মুক্তিযুদ্ধ

শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি বঙ্গবন্ধু

২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত ৯টা। জহিরুল হক মাঠ থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরেছি বাসায়। পেটে প্রচ- ক্ষিধে। মা খাইয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ নাম ধরে ডাকে বন্ধুরা। জিন্না, কাইয়ুম, নয়নসহ ছিল ১৪ জনের মতো। খাবার ফেলেই তখন বেরিয়ে পড়ি।
জহিরুল হক হলের পাশে ছিল লং টেনিস খেলার মাঠ। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তোফায়েল আহমেদ, রাজ্জাক ভাই, চার নেতাসহ আরো কয়েকজন। নির্দেশ দিলেন গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়তে। আজিমপুর মোড়ের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।

রাত তখন সোয়া বারটা। বিডিআর গেটের দিক থেকে গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। ক্রমেই তা এগিয়ে আসে। সে সময় রহমান নামে আমাদের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। আমি ও বাচ্চু ভাই তাকে এক বাড়িতে রেখে আত্মগোপন করি আজিমপুর কলোনিতে।
২৮ মার্চ ১৯৭১। কারফিউ ভাঙে ২ ঘণ্টার জন্য। সে সুযোগে সপরিবারে আমরা চলে আসি নওয়াবগঞ্জের জিঞ্জিরার আটি এলাকায়। করম আলী চাচার বাড়ি ওখানে। তিনি বাবার সঙ্গেই চাকরি করতেন। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর যাই ঢাকার সৈয়দপুরে এবং পরে নৌকা ভাড়া করে রওনা হই গ্রামের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জের দিকে।
ভারত থেকে আসা কুশিয়ারা নদীর তীরে বসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি আমরা কয়েকজন। কিন্তু সীমান্ত পার হতে লাগবে কিছু টাকা-পয়সা। টাকা পাই কোথায়? চাচাত ভাই আতোয়ার রহমান পঙ্খিসহ বুদ্ধি আঁটি ধান চুরির। একরাতে কয়েক মণ ধান চুরি করে বিক্রি করি হাটে। যা পাই তা নিয়ে ওইদিনই রওনা হই ভারতের উদ্দেশে।
৯ মে ১৯৭১। সুতারকান্দি বর্ডার পার হয়ে আমরা পৌঁছি ভারতের করিমগঞ্জ ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসি কলকনি ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পটির সামরিক ইনচার্জ ছিলেন মেজর ফাত্তার চৌধুরী। একদিন পরেই ক্যাম্পে আসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল বাকসি। ক্যাম্প থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ছেলেদের বাছাই করতেন তিনি। আমার স্বাস্থ্যটা বেশ খারাপ ছিল। তাই প্রথম ব্যাচে ট্রেনিংয়ের সুযোগ পেলাম না। বাকসি সাহেব বললেন, ‘তুমি যুদ্ধ করতে পারবা না। খেয়ে স্বাস্থ্য বানাও, পরের ব্যাচে তোমাকে নিব।’ শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবুও হাল ছাড়লাম না। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাচে বাছাইয়ের সময়ও ঘটল একই ঘটনা। বাকসি সাহেব এবারও বললেন, ‘ইয়ুথ ক্যাম্পের ফিল্ড ইনচার্জ বানিয়ে দিব তোমাকে। তুমি এখানেই থাক।’ এবার আমি ক্ষেপে গেলাম। বললাম, ‘এখানে বসে বসে খেতে আসিনি। গুলি ফোটাতে এসেছি। আমি তাহলে দেশে ফিরে যাই। মরতে হয় দেশে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতেই মরব।’
আমাদের ওখানকার তৎকালীন এমপি ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেব। আমার পক্ষে তিনি সুপারিশ করতেই বুকে পড়ল এফএফ নম্বর। ই-৬৯৬৩। পাঠিয়ে দেওয়া হয় ২৮ দিনের ট্রেনিংয়ে।
আমাদের ট্রেনিং হয় ভারতের লোহারবন্দে। বি কোম্পানির সিএইচএম ছিলাম আমি। ট্রেনিং শেষে আমাদের অস্ত্র দেওয়া হয় জালালপুর থেকে। ৪নং সেক্টরের সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল সেখানে।
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজির আহমদ চৌধুরীর মুখে। তার বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চারাবই গ্রামে। বাবা আবদুল গাফফার চোধুরী কাজ করতেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইডেন বিল্ডিং ডিভিশনে। বাবার চাকরির সুবাদে থাকতেন আজিমপুরের পলাশীতে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরিক্ষার্থী।
৭ মার্চ পলাশী থেকে মিছিল নিয়ে তিনিও যান রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চ থেকে মাত্র দুশ গজ দূরে বসে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু বললেন, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।…যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না।’ এই নির্দেশ কিন্তু পরে সবাই পালন করলেন। তিনি বললেন, ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব। ইনশাল্লাহ!’ এরপর স্বাধীনতার ঘোষণার আর কীইবা বাকি থাকে?
আপনারা এরপর কী করলেন?
মুক্তিযোদ্ধা নাজিরের উত্তর, ‘ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকেই বিকেলে বুয়েট মাঠে লেফট-রাইট এবং সন্ধ্যার পর জহিরুল হক মাঠে ডামি রাইফেল দিয়ে আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হত। সেটি চলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। ট্রেনিং করাতেন চিশতি ভাই। বটতলায় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানেও আমরা গার্ড অব অনার দিই।’
১৯৭১ সালে আটগ্রাম ডাকবাংলো অপারেশনের সময় পাকিস্তানিদের একটি গুলি নাজির আহমদের ডান চোখের পাতার নিচ দিয়ে ঢুকে নাকের হাড় ভেঙে বাম পাশের গাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় তার ডান চোখটি।

সেদিনের ঘটনাটি জানতে চাই আমরা। তিনি বলেন, ‘৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। আমরা ছিলাম জালালপুর হেড কোয়ার্টার্সে। অপারেশনটি নিয়ে সেখানে কয়েকদিন চলে ব্রিফিং। পাকিস্তানি সেনাদের একটি ডিফেন্স ছিল জকিগঞ্জের আটগ্রাম ডাকবাংলোতে। অন্যটি সড়কের বাজারে। ডাকবাংলো দখলে নিয়েই আমরা আক্রমণ চালাব সড়কের বাজারের ক্যাম্পে তেমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
সুরমা নদীর তীরে ছিল ডাকবাংলোটি। নদীর ওপারেই ভারত। তিনটি গ্রুপে আমরা ছিলাম ৭৬ জন। কমান্ডে আশরাফ ভাই। ভোর তিনটার দিকে আমরা ডাকবাংলোর কাছাকাছি অবস্থান নিই। ২৫ জনের একটি দল সুরমা নদীর ভারত অংশে অবস্থান নেয় কাভারিং ফায়ারের জন্য। দূর থেকে ডাকবাংলো ঘিরে অবস্থান নেয় আরও ২৫ জন। আমরা অবশিষ্ট ২৬ জন অ্যাডভান্স হই। কথা ছিল ৩টা থেকে ৩টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ভারত থেকে ডাকবাংলো লক্ষ্য করে আর্টিলারি ছোড়ার। কিন্তু আর্টিলারির লক্ষ্য সঠিক ছিল না। বেশি দিলে ডিফেন্স নষ্ট হয় আবার কম দিলে আমাদের ওপর পড়ে। সব আর্টিলারি এসে পড়ে মাঝামাঝিতে। পাকিস্তানি সেনারা তখন অ্যালাট হয়ে যায়। আমার কাছে ছিল একটি এসএলআর।
আর্টিলারি বন্ধ হতেই আশরাফ ভাই বললেন, ‘অ্যাডভান্স।’ ক্রলিং করে আমরা সামনে এগোই। বৃষ্টির মতো পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর গুলি ছুড়ছিল। বোঝার বাকি থাকে না আর্টিলারিতে তাদের ডিফেন্সের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবুও আমরা সামনে এগোই। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। গড়িয়ে আমরা ধানক্ষেতের আইল ধরে এগোই। ওদের পঞ্চাশ গজ ভেতরে আমরা ঢুকে পড়ি। আমার ডান পাশে ছিল হায়দার। হঠাৎ তার পেটে গুলি লাগে। নিমিষে রক্তে লাল হয়ে যায় আইলের পথটি। বাম পাশে তাকিয়ে দেখি মাথায় গুলি লেগেছে আরেকজনের। তার নিথর দেহটি পড়ে আছে মাটির ওপর।
আমি ক্রলিং করে হায়দারকে বাঁচাতে যাই। তার অস্ত্রটি নিয়ে তাকে পেছনে টানতে থাকি। হঠাৎ শোঁ করে একটি গুলি এসে লাগে আমার বাম চোখে। আমার মুখটা ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…’ পড়ি।
মুখ তুলতেই খেয়াল করলাম ডান চোখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। আশরাফ ভাই ছিলেন পেছনে। তার রানেও লেগেছে গুলি। ওই অবস্থায়ই আমাকে তিনি কাঁধে তুলে পেছনে নিয়ে যান।
সুরমা নদীতে নৌকা দিয়ে আমাকে নেওয়া হয় ক্যাম্পে। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি গোহাটি সামরিক হাসাপাতালে। পরে কম্বাইন্ড হাসপাতালে চোখের অপারেশন করে লিড রিপিয়ার করা হয়। গুলিটি আমার ডান চোখের পাতা ভেদ করে নাকের বন ভেঙে দেয়। ফলে এক চোখে আর দেখতে পাই না।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিতর্কিত হওয়া প্রসঙ্গে নাজির আহমদ বলেন, ‘একজন ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে দেখল দেশ স্বাধীন। স্বাধীন না হলে সে তো যুদ্ধ করত। যেহেতু সে ট্রেনিং করেছে, তাই তার নামটি জায়গা করে নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। আবার ট্রেনিং নিয়ে এসেও অনেকেই যুদ্ধ না করে বাড়িতে চলে গেছে, সেও আছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। এগুলোও স্বাধীনের পরেই যাচাই করে চূড়ান্ত করা যেত।’
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। বিচার প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ছোট ছোট অপরাধীদের বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন সত্য। ১৯৭১-এ অনেকেই জীবন বাঁচাতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে নাম লিখায়। কেউ কেউ গোপনে নানা সংবাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করত। তাই তাদের শাস্তি দিলে তো অন্যায় হত। কিন্তু ক্ষমার তালিকায় ছিল না কাদের মোল্লার মতো রাজাকারের নাম। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি বঙ্গবন্ধু।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দালাল আইন বাতিল করেন জিয়াউর রহমান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অথচ তিনিই পরে শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। তার দলের হাত ধরেই রাজাকারদের গাড়িতে ওড়েছে স্বাধীন দেশের পতাকা! তখন মনে হত বুকে ডিনামাইট বেঁধে ওদের গাড়ির নিচে গিয়ে পড়ি। পতাকার মান বাঁচাই।
স্বাধীন দেশে খারাপ লাগা অনুভূতির কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা নাজির আহমদ। তার ভাষায়, ‘চেয়েছিলাম স্বাধীন দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। কিন্তু পাইনি। দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এসব দেখলে বুকটা ফেটে যায়। খেলার মাঠে যখন এদেশের যুবকরা পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে তাদের পক্ষে উল্লাস করে তখন খুবই কষ্ট লাগে।’
ভাল লাগা অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন দেখি কিছু না হলেও পাকিস্তানিদের মতো কেউ আমাকে বাইনচোদ বলে গালি দিচ্ছে না, স্বাধীন দেশে আমি আমার মায়ের ভাষায় কথা বলছি তখন মনে শান্তি পাই। ভালো লাগে।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময়-এ, ১৯ মার্চ ২০১৪, বর্ষ ০১, সংখ্যা ১২

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button