আদিবাসী

হাতি খেদা বিদ্রোহ: মনা সর্দারের বিদ্রোহের ডাক

প্রথমে হাজংরা পাহাড় অঞ্চলের গভীর অরণ্যের মধ্যে গজারি গাছের খুঁটি দিয়ে একটি বড় স্থানে বেষ্টনী তৈরি করত। অতঃপর সেখানে লাগানো বা চাষ করা হতো হাতির প্রিয় খাবার কলাগাছ ও ধান। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বন্যহাতির পাহাড়ে থেকে দলবেঁধে নেমে আসত। তারা কলাগাছ ও ধানের লোভে ওই বেষ্টনী বা খেদার মধ্যে প্রবেশ করলেই হাজংরা খেদায় ঢোকার পথগুলো বন্ধ করে দিত। এরপর গৃহপালিত কুনকি হাতির সহায়তায় বন্যহাতিদের বশ করে তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে বাইরে নিয়ে আসা হতো। জমিদারগণ ওই হাতিগুলোই ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, দিল্লি প্রভৃতি অভিজাত জায়গায় বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করত।

এভাবে হাতি বিক্রয় করে জমিদারগণ প্রতি বৎসর বহু অর্থ-সম্পদের মালিক হতে থাকে। কিন্তু এ কাজের জন্য হাজংদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। বরং জমিদারগোষ্ঠীর অর্থের লালসা মেটাতে গিয়া প্রতি বৎসর বহু হাজং চাষিকে বন্যহাতির পায়ের তলায় জীবন দিতে হতো। আবার হাতি ধরার কাজে না আসলে রাজা-জমিদাররা তাদের ওপর নানা অত্যাচার চালাত। এ নিয়ে বহুকাল হতে হাজংদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। অতঃপর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তা বিস্ফোরণে রূপ নেয়।

নতুন জীবনের স্বপ্নে ওই অঞ্চলের হাজংরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। সে সময় হাতি খেদার কাজের জন্য জমিদারগণ বাধ্যতামূলক বেগার-প্রথাও চালু করার চেষ্টা করে। ফলে এর বিরুদ্ধে হাজংরা প্রতিবাদ করলে সুসং জমিদারগণ নানাভাবে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালানো আরম্ভ করে।

জমিদারগণের উৎপীড়ন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। হাজংদের সহ্যের সীমাও তখন শেষ হয়ে আসে। ঠিক তখনই হাজং নেতা মনা সর্দার দুর্গাপুরে হাতি খেদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। জমিদারের উৎপীড়নে ওই অঞ্চলের বিক্ষুব্ধ গারো চাষিরাও সে সময় বিদ্রোহী হাজংদের সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে সমগ্র সুসঙ্গ-পরগনায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জমিদাররাও। বিদ্রোহের প্রধান নায়ক মনা সর্দারকে তারা কৌশলে আটক করে। অতঃপর তাকে বুনো হাতির পায়ের তলায় পিষে নির্মমভাবে হত্যা করে।

চোখের সামনে মনা সর্দারের নৃশংস মৃত্যুতে ঠিক থাকতে পারে না হাজংরা। জমিদারদের বিরুদ্ধে তারা ফুঁসে ওঠে। সমস্ত শক্তি নিয়ে একযোগে তারা সুসং-এর বারোমারি ময়দানে আক্রমণ করে জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজ বাহিনীর ওপর। সে সময় জমিদারদের হাতিগুলোর হাজং মাহুতগণও তাদের হাতিগুলোকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ফলে ওই হাতির দলও জমিদার বাহিনীকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে জমিদারদের বহু পাইক-বরকন্দাজ হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়।

অতঃপর হাজং ও গারো কৃষকদের সম্মিলিত বাহিনী সুসং-দুর্গাপুর আক্রমণ করে। জমিদার-পরিবার তখন প্রাণ বাঁচাতে নেত্রকোনা শহরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিদ্রোহীরা জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে বিজয়পুর, ধেনকী, ভরতপুর, আড়াপাড়া, ফারাংপাড়া, চেংনী প্রভৃতি স্থানের সব হাতি খেদা পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে।

এ বিদ্রোহ চলে প্রায় পাঁচ বছর। বিদ্রোহে বেতগড়ার রাতিয়া হাজং, ধেনকির মঙ্গলা, লেঙ্গুরার বিহারি, হদিপাড়ার বাঘা, ফান্দা-গ্রামের জগ, বিজয়পুরের সোয়া হাজং প্রমুখ শহীদ হন। এ সময় মলা ও তংলু নামের দুজন নিখোঁজ হন। এ ছাড়া বিদ্রোহের সময়ে বাগপাড়ার গয়া মোড়লকে জমিদারদের লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেও আর ফিরে আসেনি। সুসং পরগনার এই হাতি খেদা বিদ্রোহের ফলে হাতি ধরার হাতি খেদাগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ত্রিশ বৎসর ওই অঞ্চলের কৃষকরা নানা নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ ছিল বাধ্যতামূলক হাতি খেদার বিরুদ্ধে সুসং পরগনার হাজং বিদ্রোহ। হাতিখেদার বিরুদ্ধে কৃষক-বিদ্রোহের বিভিন্ন কাহিনী আজও আদিবাসীর গ্রামে গ্রামে উপকথার মতো ছড়িয়ে আছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যা তাদের প্রেরণা জোগায়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button