আদিবাসী

হাজং গাঁওয়ে প্যাক খেলা

সাধারণত  রোয়া (ধান গাছের চারা) লাগানোর সময় গ্রামের মোড়ল বা যাদের সামর্থ্য আছে তারা এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এটি হাজংদের একটি আদি উৎসব। একটি জমি ফাঁকা রেখে গ্রামের মোড়ল তার সব জমির রোয়া লাগানো শেষ করে। অতঃপর তিনি গ্রামের সবাইকে ডেকে আনতে নির্দেশ করেন চাকোরাকে (গ্রাম সমাজের একটি পদ)। সবাই উপস্থিত হলে ঠিক হয় একটি তারিখ। মোড়ল সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘আমার জমির শেষ রোয়া ওইদিন হবে। সবাই আসবেন।’

ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি। আকাশে চলছে রোদ-মেঘের খেলা। এরই মধ্যে আমরা পা রাখি উত্তর লেংগুরা গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট একটি নদী। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীর দুই তীরেই মানুষের জটলা। সবাই ব্যস্ত পাথর তোলায়। নদীর জলে শরীর ডুবিয়ে বাঁশের টুকরি ভরে দিচ্ছে নারী শ্রমিকরা। তাদের মাঝে কয়েকজন আদিবাসীও নজরে এলো। বাঙালিদের সঙ্গে এক হয়েই কাজ করছে তারা। এখানকার হাট-বাজারেও রয়েছে আদিবাসী-বাঙালিরদের সহঅবস্থান। অন্য অঞ্চলে যা ততটা দেখা যায় না। লেংগুরা নেত্রকোনার একটি আদিবাসী গ্রাম। নিজেদের আদি রীতিনীতি মেনে এখানেই বসবাস করছে প্রায় ৭০টি হাজং পরিবার।

নদী পাড়ে একটি হাজং বাড়ি। বাড়ির ভেতর চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। আবাল-বৃদ্ধ সবাই ব্যস্ত। কেটে আনা ধান কেউ শুকিয়ে তা থেকে ধান ছাড়িয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ, কেউ আবার ধান থেকে চাল তৈরি করে নিচ্ছে। কাজ থামিয়ে বাড়ির কর্তা দেবেন্দ্র হাজং আমাদের বসতে দেন। পরিচয় শেষে আলাপ জমাই হাজংদের নানা বিষয় নিয়ে।

সুদূর অতীত থেকেই মাটির সঙ্গে সখ্য এদের। গারো ভাষায় ‘হা’ মানে মাটি, ‘জং’ মানে পোকা বা কীট। এদের কৃষি কাজের কৌশল দেখেই গারোরা তাদের নাম দিয়েছিল হাজং।

এ বিষয়ে হাজংরা বলেন, ‘গারো গিলা আমলা নাম থুছে হাজং’ অর্থাৎ গারোরা আমাদের নাম রেখেছে হাজং। আবার অনেকেরই ধারণা প্রাচীন আসামের কামাখ্যা এলাকার কোচ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘হাজো’ বা ‘হাজু’-এর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের হাজো নগরের বাসিন্দা ছিল বলেই কালক্রমে স্থানীয় লোকদের কাছে তারা হাজং নামে পরিচিতি লাভ করে।

তবে হাজংদের ভাষ্য মতে, হাজং শব্দের অর্থ প্রস্তুত হই, সজ্জিত হই, সংগঠিত হই। এরা মনে করে, অতীতে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে আবার সংগঠিত হয়েছে। আর এই অবস্থার কারণেই হাজং নামের উৎপত্তি।

হাজংদের নিজস্ব ভাষা আছে। পরিবার এবং নিজেদের মধ্যে তারা নিজ ভাষায় কথা বলে। তবে হাজং ভাষার কোনো লিখিত বর্ণমালা নেই। বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা থেকে অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে হাজং ভাষাতে। দেবেন্দ্র আমাদের বুঝিয়ে দেন তাঁদের ভাষাটিকে। কারো নাম জানতে হাজং ভাষায় বলে-‘তোলা কি নামে?’ ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বাক্যটিকে হাজংরা বলেন- ‘ময় তগে ভালবাচে’, কোথায় বাঁশি বাজে- বাক্যটিকে বলে- ‘কুমায় বাঁশি বাজে’ প্রভৃতি। হাজংদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, নান্দনিক রূপ এবং বিচিত্র ভাবনা প্রকাশ পায় তাদের ভাষাতে।

দেবেন্দ্রের মুখে শুনি হাজংদের সমাজ কাঠামোর কথা। অন্য আদিবাসীদের মতোই এরাও একেক জায়গায় পাড়া করে বাস করে। পাড়াপ্রধানকে এরা বলে ‘গাওবুড়া’। তিনিই পাড়ার বিচার সালিশীসহ নানা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কয়েকটি পাড়া মিলে হাজংদের একটি গ্রাম হয়। গ্রামপ্রধানকে এরা বলে ‘মোড়ল’। গাওবুড়াদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বিচক্ষণ তাকেই হাজংরা মোড়ল বানায়। মোড়ল গাওবুড়াদের সহযোগিতায় গ্রামের নানা সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এভাবে কয়েকটি গ্রাম মিলে হয় একটি চাকলা বা জোয়ার। এর প্রধানকে বলে চাকলাদার বা জোয়ারদার। মোড়লদের মধ্য থেকে একজনকে এ পদে মনোনীত করা হয়। আবার কয়েকটি চাকলা বা জোয়ারের সমন্বয়ে হয় একটি পরগণা। পরগণার সর্বময় কর্তা রাজা।হাজং সমাজে গাওবুড়া ও মোড়লের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের মর্যাদা ও ক্ষমতাও বেশি। হাজংপাড়া বা  গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা গাওবুড়া ও মোড়লদের বিচক্ষণতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে।

কুলা দিয়ে আপন মনে ধান ঝাড়ছেন এক নারী। বয়স ষাটের ওপর। নাম রুবিলা হাজং। দেবেন্দ্রর বোন তিনি। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই তিনি মুচকি হাসেন। বাড়ির এককোণে ছোট্ট একটি প্রার্থনা ঘর। মাটির তৈরি ধুপের ঘটি ও প্রদীপ পড়ে আছে। সেখানে সামান্য একটু জায়গা উঁচু করে মাটি লেপা। কি এটি? প্রশ্ন করতেই রুবিলা বলে, ‘হরিমন্দির’। তার ভাষায়, ‘প্রতিদিন আমরা ধুপ, কলা, ফুল দিয়ে হরির নামে ভক্তি দেই।’ এ ছাড়া হাজংরা কড্ডা পূজা, শিব পূজা পালন করে থাকে।’ ধর্মের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘আমরা সনাতন ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্মের বর্ণ এবং সূর্য বংশীয় ব্রাহ্ম ক্ষক্রীয়। দিওলি আমাদের প্রধান উৎসব।’

বড় একটি মাঠ পেরিয়ে এপারে নরেশ হাজংয়ের বাড়ি। তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে দেবেন্দ্রর মেয়ে স্বপ্না হাজংয়ের। নিজের কাজের অবসরে নরেশ গড়ে তুলেছেন একটি গানের দল। তাই হাজংদের উৎসবগুলোতে আশপাশ থেকে ডাক পড়ে নরেশের। তার মুখেই শুনি হাজংদের ভিন্ন ধরনের একটি উৎসবের কথা। হাজংরা এটিকে বলে ‘প্যাক খেলা’। সাধারণত  রোয়া (ধান গাছের চারা) লাগানোর সময় গ্রামের মোড়ল বা যাদের সামর্থ্য আছে তারা এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এটি হাজংদের একটি আদি উৎসব।

হাজংরা জমিতে রোয়া লাগায় ভাদ্র মাসে। একটি জমি ফাঁকা রেখে গ্রামের মোড়ল তার সব জমির রোয়া লাগানো শেষ করে। অতঃপর তিনি গ্রামের সবাইকে ডেকে আনতে নির্দেশ করেন চাকোরাকে (গ্রাম সমাজের একটি পদ)। সবাই উপস্থিত হলে ঠিক হয় একটি তারিখ। মোড়ল সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘আমার জমির শেষ রোয়া ওইদিন হবে। সবাই আসবেন।’ সাধারণত প্রতিঘর থেকে একজন নারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কখনো কখনো  পুরুষ ও শিশুরাও অংশ নেয় এ আনন্দ উৎসবে। পুরুষেরা জালা ভাঙ্গে (বীজতলা থেকে চারা তোলা) আর হাল বায়। আর মেয়েরা রোয়া লাগায়। ওইদিন জমির এক দিক রোয়া লাগালে অন্যপাশে সবাই গোল হয়ে নাচ-গানে মেতে ওঠে। নারীরা তখন গান গাইতে গাইতে একে অপরকে প্যাক কাদা মাখিয়ে দেয়। এ সময় হাজংরা গান গায়। স্বপ্নার কণ্ঠে শুনি প্যাক খেলার গানটি :

‘আয়ও বুইনি হুমাস গৌলী রোয়া লাগা যাব
এরল গুলা শেষ রুয়া পেক্ খেলাব…
জয় জখা দিয়া গুছি হারিকে লাগাব
কাসসো মাসাং বিশিবাত রোয়া শেষে খাওয়া
চেরাং গাবুর সাওয়ায় সুতাই খাবাগে ভুরিব
মরল—
জালা ভাঙ্গা নাই জালা জাচ্ছে আনিব
আয় হুমাস বুইনী আমরা কুরা খেলাব
ন্ডরাহুরি লুরালুরি, কাদংনি পুরিব
মুঠি মুঠি পেক নিয়া মরলাগে হাজাব
মদে ভাতে আরো কতই আমোদে খাওয়াব
মরল—

(ভাবার্থ : আয় বোনেরা, ভাইরা, আজ মোড়লের শেষ রোয়া, চল সবাই যাই। উলু ধ্বনি দিয়ে সবাই রোয়া লাগাবে। রোয়া শেষে বিন্নিধানের ভাত দিয়ে কাছিমের মাংস খাব।)

নরেশ বলেন, প্যাক খেলার গানকে হাজংরা বলে গুপনি গান। এদের প্যাক খেলার নাচও অন্য উৎসব থেকে ভিন্ন। সকালে শুরু হয়ে প্যাক খেলা শেষ হয় বিকেলে। এ সময় উলু ধ্বনি দিয়ে হাজং নারীরা রোয়া লাগায় এবং সবাই সবার শরীরে প্যাক মেখে দেয়। এভাবে গ্রামের সবাই মিলে মোড়লের শেষ জমিটিতে রোয়া লাগানো শেষ করে। খেলা শেষে দুটি হাড়িতে জমির প্যাক তোলা হয়। অতঃপর মোড়ল ও তার স্ত্রীকে বাড়ির উঠানে বসিয়ে সারা শরীরে প্যাক ঢেলে দেওয়া হয়। এরপরই মোড়ল সবাইকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। গোসল সেরে সবাই খেতে আসে মোড়লের বাড়িতে।

এ উৎসবে খাওয়ানো হয় বিন্নি ধানের ভাত, কাছিম (কাচ্ছোয়া) বা মাছ ও ডাল। আটা ও চাউলের গুঁড়া দিয়ে তৈরি কাসা মদ উৎসবের আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেয়। প্যাক খেলার নাচ-গানে হাজংরা খোল, ধাপা করতাল, জরি (মন্দিরা) প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও আনন্দ করাই এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে হাজংদের দলবদ্ধতারও প্রমাণ মেলে।

এ দেশে বসবাসরত ভিন্ন জাতির মানুষদের সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও হাজংরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তারা আদিবাসী। দেবেন্দ্রের ভাষায়, ‘দাদার আমলে এখানে জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি করে হাজংরা। তখন ছিল না কোনো বাঙালি। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, আচার ও সংস্কৃতি। টংক ও হাতিখেদা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুক্ত ছিল হাজংরা।’

এ অঞ্চলের গারোরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও হাজংদের বেশির ভাগই তাদের পূর্বপুরুষদের জাতধর্মকে আগলে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে হাজং নেতা মতিলাল হাজং বলেন- ‘হাজংরা নিজের ধর্মের বিষয়ে কট্টর। এরা অন্য ধর্মকে সহজভাবে নিতে পারে না। সুবিধা লাভ তাদের কাছে বড় বিষয় নয়। ফলে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব এরা বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। দুর্গাপুরের শংকরা, আরাপাড়া, খুজিপাড়া গ্রামের দন্তধর হাজং, মুহু হাজং, রমেন্দ্র হাজং, ভবসিন্দুর হাজংয়ের মতো কিছু হাজং ধর্মান্তরিত হলেও তারা আবারও ফিরে এসেছে হাজংদের আদি ধর্মে।’

কয়েক বছর আগে লেংগুরা গ্রামের মোড়ল লিলি হাজং প্যাক খেলার আয়োজন করলেও ধীরে ধীরে প্যাক খেলা হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী সমাজ থেকে। হাজংরা মনে করেন জমি কমে যাওয়া, জমি বর্গা দিয়ে দেওয়া, হাজংদের পেশার পরিবর্তন,  নিমন্ত্রণ খরচ বেশি হওয়া ও আয় কমে হওয়াই  এর মূল কারণ। কিন্তু তবুও এ প্রজন্মের হাজংরা চায় তাদের আদি উৎসবগুলো টিকে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ জুন ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button