মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতার আনন্দে সব কষ্ট ভুলে গেছিলাম

আমগো পরিবার চলছে কষ্টে। বাবা কৃষিকাজ করত। নিজের জমি ছিল না। মাইনষের জমি বর্গা নিত। বাবার লগে মাঠে কাজ করতাম। পড়াশোনা তেমন করতে পারি নাই। স্কুলে যাওয়া শুরু করছি মাত্র। স্কুলে গোলপাতার ঘর ছিল। কাঁচামাটি। চাটখুল (তালপাতার মাদুর) বিছায়ে বসতাম। আর তাল পাতায় লিখতাম। বাঁশের কঞ্চি ছিল আমগো কলম। হাড়ির নিচে কালি পড়ত। ওইটা দিয়াই অ, আ লিখতাম। আলতাফ মাস্টার শিখাইত সব।

“আমার বয়স তহন সাত। একবার বাবার পেটফোলা অসুখ হয়। বিছানায় পইড়াই সে মারা যায়। তহন আর পড়তে পারি নাই। পরিবার তহন পানিতে পরে। কে দেখাশোনা করব? কেউ তো নাই! তহন পাশে আইসা দাঁড়ায় বড় ভগ্নিপতি মাছেম মোল্লা। আমগো নিয়া যায় তার বাড়িত, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে।

“বাবার পরে তার লগেই জমিত কাজ করতাম। পাট কাটা, ধান কাটাই ছিল কাজ। শ্রমজীবী আছিলাম। এক লগে মাঠে কাজ করত মোজাহার গাজী, জয়নাল, আলম, রাহেন আর নওশেরও। দিনে কাজে থাকতাম। রাতের বেলায় যহন জোসনা উঠত তহন বন্ধুরা ডাইকা নিত। জোসনার আলোয় গোল্লাছুট খেলছি কাচারির মাঠ আর বাদাম তলায়।

“১৯৭০ সাল। বয়স তহন ১৮। কাজ কইরা খাইতাম। দেশের অবস্থা নিয়ে তেমন খবর রাখতাম না। মাইনষের মুখে শুনতাম শেখ সাহেবের কথা। ওই বছরই সর্বপ্রথম ভোট দিছি। খুব আনন্দ হইছিল।

“কোন মার্কায় ভোট দিমু? সবাই কইলো: ‘নৌকায় দে।’

“ছোটবেলা কাটছে খুলনার নালিয়ার চরে। ওইডা তো বিলের দেশ। জন্মের পর থেকেই নৌকা নিয়ে ঘুরি। নৌকায় ঘাস কাটা। নৌকায় মাছ মারা। ধান আনি নৌকায়। হাটে যাই নৌকায়। সবকিছু করি নৌকায়। আমগো জীবনের লগে নৌকা মিশা আছে। আবার বঙ্গবন্ধুর মার্কাও নৌকা। তাই জীবনের প্রথম ভোটটাও দিছিলাম নৌকাতেই।”

পাকিস্তানি সেনাদের গুলি সেকেন্দার আলীর বাম পায়ের থাইয়ে বিদ্ধ হয়

শৈশব ও কৈশোর জীবনের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলী।

তাঁর গ্রামের বাড়ি খুলনার নালিয়ার চর হলেও পরে তাঁরা বসতি গড়েন নড়াইলের ডুমুরিয়া গ্রামে। আব্দুল জলিল মোল্লা ও আলেকজান বিবির চতুর্থ সন্তান সেকেন্দার। এক সকালে আমাদের আলাপচারিতা চলে তাঁর নড়াইলের বাড়িতে বসে। কথা হয় যুদ্ধদিনের গদ্য ও তাঁর জীবনপ্রবাহ নিয়ে।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সবার দৃষ্টি তখন শেখ মুজিবের দিকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। গ্রামে বসে সে ভাষণ রেডিওতে শোনেন সেকেন্দার আলী। খেটে খাওয়া মানুষ। দেশের জন্য কী বা করতে পারবেন! তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাঁকে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে। তাঁর ভাষায়:

“তাঁর ভাষণে বেশি উৎসাহ জাগছে। তিনি বললেন: ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…তোমাদের যার যা কিছু আছে…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…।’ এরপরই মনে হইছে বইসা থাকা যাইব না।”

২৫ মার্চ ১৯৭১। সারা দেশে পাকিস্তান আর্মি নামে। তারা জেলা শহরগুলো দখলে নিয়ে গ্রামগুলোতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। এ খবরে ঝড় ওঠে সেকেন্দারের মনে। পাঞ্জাবিদের দেখার অদ্ভুত এক ইচ্ছে জাগে তাঁর। বাকি ইতিহাস শুনি তাঁর জবানিতে।

“আমগো গ্রামে তহনও পাঞ্জাবি ঢুকে নাই। প্রথমে খালি শুনি: পাঞ্জাবি আসতেছে। গ্রামকে গ্রাম জ্বালায়া দিতেছে। ওগো নাম শুনলেই গ্রামে মানুষ আর থাকে না। সব চইলা যায়। কালিয়া থেকে দক্ষিণের গ্রামগুলা ওরা জ্বালায়া দেয়। দূর থেকে আমরা খালি ধোঁয়া দেহি। গোপালগঞ্জের পাশে মানিহারও ওরা পোড়ায়া দিছে।

পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে সেকেন্দার আলীর বাম পায়ের থাইয়ের হাড় ভেঙে যায়

 “ওরা মানুষ নাকি অন্য কিছু? আমার খুব ইচ্ছা হয়: পাঞ্জাবি দেখবই। একদিন ওরা গানবোর্ড নিয়া আসে পাশের গ্রামে, জয়নগর বাজারে। সবাই তো পালাচ্ছে। ভয়ে সব অস্থির। দূর থেকে পাঞ্জাবি দেইহা চইলা আসি। দেহি ওরা তো মানুষই। তাইলে আবার মানুষরে মারে কেমনে? মুসলমান ওরা। তাইলে এভাবে মুসলমান হত্যা করে কেমনে? নানা প্রশ্ন মাথায় ঘোরে।”

“পাকিস্তানিরা দেশের ক্ষতি করছে। গ্রামগুলো জ্বালায়া দিতেছে। মা-বোনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তহন সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যামু। ভেতরে ভেতরে খুঁজতেছি কারা যায়। এক গ্রুপের খবর পাই। কিন্তু ওরা আমারে নেয় না। কিছু খরচ তো সাথে নিতে হইব। মারে বলছি: টাকা দাও। যুদ্ধে যামু। মা মানা করছে। বলে: ‘যাওয়ার দরকার নাই বাপ। একসঙ্গে থাকব। পাঞ্জাবিরা যদি আইসা মারে সবাই একসাথেই মরমু।’

“আমার খুব রাগ হইল। বললাম: ‘ওগো গুলি খাইয়া আমি মরমু না। তুমি টাকা দিলেও মুক্তিযুদ্ধে যামু, না দিলেও যামু।’ তহনই ঘটল আরেক ঘটনা।”

কী ঘটনা?

“আগস্টের কথা। বড় ভাই থাকত কালিয়া উপজেলা থেকে একটু দূরে, চাচরি কদমতলায়। একদিন ওখানে যাচ্ছিলাম। কালিয়াতে যে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা ক্যাম্প বসাইছে জানতাম না। ওরা আমারে আটকায়। কয়: ‘তুই মুক্তিবাহিনীর লোক। তুই জানস মুক্তিবাহিনী কোথায়? সত্য কথা বললে ছাড়ি দিমু। মিথ্যা কইলে গুলি করমু।’

“আমি কই: ‘সারা দিন কাজ করি মাঠে। আর সন্ধ্যা হলেই বাড়িত ঘুমাই। মুক্তিবাহিনী কখন আসে কখন যায় আমি তো দেহি নাই।’

“আমারে খুব মারে ওরা। মেজরের কাছে নিয়া যায়। বর্তমান এমপি অফিসে ছিল ওগো ক্যাম্প। সন্ধ্যায় আমারে একটা বাংকারের সামনে নিয়া বসায়। আমাকে শুনায়া ওরা প্রচণ্ড গালাগালি করে বঙ্গবন্ধুরে। সে গালির কোনো শেষ নাই। ওরা খেয়াল করে আমি উত্তেজিত হই কি না। উত্তেজিত হইলেই বুঝব মুক্তিযোদ্ধা।”

লক্ষ্ণৌ হাসাপাতালে চিকিৎসার সময় মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলী (পেছনে, মাঝে)

আপনাকে কি বন্দি করে রেখেছিল?

“না, সকালের দিকে কয়েকটা চর মাইরা ছাইড়া দিল। আমার জেদ চাইপা গেল। খালি খালি ওরা আমারে মারল। ওগো তো ছাড়া যাইব না। বাড়িত আইসাই যোগাযোগ হয় গ্রামের বুলু মোল্লার লগে। তার নেতৃত্বেই এক সকালে আমি, শওকত, বাদশা মোল্লাসহ ১৯ জন একলগে বাড়ি ছাড়ি। মায় এইবার বাধা দেয় না। কিছু টাকা দিয়া মাথায় হাত বুলায়া দেয়।”

সেকেন্দাররা বাগদা বর্ডার পাড় হয়ে চলে যান ভারতের পাঁচ নম্বর টালিখোলায়। ওখানের ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রথমে নাম লেখান। অতঃপর তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহার চাকুলিয়ায়। তাঁরা ২৮ দিনের ট্রেনিং নেন সেখানে। শিক্ষিত ছেলেরা খেখে বড় বড় হাতিয়ারে ব্যবহার। কিন্তু লেখাপড়া কম থাকায় সেকান্দারকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর শপথ শেষে অস্ত্র দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় রণাঙ্গনে, ৮ নম্বর সেক্টরে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন এই বীরযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তাঁর বাম পায়ের থাইয়ের ভেতর দিয়ে ঢুকে হাড় ভেঙে বেরিয়ে যায়। চিকিৎসা চলে ভারতের ব্যারাকপুর ও লক্ষ্ণৌ সামরিক হাসপাতালে।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় জার্মানিতে। এতে পা রক্ষা পেলেও সারা জীবনের জন্য তিনি পা ভাজ করতে পারেন না। অপারেশনের পর পা চার ইঞ্চি ছোট হয়ে যাওয়াতে চলতে হয় খুড়িয়ে খুড়িয়ে। এখনও ব্যথা হয় প্রচণ্ড। গরমে ইনফেকশেন হয়ে পুঁজ পড়ে। পায়ের ব্যথা দিয়েই তাঁর দিনের শুরু। আবার ব্যথা নিয়েই ঘুমোতে যান এ যোদ্ধা। স্বাধীনতার জন্য তাঁর এই আত্মত্যাগ চলবে মৃত্যু অবধি। তবু দেশের জন্য সবকিছু হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন এই সূর্যসন্তান।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?

প্রশ্ন শুনে খানিকটা আনমনা হন মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলী। বুকে জমানো কষ্টের মেঘগুলো তখন চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমরাও আনমনা হই। অতঃপর তিনি বলতে থাকেন:

“বয়রা ক্যাম্প থেকে আমরা যাব নিজ নিজ এলাকায়। অজানা অচেনা জায়গায় তো যুদ্ধ করতে পারব না। নিজের এলাকায় সব চেনা। যুদ্ধ করাও সহজ হবে। আমরা পুরা সাড়ে চারশ। যশোর, বরিশাল, খুলনা আর ফরিদপুর চার জেলার সবাই তিনটা ভাগ হইছি। এক এক গ্রুপে দেড়শর মতো। আমগো লগে পথ চেনানোর জন্য থাকত একটা গাইডার। গাইডার আগে থাকে। আমার পিছু পিছু। রাতে চলতাম। দিন হলেই লুকায়া থাকতাম গেরিলা সেজে। সেনাবাহিনীর আকমান হোসেন ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার। আর আমগো ১০-১২ জনের গ্রুপের কমান্ড করতেন বিএল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুক।

মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলীর অনুকূলে ব্যারাকপুর হাসাপাতালের ছাড়পত্র

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। মধ্যরাত। আমগো দক্ষিণের গ্রুপটি ওই রাতেই ধরা খেয়ে যায়। শুরু হয় গোলাগুলি। আমরা দূর থেকে তা শুনি। বয়রা থেকে ভেতরে নদী পাড় হয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে গেছি। হেঁটে হেঁটে পূর্বদিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানি সেনার যে ওত পেতে বসে আছে টেরই পাইনি। হঠাৎ ডান পাশ থেকে ওরা একযোগে গুলি চালায়।

“আমিসহ তিনজনের গুলি লাগে সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম টের পাই। ছিটকে পড়ে গেছি। রক্ত পড়ছিল। পায়ে হাত দিতেই হাড়ের গুঁড়াগুলো আঙুলের আগায় চলে আসে। গ্রুপ কমান্ডার আকমান হোসেন আমাকে টেনে উঠায়। ঘাড়ে করে নিয়ে আসে গ্রামের ভেতর এক বাড়িতে।

“ভোরের দিকে একটা ঘরের দরজার তক্তা খুলে তাতে শুইয়ে সহযোদ্ধারা আমায় বয়রা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। জ্ঞান তখনও ছিল। তক্তা দোলে। আর ব্যথায় আমার জীবন মনে হয় বের হয়ে গেল। একসময় জ্ঞান হারাই। গুলিটা বাম পায়ের থাইয়ের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়া বের হয়ে যায়। গুলির আঘাতে হাড় দুই টুকরো হইছিল। প্রথম অপারেশন হয় ব্যারাকপুর হাসপাতালে। ওখান থেকে পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লক্ষ্ণৌ সামরিক হাসাপাতালে।

“দেশ যখন স্বাধীন তহন আমি লক্ষ্ণৌতে। নার্স আইসা বলে: ‘তোমারা দেশ স্বাধীন হো গিয়া।’

“আমি আনন্দে সব কষ্ট ভুলে যাই। পায়ের কথা ভুলে লাফিয়ে নামতে গেছিলাম।

“দেশে যখন ফিরলাম তহনও পায়ের ঘা সারে নাই। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা করি। পরে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু আমগো ১৯ জনরে পাঠায় জার্মানিতে। এহন হাঁটতে পারি। কষ্ট হয়। পাটা ভাজ করতে পারি না। একটা লাঠি রাখি সব সময়। পা চার ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে। ব্যথা হয় অনেক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কষ্ট থাকব।

“কিছু না হইলেই মানুষ এহন দেশ নিয়া কত কথা কয়। বিরক্তও হয়। কই আমরা তো বিরক্ত হই না। দেশটা তো এমনি এমনি হয় নাই। রক্ত দিছি স্বাধীনতার জন্য। ভাতা খাওয়ার জন্য তো না। সমস্যা থাকবই। তবু দেখবেন এ দেশ একদিন সোনার দেশও হইব। আমরা হয়তো দেইখা যাইতে পারমু না।’

মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলীর অনুকূলে ১৯৭২ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সরকারিপত্র

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সে দেশে কি পেয়েছেন?

মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার বলেন: “মানচিত্র পাইছি। ওটাই অনেক বড়। তবে স্বপ্নের দেশ পাই নাই। আমগো তো স্বভাবটাই পাল্টায় নাই। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি চলছেই। লেখা আছে: ‘এখানে প্রসাব করিবেন না।’

“অথচ ওখানেই দেখা যায় পায়খানা করতেছে। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি লেগেই আছে। এটা তো চাই নাই।”

সেকেন্দার আলী মনে করেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার উপযুক্ত সময় ছিল স্বাধীনতা লাভের পরপরই। ৪৬ বছর পরেও তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়াকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কলঙ্কজনক বলে মনে করেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তাঁর হাত ধরেই পুনর্বাসিত হয় রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীরা। লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে। সে সময়কার কথা অকপটে তুলে ধরেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

“তহন তো আমরা ভাবছিলাম বাঁচব না। আমগো মারি ফেলবে। ভয় লাগত। পরিচিত অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ও দেয় নাই। অনেকেই কাগজপত্র ফেলে দিছিল। জীবন তো আগে বাঁচাতে হবে। জিয়াউর রহমান তহন মুক্তিযোদ্ধাগো শক্রু মনে করতেন। তাঁর পরম বন্ধু ছিল রাজাকাররা। এহনও তাঁর দল তাগো ছাড়া চলতে পারে না।”

জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গ আসতেই উত্তেজিত হন এই যোদ্ধা। বলেন: “স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলা জমা নেওয়া হইছে। কিন্তু রাজাকারের অস্ত্রগুলো কে জমা নিল? ওই অস্ত্র কোথায়? খুনখারাবি কারা শুরু করছে খোঁজ করেন। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের পেছনে আছে জামায়াত-শিবির। গোড়া একটাই। ডালপালা অনেক। হেফাজত বলেন আর জঙ্গিবাদ বলেন, শক্রু কখনও বন্ধু হয় না। সে সুযোগ পাইলেই কামড় দিব।’

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শেখ হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলী অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:

“আমি তো মূর্খ মানুষ। নিজের মতো বুঝি সব। সরকারের ভুল থাকবই। কাজ করলেই ভুল হইব। ভুল হলেই তাকে সরাতে হবে এটা তো ঠিক না। আবার সরকারেরও ভুল স্বীকার করতে হইব। ভুল ধরলেই সে শক্রু হয় না।

“শেখ হাসিনা একা তো প্রত্যেক চেয়ারে চেয়ারে গিয়া বসতে পারব না। এ দিক নজর দিলে ও দিকে চুরি করে। কঠোর আইন করা উচিত। দলের খারাপ লোকদেরও বিচার করতে হইব। আবার বিচারটাও দ্রুত করা উচিত।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলী

“২০ বছরে একটা রায় দিলে মানুষের আস্থার জায়গাটা আর থাকব না। দেশের মানুষরেও নীতিবান হইতে হইব। দলের নেতারা স্বার্থ চায়। কয়জন শেখ হাসিনার মতো সৎ হইতে চায়? নিজেগোও বদলাইতে হইব আগে। নিজেরা বদলাইলেই দেশ বদলাইব। রাজনীতিবিদরা কি সব মুখে তুইলা দিব?”

কী করলে দেশ আরও এগোবে?

“দুর্নীতিবাজদের টার্গেট করতে হবে। সে যে দলেরই হোক। ভালো লোককে যোগ্য জায়গা দিতে হবে। সৎ লোকের প্রয়োজন। সৎ লোক না হলে দেশ এগোবে না।”

কিন্তু সমাজে কি সৎ লোকের কদর আছে?

মুচকি হেসে মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দারের উত্তর: “অবশ্যই আছে। খোঁজ নিয়ে দেখবেন একজন অসৎ আর দুর্নীতিবাজ লোকও একজন সৎ লোক খোঁজে। যার কাছে সে তার অবৈধ সম্পত্তি বা টাকা রাখতে পারে। পরে চাইলেই যেন সে সব দিয়ে দেয়। সৎ লোকের প্রয়োজন সমাজে সব সময়ই থাকব।”

দেশের নানা সমস্যা উপড়ে ফেলে এ দেশটাকে নতুন আলোয় ভরিয়ে দেবে পরবর্তী প্রজন্ম। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলীর। বুকভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য তিনি শুধু বললেন:

“তোমরা ন্যায়, নিষ্ঠা আর সততা নিয়ে চলবে। দেশের আত্মত্যাগের ইতিহাসটা জানবে ও ছড়িয়ে দিবে। তাহলেই তোমরা এগিয়ে যাবে।”

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকেন্দার আলীর কথা শুনতে :

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : ২৬ জুলাই ২০১৭

বই সংবাদ:

rokto makha juddo kotha
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

 এই লেখাটিসহ আরও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসীক কাহিনি নিয়ে সময় প্রকাশন ‘১৯৭১: রক্তমাখা যুদ্ধকথা’ নামক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি আকরগ্রন্থ প্রকাশ করছে। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় গ্রন্থটি পাওয়া যাবে সময় প্রকাশনের স্টলে।

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button