জীবনে নানা ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই মানুষ ঘুরতে বেরোয়। কেউ ছুটে সমুদ্রে, কারও পছন্দ পাহাড়, আবার কেউ ছুটে হাওরের দিকে। অনেকেই ছুটি পেলে ছুটে যান তার প্রিয় গ্রামটিতে। কাকডাকা ভোর, শালিক আর টুনটুনির ডাকে বিমোহিত হওয়া, বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেতের বুকে ভারী বাতাসের ঢেউ ঢেউ খেলা এসবই তাকে আন্দোলিত করে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী মনকে আনমনা করে দেয়। হৃদয়ে জমে থাকা স্মৃতিগুলোও ঝড় তোলে। এ সবই ভ্রমণপ্রেমীদের ভালোলাগার অংশ হয়ে ওঠে।

ভ্রমণে সুন্দর প্রকৃতি, পাহাড়, সমুদ্র, নদী ও হাওরের কাছে গিয়ে আমরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলি। হয়তো ভেতরে জমে থাকা ক্লান্তি ভোলার চেষ্টা। পরে ফিরে আসি কিছু আনন্দ, উৎসাহ আর জীবনে চলার সাহস নিয়ে। কিন্তু যে প্রকৃতি আমাদের আনন্দ আর জীবনবোধের শিক্ষা দেয়, ভ্রমণে গিয়ে সেই প্রকৃতিকে আমরা কতটুকু দূষিত করে আসি সেটি কি কখনো ভেবেছি আমরা?  ভ্রমণপ্রেমীদের নিয়ে কেন এমন আক্ষেপ? বিষয়টি পরিষ্কার করছি এখন। কোরবানির ঈদের ছুটির আমেজ এখনো চলছে। ফলে হাওরে বেড়াতে গেছেন অনেকেই। টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। চলতি বন্যায় বানের পানিতে থৈ থৈ করা সুনামগঞ্জের মানুষের কষ্ট এখনো কমেনি। অথচ ঈদের ছুটিতে শত শত পর্যটক বেড়াতে গিয়েছেন সেখানে। ওই অঞ্চলের জন্য এটিকে আশাবাদের খবর বলা যায় কি না জানা নেই। কিন্তু ওই ভ্রমণপ্রেমীরা সেখানে কী রেখে গেছেন? সেটি উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। এটি যেমন দুঃখজনক তেমনি লজ্জার খবরও।

গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, যতদূর চোখ যায় টাঙ্গুয়ার ঈষৎ সবুজাভ পানিতে এখন ভাসছে সাদা প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম প্লেট, বোতল বা প্লাস্টিকেরই কোনো বর্জ্য। কোরবানির ঈদে বা ঈদের পর বেড়াতে এসে হাওরের জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ জলাভূমির এই হাল করে ছেড়েছেন ‘পর্যটকরা’।

স্থানীয়দের ভাষ্য, দেশের নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্লেট, বোতল, গ্লাস, পলিথিনসহ নানা ধরনের বর্জ্য ফেলছেন টাঙ্গুয়ার হাওরেই। যা এখন হাওরের ওয়াচ টাওয়ার, জয়পুর, গোলাবাড়ি, পাটলাই নদীসহ হাওরের বিভিন্ন স্থানে ভাসছে। একইসঙ্গে পর্যটকদের উচ্চশব্দের ‘ডিজে পার্টিতে’ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা। এমন অসচেতন পর্যটকদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন, ‘আমরা এখনো ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এর মধ্যেই পর্যটকরা টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করবেন এটা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। পর্যটকদের উচ্চশব্দে মাইক বাজানো এবং হাওরে অবাধে প্লাস্টিক বর্জ্য বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিন্তু সে উদ্যোগ কেন দূষণের আগেই নেওয়া হলো না সেটি নিয়েই প্রশ্ন জনমনে। শুধু প্রশাসন নয়, জনগণকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে ‘নিয়ন্ত্রিত ইকো টুরিজম’ গড়ে তোলার মাধ্যমে এমন সমস্যার সমাধান করার উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মত দেন টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণে দেড় দশক ধরে কাজ করে আসা সংস্থা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি তারা মনে করেন টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয়দেরও সচেতন করা দরকার।

হাওরে পর্যটক হিসেবে যারা বেড়াতে যান, তারা অধিকাংশই সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণির মানুষ। সামর্থ্যরে দিক থেকেও তারা এগিয়ে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে নিজের বাড়িটিকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখতেই তারা পছন্দ করেন। সে হিসেবে আশা করা যায় যে, তারা রুচিশীল। কিন্তু ভ্রমণে গিয়ে চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কেন তারা সেই রুচিশীল আচরণটি ধরে রাখতে পারেন না আমাদের জানা নেই। দূষণকারী হিসেবে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন যারা ফেলেছেন, প্রত্যেক পর্যটকের ওপরই এর দায় বর্তায়। তাই এ বিষয়ে পরিবেশবান্ধব সচেতন পর্যটক হিসেবে নিজেকে পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে প্রত্যেককেই।

শুধু হাওরই নয়, সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিনস সৈকত ও এর আশপাশের এলাকা থেকেও ৪ দিনে দুই হাজার কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করেছে ‘ক্লিন সেন্টমার্টিন’ নামের একটি সংগঠন। এ ছাড়া পর্যটকদের প্রবাল সংগ্রহের কারণেও দূষিত হচ্ছে সৈকতের পরিবেশ। দুর্লভ অলিভ রিডলি কাছিমের প্রজননস্থল এখানেই। কিন্তু দ্বীপে অধিক রাত পর্যন্ত আলো জ্বালানোর কারণে কাছিমের ডিম পাড়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ফলে এখন অনেক কম সংখ্যক কাছিম ডিম পাড়ার জন্য সৈকতে আসছে। দ্বীপে পাওয়া মাছগুলোও এখন ক্ষতিকর ভারী ধাতব পদার্থের কারণে দূষিত হচ্ছে।

দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি পাহাড়ও। এ সময়ের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেক। সেন্ট মার্টিনসের মতো দিন দিন সেখানেও বাড়ছে পর্যটকদের উপস্থিতি। একই সঙ্গে বাড়ছে ময়লার স্তূপ। সাজেক যাওয়ার পথসহ পর্যটকরা যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ফেলেন। এতে প্রত্যেকটি কটেজ, পাহাড়ের দুদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। যার অধিকাংশই পচনযোগ্য নয়। ফলে ক্রমেই সৌন্দর্য হারাচ্ছে সাজেক। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির আলুটিলাসহ কয়েকটি স্পটও এমন প্লাস্টিক দূষণের কবলে।

পরিবেশ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা ও ভ্রমণে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগেরও প্রবল ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। তারা মনে করেন, সরকার কঠোর হলেই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। পাশাপাশি ভ্রমণে মানুষকে পরিবেশসচেতন করতে উদ্যোগী হতে পারে গণমাধ্যমও। অসচেতন ও পরিবেশবিনাশী পর্যটকরা পর্যটনশিল্পের জন্য হুমকি স্বরূপ। হাওর, নদী, সমুদ্র ও পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচাতে সম্মিলিতভাবে এমন অসচেতন পর্যটকদের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন এখনই।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল:১৪ জুলাই ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button