আদিবাসী

গারো বিদ্রোহ ১:স্বাধীন গারোরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন ছপাতি গারো

গারো আদিবাসীরা মঙ্গোলয়েড নামক মূল মানবগোষ্ঠী শাখার অন্তর্ভুক্ত। এরা তিব্বত হতে এসে প্রথমে কোচবিহার অঞ্চলে বসতি গড়ে। পরে সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আসামের যোগীপাড়া অঞ্চলে এলে সেখান থেকেও তাদের বিতাড়িত করা হয়। ফলে তারা বসতি গাড়ে আসামের গৌহাটি অঞ্চলে। প্রথম দিকে ওই অঞ্চলে অহোম শাসকগণ গারোদের তাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু কিছুকাল পরেই একজন খাসি রাজা গারোদের মুক্ত করে দেন। মুক্তি পেয়ে গারোরা বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে ময়মনসিংহ জেলার উত্তরভাগে অবস্থিত বিস্তীর্ণ পাহাড় অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এ সময় সুসঙ্গসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল ছিল গারোদের নিয়ন্ত্রণে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগের কথা। সোমেশ্বর পাঠক নামের এক ব্যক্তি বহু অনুচর নিয়ে তৎকালীন প্রধান গারো সর্দার বৈশ্য গারোকে পরাজিত করে সুসঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ধীরে ধীরে গারো অঞ্চলটি বাংলাদেশের সুসঙ্গরাজ, আসামের কড়াইবাড়ী, মেচপাতা, গৌরীপুর, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি স্থানের জমিদারগণ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। তবে এ সময় সুসঙ্গ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলেই গারোদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।

সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক। ময়মনসিংহ জেলায় উত্তর ভাগে গারো পাহাড় অঞ্চলে ইংরেজদের শোষণ তখনো শুরু হয়নি। কিন্তু ওই অঞ্চলে কয়েক শতাব্দী ধরে সুসঙ্গরাজসহ অন্যান্য জমিদারগোষ্ঠী গারোদের ওপর নিষ্ঠুর শোষণ ও উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল। জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে একসময় গারোরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ওই অঞ্চলে বসবাসরত কোচ, হাজং প্রভৃতি আদিবাসীরাও সে সময় জমিদারগোষ্ঠীর উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে গারো-বিদ্রোহে যোগ দেয়।

তখন পার্বত্য অঞ্চলে গারোসহ অন্য অধিবাসীদের জীবিকার একমাত্র উপায় ছিল কৃষিকাজ। তারা ঝুম পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে ধান ও তুলা উৎপাদন করত। অতঃপর তা সমতলের বাজারে এনে তুলার বিনিময়ে সংগ্রহ করত লবণ, তেল ও অন্যান্য দ্রব্য।

সমতলের বাজারে এসে তারা জমিদার ও ব্যবসায়ীগণের শোষণ-উৎপীড়নের শিকার হতো। কেমন ছিল সে শোষণের মাত্রা?  ইংরেজ লেখক আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার অব বেঙলি’তে তা তুলে ধরেছেন এভাবে : মোগল শাসনকালে ব্রহ্মপুত্র নদ ও গারো পাহাড়ের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল দুর্ধর্ষ জমিদারগণের অধিকারভুক্ত ছিল। এই সকল জমিদার মোগল সম্রাটকে নামমাত্র কর প্রদান করে প্রায় স্বাধীনভাবে প্রজা-শোষণ করত। তারা প্রধান কর্তব্য মনে করত পার্বত্য অধিবাসীদের হাত থেকে সমতলের অধিবাসীদের ধন-সম্পদ রক্ষা করা। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকত পাহাড়ি অধিবাসীদের সঙ্গে ব্যবসা করে ধনবান হওয়া।

এই ব্যবসায়ের প্রধান দ্রব্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত তুলা। সামান্য পরিমাণ লবণ প্রভৃতির বিনিময়ে জমিদারগণ গারোদের কাছ থেকে কৌশলে বিপুল পরিমাণ তুলা কেড়ে নিত। এ ছাড়া তুলাসহ যে সকল দ্রব্য বিনিময়ের জন্য গারোগণ সমতল ভূমির বাজারে নিয়ে আসত, তার ওপর জমিদারগণ উচ্চহারে কর ধার্য করে দিত। গারোরা এ সকল উৎপীড়নের প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করলেই তাদের ওপর জমিদাররা নিষ্ঠুর উৎপীড়ন চালাত। এই উৎপীড়নে ক্ষিপ্ত হয়ে গারোগণ দলবদ্ধ হয়ে সমতলে নেমে এসে তাদের শোষণের সম্পদ লুট করে আবার পর্বতে ফিরে যেত।

সমতলভূমিতে সে সময় গারোদের আক্রমণ যে অহেতুক ছিল না তা তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞ প্লেফেয়ার। তিনি তার দা গারোস গ্রন্থে লিখেছেন : গারোদের এই সকল আক্রমণ অহেতুক ছিল না। বর্তমান কালের মতো গারোগণ সেকালেও তাদের ক্ষেত্রোৎপন্ন শস্য পাহাড় হতে প্রধান স্থলপথ এবং উপত্যকার পথসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাজারে বিনিময়ের জন্য নিয়ে আসত। এই সকল পথের রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল জমিদারগণের হাতে। তারা পাহাড় হতে বিনিময়ের জন্য আনা দ্রব্যসমূহের ওপর অত্যধিক হারে কর বসিয়ে গারোদের এমন উত্তোজিত করত যে গারোরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে সমতলভূমিতে নেমে এসে আক্রমণ ও লুণ্ঠন করত।

১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। ইংরেজ শাসন তখন চলছে। করম শাহ্ নামক এক ফকির সুসঙ্গ পরগনায় এসে ওই অঞ্চলের গারো ও হাজংদের সাম্যমূলক পাগলপন্থী বা বাউল ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকেন। এই ধর্মের মূল বিষয়বস্তু ছিল সত্যনিষ্ঠা এবং সকল মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। অল্প সময়ের মধ্যেই জমিদারদের দীর্ঘকালের উৎপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ গারো ও হাজংরা এই নতুন ধর্মমত গ্রহণ করে এবং করম শাহ শিষ্যত্ব লাভ করে। অতঃপর তারা সাম্যমূলক নতুন ধর্মমতে বলীয়ান হয়ে জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে থাকে।

এই সময় গারো সমাজে আরও একজন নেতার আবির্ভাব ঘটে। তিনি হলেন সুসঙ্গ পরগণার অন্তর্গত শঙ্করপুর নিবাসী গারো সর্দার ছপাতি গারো। জমিদারদের উৎপীড়ন থেকে গারো ও অন্য আদিবাসীদের রক্ষা করতে তিনি অভিনব এক পরিকল্পনা হাতে নেন।

ছপাতির ধারণা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলের সকল অধিবাসীকে নিয়ে স্বাধীন বা অর্ধস্বাধীন গারো-রাজ্য স্থাপন করতে পারলে জমিদার গোষ্ঠীর উৎপীড়ন ও শোষণ হতে আদিবাসীদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। তিনি তাই এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে সুসঙ্গ ও শেরপুর জমিদারির অন্তর্গত গারো, হাজং, কোচ, মেচ, হাড়ি ও অন্য আদিবাসীগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন।

ছপাতির নেতৃত্বে গারোদের তীব্র আন্দোলনে একসময় জমিদারগণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওই আন্দোলন মোকাবিলায় তারা কৌশলের আশ্রয় নেয়। জমিদাররা জানত আন্দোলনকারীদের প্রধান শক্তি তাদের একতা। তাই তারা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে সফলও হয়।

জামিদাররা গারোসহ অন্য আদিবাসীদের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন যে, ছপাতি সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের রাজা হতে চান। রাজা হলে তিনিও আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার চালাবেন। তাদের কোনো উপকার করা ছপাতির উদ্দেশ্য নয়।

সহজ-সরল আদিবাসীরা জমিদারদের এই মিথ্যা প্রচারে বিশ্বাস করে। ছপাতিকে নিয়ে তাদের মনে গভীর সন্দেহ দেখা দেয়। বিভ্রান্ত হয়ে তারা তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ফলে একসময় নিরুপায় হয়ে ছপাতি পার্বত্য অঞ্চল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

পলায়ন করলেও ছপাতি তখন স্বাধীন গারো রাজ্য স্থাপনে ভিন্নপথে চেষ্টা শুরু করেন। ওই সময় ইংরেজ সরকার সুসঙ্গ ও শেরপুরের জমিদারদের কাছ থেকে পার্বত্য অঞ্চল বাবদ কোনো রাজস্ব পেত না। জমিদারদের কাছ থেকে তারা পার্বত্য অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ছপাতি গারো তখন ওই সুযোগটি গ্রহণের চেষ্টা চালায়।

১৮০২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের কথা। ছপাতি ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন শহর নাসিরাবাদ এসে জেলা-কালেক্টরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কালেক্টরকে তিনি এই নিশ্চয়তা দেন যে, গারো পার্বত্য অঞ্চলটি জমিদারদের কাছ থেকে মুক্ত করে একটি ভিন্ন জেলায় রূপ দিলে তিনি ওই অঞ্চলের রাজস্ব আদায় করে দেবেন। ছপাতির বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও আলাপে মুগ্ধ হয়ে কালেক্টর তার আবেদন মঞ্জুর এবং জেলার রেভিনিউ বোর্ডের কাছে প্রস্তাবটি সুপারিশ করেন। কিন্তু জমিদারগণ রুষ্ট হবেন এই ভয়ে সে সময় রেভিনিউ বোর্ড ছপাতির আবেদন ও কালেক্টরের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে। এতে ছপাতির গারো রাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে জামিদারদের বিরুদ্ধে গারোদের আন্দোলনও কিছুদিনের জন্য থেমে থাকে।

ধর্ম, চিন্তাধারা ও সংগঠনের দিক থেকে একসময় গারো সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। অন্যদিকে করম শাহ বাউল ধর্মের প্রভাবে আদিবাসী-সমাজে এক ধর্মীয় আলোড়ন তৈরি হয়। পাগলপন্থী ধর্ম বাউল ধর্মেরই নামান্তর। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে পাগলপন্থী ধর্মের প্রচারক করম শাহ্ মৃত্যুবরণ করেন। ফলে সেসময় সুসঙ্গ পরগনার অন্তর্গত লেটিয়াকান্দা গ্রামের টিপু গারো পাগলপন্থী মতে নতুন করে আদিবাসীদের দীক্ষিত করতে থাকেন।

টিপু-গারোর প্রচারিত ধর্মমত ছিল—সকল মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্ট। সকল মানুষ সমান। কেউ কারো অধীনে নয়। তাই কেউ উচ্চ, কেউ নিচু—এইরূপ প্রভেদ করা উচিত নয়। গারোগণ নিজেদের আদিধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে টিপু গারোর ধর্মমতে দীক্ষিত হয়ে জমিদারগোষ্ঠীর অসহনীয় শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১০ আগস্ট ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button