মুক্তিযুদ্ধ

রাজাকারদের উত্থান দেখে ভাবিনি বিচার হবে

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাউড়া থেকে আমাদের ডিফেন্স গাড়ি লালমনিরহাট বড়খাতা রেল স্টেশনের কাছাকাছি এসেছে। সেখানে ছিল পঁচিশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শক্তিশালী ঘাঁটি। আমরা পাকিস্তানিদের ওই ঘাঁটি দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করি।

সূর্য তখন হেলে পড়েছে। আমরাও সশস্ত্র অবস্থায় অগ্রসর হই। মেশিনগান, টমি গান, এসএলআর, টুইঞ্চ মটর প্রভৃতি আমাদের অস্ত্র। কমান্ডে ছিলেন ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। তবে আমাদের গ্রুপকে কমান্ড করতেন ক্যাপ্টেন মতি। ইন্ডিয়ান আর্মিও আমাদের পেছনটায়। তারা আর্টিলারি সার্পোট দিলেই আমরা সামনে এগোই।
পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আর্টিলারি ছোড়ে। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। তা চলে ভোর চারটা পর্যন্ত। আমার কাছে একটি এসএলআর। পাশেই ববিন, তুতুল ও সুবেদার ফজলুর রহমান। ক্রলিং করে সবাই সামনে এগোই। থেমে থেমেই গোলাগুলি চলছে। সুযোগের অপেক্ষায় আমরা ওত পেতে রই।
ওদের বাঙ্কারের কাছাকাছি ছিল একটি বাঁশঝাড়। আমাদের থেকে মাত্র ৭ শ গজ সামনে। সেখানটায় যেতে পারলেই ওদের কুপোকাত করা যাবে। এই ভেবে সে দিকটায় আমি পা বাড়াই। কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটতে পারে! মনেপ্রাণে শুধু একই চিন্তা, দেশকে শক্রমুক্ত করব।
পায়ের দিকে তাকাতে আঁতকে উঠি, গোড়ালি উড়ে গেছে, চামড়ার আবরণ নেই, হাড্ডি গুঁড়ো হয়েছে, রগগুলো ঝুলছে গাছের শিকড়ের মতো
বাঁশঝাড়ের ভেতর পা রাখতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ছিটকে পড়ি। হালকা ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। বুঝে যাই এম ফোরটিন মাইনের বিস্ফোরণে পড়েছি। ডান পা তখন নাড়াতে পারছিলাম না। পায়ের দিকে চোখ পড়তে আঁতকে উঠি। গোড়ালি উড়ে গেছে। চামড়ার আবরণ নেই। হাড্ডি গুঁড়ো হয়ে ঝরছে। রগগুলো ঝুলছে গাছের শিকড়ের মতো। শরীরটা শুধু ঝিমঝিম করছিল। আমি তখনও জ্ঞান হারাইনি। পড়ে আছি আইলের ভেতর। গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিই পা।
আমায় দেখে এগিয়ে আসে সহযোদ্ধারা। ক্রলিং করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাছে আসে তুতুল ও ববিন। এ সময় কাভারিং ফায়ার দেয় ফজলুর রহমান। তারা আমায় কাঁধে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে।
আমার অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পা ছাড়াও শরীর ও মুখে লেগেছিল অসংখ্য স্প্রিন্টার। চিকিৎসার জন্য ক্যাম্প থেকে তাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বাকডোকরা সিএমএইচ-এ। সেখানেই প্রথম অপারেশন হয়। পরে গ্যাংগ্রিন হয়ে পায়ের মাংসে পচন ধরে। ফলে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমাকে পাঠানো হয় ব্যারাকপুর, রাঁচি, নামকুম, খিরকি ও পুনা হাসপাতালে। অপারেশন হয় আরও ছয়বার।
দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমরা পুনা হাসপাতালে। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন! নার্সরা আমাদের ফুল দিয়ে সম্মান জানায়। উল্লাস করে মুখে আবির মাখিয়ে দেয়। স্পেশাল খাবারও দেওয়া হয় আমাদের। হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন মেজর মাথুর।
আমার পিঠ চাপড়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘তোমারা দেশ তো স্বাধীন হওয়া। আব তুম চালা যাওগে।’’
তার কথা শুনে খুব দেশে ফিরতে ইচ্ছে করছিল। মায়ের কথা খুব মনে হচ্ছিল। কিন্তু কৃত্রিম পা লাগিয়ে তবেই আমাদের দেশে পাঠানো হবে।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার

৫ জানুয়ারি, ১৯৭২। পুনা হাসপাতালেই আমাদের দেখতে আসেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। আমি বসেছিলাম মেঝেতে। সেদিন আমাদের উৎসাহ দিয়ে তিনি বললেন– ‘‘চিন্তা কর না, পা লাগিয়ে দিলে আবার তোমরা চলতে পারবে। দেশে ফিরলে তোমরা বীরের সম্মান পাবে। তোমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন তোমাদের মাঝে।’’
ভারতের সাহায্যের জন্য সেদিন আমরাও তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ইন্দিরার সঙ্গে সেদিনকার একটি ছবি আমার হাতে তুলে দেন সে সময়কার কমান্ড ইনচার্জ ডা. টিডি দাস। অনেকদিন ভেবেছি ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে জমা দেব। কিন্তু দেওয়া হয়নি। ছবিটির দিকে তাকালে আজও সব জীবন্ত হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধে পা-হারানোর কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার।
তার বাড়ি নীলফামারী জেলার শাহীপাড়া গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতেই। বাবা ডা. জি এম কাদের ছিলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের লেকচার অব ফরেনসিক মেডিসিনের প্রফেসর। মা সৈয়দা আক্তার মহল সাধারণ গৃহিনী। পাঁচ ভাই দু’বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। ম্যাট্রিক পাস করেন ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পরে ভর্তি হন নীলফামারী মহাবিদ্যালয়ে। একাত্তরে তিনি ছিলেন ওই কলেজেরই এইচএসসি পরিক্ষার্থী। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন শৈশব ও কৈশোরের কিছু কথা।
পুনা হাসপাতালেই আমাদের দেখতে আসেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
তাঁর ভাষায়, ‘‘আমাদের স্কুল ছিল এক মাইল দূরে। বন্ধু রাজা মিয়া, শফিকুল, বাবলু, হাশেমসহ দলবেঁধে আমরা স্কাউট করতাম। ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ছিল আমার নামডাক। হায়ারেও খেলতে যেতাম। এসএসসির সময় আধকপালির মাথাব্যথায় অংক পরীক্ষা হয় খারাপ। ফলে ছয় মার্কসের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন পাইনি। রেজাল্ট শুনে বাবার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তাঁর ইচ্ছে ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবেন।’’
দেশের বৈষম্যের কথা উঠতেই মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানেই উৎপন্ন হত পাট, চা, তামাক ও চামড়া। সেগুলো বিদেশে বিক্রি হলে টাকা চলে যেত করাচিতে। সে টাকায় ডেভলপ করা হত পশ্চিম পাকিস্তানকে। পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নকাজ হত খুব কম। সেনাবাহিনীর অফিসার, সরকারের বড় বড় পদে বাঙালিদের নেওয়া হত না। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপে। বাউলাদা ও মমিনুল ইসলাম ছিলেন নেতা। বৈষম্যের প্রতিবাদে মিছিল বের হত। ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, সংবাদ পত্রিকা এবং বিবিসির মাধ্যমে আমরা পেতাম দেশের খবরগুলো।
সত্তরের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু একবার আসেন নীলফামারীতে। ভাষণ দেন নীলফামারী মাঠে। বঙ্গবন্ধুকে সেবারই সরাসরি দেখেন জুলফিকার। সেদিনের অনুভূতির কথা শুনি তাঁর জবানিতে। তাঁর ভাষায়, ‘‘বঙ্গবন্ধুকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম মঞ্চের কাছে। তিনি মঞ্চে ওঠার আগে আমাদের সঙ্গে হাত মেলান। তাঁর ব্যবহারে মনে হয়েছিল আমরা তাঁর অনেক দিনের চেনা। বললেন, ‘কেমন আছিস তোরা? লেখাপড়া কিন্তু ঠিকভাবে করিস।’ বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার কথা মনে গেঁথে গেল। সে থেকে তিনিই ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা।’’
জুলফিকারের ছোট চাচা জি এম রাজ্জাক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের আর্ট ডাইরেক্টর। থাকতেন ঢাকার নারিন্দায়। মার্চের শুরুতেই তিনি বেড়াতে যান চাচার বাড়িতে। ফলে ৭ মার্চে ছুটে আসেন রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি।
জুলফিকার বলেন, ‘‘সবার শেষে ভাষণ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম..।’ এমন নির্দেশই যেন সবাই চাচ্ছিল। এটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান। বঙ্গবন্ধু আরও পরিস্কার করে বললেন, ‘বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ ভাষণ শুনে আমরা পুরোপুরি বুঝে যাই সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা মিলবে না। ‘
আপনারা তখন কী করলেন?
‘‘নীলফামারী ফিরে শুনি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছে গোবিন্দদা ও ইয়াকুব আলীর নেতৃত্বে। ছাত্র ও যুবক বয়সীদের বাঁশ ও লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করানো হলো নীলফামারী মাঠে। সৈয়দপুরে ছিল লক্ষাধিক অবাঙালি। তাদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘর্ষের খবর পেতাম প্রতিদিনই। ২৪ মার্চ রাতে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনাদের ওপর চড়াও হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ফলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বেরিয়ে আসে ব্যারাক থেকে। তারা প্রতিরোধ গড়ে দশমাইল নামক স্থানে।
২৫ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ডোমার থেকে ইপিআরে বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্রসহ চলে আসে নীলফামারীতে। সেখানে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আনসার, ছাত্র, যুবক ও অন্যান্যরা। ২৭ মার্চের পরে সবাই মিলে আমরাও প্রতিরোধ গড়ি নীলফামারীর দাড়োয়ানি নামক স্থানে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারির আঘাতে আমরা দুদিনও টিকতে পারি না। ফলে যে যার মতো আত্মগোপন করে। আমরা চলে আসি সীমান্তবর্তী ডোমারে।’’
ট্রেনিংয়ের কথা উঠতেই মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘আবদুর রউফ ছিলেন ডোমারের আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি চলে যান ভারতের কুচবিহার জেলার দেওয়ানগঞ্জে। সেখানে কংগ্রেস সদস্য ছিলেন বিরু বাবু। তার সহযোগিতায় তিনি গড়ে তোলেন একটি রিক্রুটিং ক্যাম্প।
এপ্রিলের ৩ তারিখ। তুতুল, শফিকুল, মান্নান, ববিন, মুক্তা, মানিক, ইলিয়াসসহ আমরা ৩৫ জন সীমান্ত পার হয়ে চলে আসি দেওয়ানগঞ্জ রিক্রুটিং ক্যাম্পে। দুদিন পর চালসা সাব ডিভিশন ধুবগুড়ি রোড হয়ে মেটেলি থানা তাপুরহাট চা বাগান হয়ে শিবুক ব্রিজ পার হয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের উইংটং নামক স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাদের। সেখানে সেনাবাহিনীর একটা পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ২৮ দিন ট্রেনিং নিই আমরা। আমি ছিলাম আলফা কোম্পানিতে। শেখ কামালও এই ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন। পরে আমাদের কয়েকজনকে ডেমুলেশনের ওপর স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনারা আমাদের সাহস দিতেন। ওস্তাদ হাবিলদার প্যাটেলের কথা আজও মনে পড়ে।’’
কোথায় কোথায় যুদ্ধ করলেন?
জুলফিকারের উত্তর, ‘‘১১ জন ছিল একটি সেকশনে। ৪০-৪৫ জন করে একটি কোম্পানি। দুটি কোম্পানি এক হয়ে কোর্টগজ নামক স্থানে আমরা তাঁবু গাড়ি। ওখান থেকে মিরগর এলাকায় ঢুকে হিট করে আবার ফিরে আসতাম। সেপ্টেম্বর থেকে আমরা যুক্ত হই সম্মুখ সমরে। ৬নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করি মিরপুর, কোটগজ, তেঁতুলিয়া, বাউড়া, বুড়িমারা, বড়খাতা প্রভৃতি এলাকায়।’’
তেতাল্লিশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্ক কমেনি। অনেক অমুক্তিযোদ্ধার হাতেও চলে এসেছে মুক্তিযোদ্ধার কাগুজে সনদ। মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকারের কাছে প্রশ্ন ছিল, কেন এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ে?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘তালিকা বাড়ে রাজনৈতিক কারণে। তবে এর জন্য দায়ী গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধাও। তাদের লোভে বির্তকিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সরকারের সুবিধা লাভের আশায় তাদের হাত ধরেই অমুক্তিযোদ্ধারা সনদ পেয়েছে। তবে এ তালিকা চূড়ান্ত করার উপযুক্ত সময় ছিল বাহাত্তর সাল। তখন সকল সেক্টর কমান্ডারের কাছেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিল।’’
মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথা শুনতে হয়েছে, আমি নিজেই মসজিদ কমিটির সভাপতি, আমি কি মুসলমান না
কথা ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের ভূমিকা ও কার্যক্রম নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রত্যক্ষ একটি ঘটনার কথা। তাঁর ভাষায়–
‘‘মিরগর এলাকার ভেতরের দিকে ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি সেনাদের। তাদের চারপাশে প্রায় ৩ মাইল এলাকা ছিল রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে। একবার রেকি করতে ওই এলাকায় যায় আমাদের কোম্পানি কমান্ডার আইয়ুব ও টোআইসি নুরুল। অস্ত্র হিসেবে তাদের সঙ্গে ছিল মাত্র দুটি গ্রেনেড। গ্রামের ভেতর ঢুকতেই রাজাকাররা টের পেয়ে যায়। ওত পেতে তারা তাদের ধরে ফেলে। খবর চলে যায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। ওইদিন রাজাকাররা তাদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। তাদের উদ্ধার করতে পরদিনই আমরা গ্রামটিতে আক্রমণ চালাই। আইয়ুব ও নুরুলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ মিলে একটি আখ খেতের পাশে, আখ জাল দেওয়ার গুড়ের কড়াইয়ে। গ্রেনেডের আঘাতে তাদের চেহারা বিকৃত করে ফেলেছিল তারা। সহযোদ্ধার এমন মৃত্যুতে আমরা হতবিহবল হয়ে পরি। খবর পেয়ে পাশের গ্রাম থেকে ধরে আনি এক রাজাকারকে। পরে তাকে গুলি করে আমরা ফেলে দিই চাওই নদীতে।’’

স্বাধীনের পর রাজাকারদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও ছোট ছোট অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তিনি বলেন–
‘‘বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা ছিলেন। তাঁর ডাকেই যুদ্ধ করেছি, তবুও বলব, তাঁর ওই সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না। আমরা তো আক্রান্ত হয়েছি ছোট ছোট রাজাকারদের দ্বারাই। তাই তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল।’’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন জিয়াউর রহমান। বাতিল হয় দালাল আইনটিও। ফলে বিচারের পরিবর্তে রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় প্রতিষ্ঠিত রাজাকাররা। সময়ের হাওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরাই বনে যায় স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী। একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেমন অনুভব করেছেন সে সময়?
দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘‘এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে হুল ফোটানোর মতো। বিষয়টি আমাকে কুড়ে কুড়ে খেত। ব্যথিত হতাম। রাজাকার আজিজকে বঙ্গভবনে আমরা মারতেও গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান এসে থামিয়েছেন। তাকে বলেছিলাম, ‘কেন রাজাকারকে মন্ত্রী বানালেন? ইতিহাস কলঙ্কিত করলেন?’ আমাদের প্রশ্নের উত্তর তিনি সেদিন দিতে পারেননি।’’
চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের আজ বিচার হচ্ছে, জাতি হচ্ছে কলঙ্কমুক্ত। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার বলেন, ‘‘এদের উত্থান দেখে কখনও ভাবিনি বিচার হবে। এখন হচ্ছে, এটাই আশার কথা। দেরিতে হলেও আমাদের বুকের ভেতর থেকে কষ্টের ভার একে একে নেমে যাচ্ছে। আমার অর্জিত রক্ত দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশে এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। দেশে আইন আছে, তা না হলে এদের তো গুলি করে মেরে ফেলা উচিত ছিল। এদের শাস্তি দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম।”
স্বাধীন দেশে ভালো লাগার কথা বলতে গিয়ে এই বীর বলেন, ‘পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। দেশটা চালাচ্ছে এদেশেরই লোকেরা। এটাই ভালো লাগে। আমরা তো এখন আর পরাধীন নই।’’
খারাপ লাগার কথা উঠতেই বলেন, ‘‘রাজনৈতিক উত্থান-পতনে দেশ যখন পিছিয়ে যায়। রাজনীতিবিদদের মাঝে যখন স্বার্থচিন্তা ও লোভ দেখি, তখন সত্যি কষ্ট পাই। দেশের কথা ভেবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশের জন্য সবাই মিলে কাজ করলে দেশটা অন্যরকম হত।’’
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চ জুলফিকারের কাছে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন প্রজন্মের জেগে ওঠা। তাঁর ভাষায়, ‘‘এই ছেলেরা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে সত্য সত্যই থাকে। দেরিতে হলেও সত্য একদিন জাগ্রত হয়, এটাই তার প্রমাণ। ভেবেছিলাম এদের বিচার হবে না। গণজাগরণ মঞ্চ আমাকে আশাবাদী করেছে। এখন আমি মইরা গেলেও এদেশে এদের বিচার হবে। বাংলাদেশ হবে স্বাধীনতার পক্ষের একটি দেশ।’’

ভিডিও: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকারের কথা শুনতে…..

একটি পক্ষ তো বলছে এটা নাস্তিকদের আন্দোলন?
প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘‘যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাদেরও তো তখন বলা হত ইসলামের শক্র। মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথাও আমাদের শুনতে হয়েছে। আমি নিজেই এক মসজিদ কমিটির সভাপতি। তাহলে আমি কি মুসলমান না! মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও আল্লাহু আল্লাহু বলেছি, গুলি খাইলে লা-ইলাহা-ইল্লালা বলেছি, সুরা কেরাত পরেছি, নামাজ পড়ছি। আমরাও মুসলমানের পেডে জন্ম নিছি। আমরাও মুসলমান। নিজেদের বাঁচাতে ওরা তো ইসলামকে বিকৃত করেছে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে ধর্মটাকে।’’
নতুন প্রজন্ম এক সময় দেশটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকারের। পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘তোমরা নিজের দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি যেনে নিও। পূর্বসূরীরা যে ভুল করেছে তোমরা তা কর না। ততটা উন্নত নই আমরা, তবু এ দেশটাই আমার মা। তাকে মায়ের মতোই ভালোবেস।’’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমে,  এপ্রিল ২৩, ২০১৪

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button