আদিবাসীকলাম

সিধু-কানুর সাঁওতাল হুল

ইংরেজ আমলের কথা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু করার পর ইংরেজদের দৃষ্টি পড়ে রাজমহল পাহাড় ও আশপাশের পার্বত্য ও নদীঘেরা অঞ্চলটিতে। ওখানে দুর্গম অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাদ করা ও হিস্র জীব-জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার সাহস ছিল একমাত্র সাঁওতালদের। তাই ইংরেজরা ঘোষণা দেয় ওখানে যে যত খুশি জমি তৈরি করতে পারবে, ওই জমির ওপর কোনো কর দিতে হবে না। এই আহ্বানে জমিদারদের করের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, ছোটনাগপুর, কটক প্রভৃতি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার সাঁওতাল ছুটে আসেন। যে মাটিতে কোনো দিন কোনো মানুষের পা পড়েনি, তারা সে মাটিতে সোনার ফসল ফলাতে থাকেন। হিংস্র জীব-জন্তুর ও প্রকৃতির সঙ্গে চলে তাদের নিত্য লড়াই। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে বর্তমান সাঁওতাল পরগনা। কিন্তু পরে ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখেনি। ওই অঞ্চলেও তারা জমির ওপর কর ধার্য করে দেয়। পাশাপাশি সেখানে আসতে শুরু করেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালি, পাঞ্জাবি ও ভাটিয়া মহাজন ও ব্যবসায়ী দল সাঁওতাল পরগনায় বসবাস শুরু করে। তারা সবাই জমিদারগোষ্ঠী ও ইংরেজ শাসকদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে নানাভাবে সাঁওতালদের ওপর শোষণ করতে থাকে।

কী সেই শোষণ? সাঁওতালদের কাছ থেকে তারা ধান, সরিষা ও তৈলবীজ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিত। এর বিনিময়ে তাদের দেওয়া হতো সামান্য অর্থ, লবণ, তামাক ও কাপড়। ধূর্ত ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে যখন কোনো জিনিস কিনত, তখন ওজন করার এক ধরনের বেশি ওজনের বাটখারা ব্যবহার করত। যার নাম ছিল ‘বড়ো বৌ’ বা ‘কেনারাম’। আবার যখন তারা সাঁওতালদের কাছে কিছু বিক্রি করত, তখন আগের বাটখারা ব্যবহার না করে কম ওজনের ভিন্ন ধরনের বাটখারা ব্যবহার করত। যার নাম ছিল ‘ছোট বৌ’ বা ‘বেচারাম’। এভাবে ঠকানো হতো সহজ-সরল সাঁওতালদের। আবার চাষের সময়টাতে অভাবগ্রস্ত হলে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ বা দাদন নিতে বাধ্য হতেন সাঁওতালরা। ওই ঋণের সুদ ছিল ন্যূনতম শতকরা পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো টাকা পর্যন্ত। ফলে একবার ঋণ নিলে সারা জীবনেও তাদের সেই ঋণ পরিশোধ হতো না। এ ছাড়া মহাজনরা ঋণ দেওয়ার সময় কৌশলে তাদের কাছ থেকে বেশি টাকার টিপ-সই নিত। ফলে তারা কয়েক পুরুষ খেটেও ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন না। এভাবে সাঁওতালরা বংশানুক্রমে মহাজনদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে থাকেন। মহাজনের জমিতে খেটে কোনো সাঁওতালের মৃত্যু হলেও মুক্তি মিলত না। তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বা নিকট আত্মীয়কে সেই ঋণের দায় নিতে হতো।

অন্যদিকে জমিদাররা সাঁওতালদের জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে থাকে উচ্চহারের খাজনা। জমিদার ও মহাজনরা চাইত সাঁওতালরা তাদের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে না পারুক। নানাভাবে ফসল নষ্টও করে দিত তারা। এতে সাঁওতালরা যেমন খাজনা দিতে পারতেন না, তেমনি মহাজনদের ঋণের ওপরও নির্ভরশীল হয়ে থাকতেন। এভাবে নানা ধরনের শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার ও উৎপীড়নে সাঁওতালদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। ফলে একসময় বাধ্য হয়ে তারা মুক্তির পথ খোঁজেন। একবার বীর সিংয়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় সাঁওতালদের একটি দল। কিন্তু পাকুড় রাজার দেওয়ান জগবন্ধু রায়ের বিশ্বাসঘাতকতায় তাকে জরিমানা করে সবার সামনে জুতাপেটা করে জমিদাররা। সে সময় গোচ্চো ছিল ধনী সাঁওতাল। তার টাকার ওপর ছিল মহাজনদের বিশেষ লোভ। তাই তারা মহেশ দারোগাকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে চুরির মামলা করে। জমিদার, মহাজন আর পুলিশের এ জুলুম-পীড়নের খবরে সাঁওতালরা ভেতরে-ভেতরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে।

সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব ছিলেন চার ভাই। সাঁওতাল পরগনার ভাগনাদিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে এদের জন্ম। একবার ফসল না হওয়ায় মহাজনদের কাছে তাদের দেনা যায় বেড়ে। ফলে ক্রমেই তারা দরিদ্র হয়ে পড়েন। বীর সিং আর গোচ্চোর অপমান ও পীড়ন সিধু-কানুর মনে দাগ কাটে। একসময় জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। জমায়েত হওয়ার জন্য চারপাশের সাঁওতালদের কাছে তারা পাতাসমেত ছোট শালের ডাল পাঠায়। এটি তাদের একতার প্রতীক। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। সিধু-কানুর ডাকে প্রায় ৪০০ গ্রামের ১০ হাজার সাঁওতাল একত্র হয় ভাগনাদিহি গ্রামে। ওই সভায় সিধু ও কানু সাঁওতালদের উদ্দেশে ভগবানের নির্দেশ ব্যাখ্যা করে বলে, ‘ভগবান সব উৎপীড়নকারীকে উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন জীবন-প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে।’ এ কথা শুনেই উপস্থিত সাঁওতালরা সবাই শপথ নেন জমিদার মহাজনদের, ইংরেজ শাসকের, পুলিশ-পাইক-পেয়াদার আর জজ ম্যাজিস্ট্রেটের নিপীড়ন ও দাসত্ব সহ্য না করার। সিদ্ধান্ত হয় খাজনা না দেওয়ার। ওই দিন শোষক-উৎপীড়ককে বিতাড়িত করে সব জমিতে সাঁওতালদের দখল প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন রাজ্য গঠনের অঙ্গীকার করেন সবাই। বিদ্রোহী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’ সেøাগান।

বিদ্রোহ পুরোদমে চলছিল। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই। দিঘি থানার দারোগা মহেশ লাল দত্ত একদল পুলিশ নিয়ে সিধু, কানুসহ বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করতে এলে তাকে হত্যা করেন বিদ্রোহীরা। মূলত এই তারিখ থেকেই সাঁওতাল ‘হুল’ বা বিদ্রোহ শুরু হয়েছে বলে মনে করেন সাঁওতালরা। ক্রমেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় ইংরেজরাও বিদ্রোহ দমনে কঠোর হয়। তারা হত্যা করে হাজার হাজার সাঁওতালকে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। ইংরেজ সেনারা সিধুর গোপন আস্তানায় হানা দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সাঁওতাল-বিদ্রোহের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়ক সিধু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেন। এর আগেই চাঁদ ও ভৈরব ভাগলপুরের কাছে এক ভয়ংকর যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ উৎসর্গ করেন। আর ফেব্রুয়ারি মাসে কানু একদল সশস্ত্র পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকেও হত্যা করা হয়।

সিধু-কানু কি পরাজিত হয়েছিলেন? সরাসরি বিজয়ী না হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়নি। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল ও দামিন-ই-কো এলাকাসমেত বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয় এবং সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ বাংলার ও ভারতের কৃষক-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে শুধু উজ্জ্বল আর গৌরবান্বিতই করেনি; বরং বিদ্রোহীদের বীরত্বের ইতিহাস-পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে ও সিপাহি বিদ্রোহে প্রেরণা জুগিয়েছিল।

কিন্তু আজও এ দেশে সাঁওতালদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে ভূমি অধিকারের জন্য। বৈষম্য ও ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচারের ঘটনাও বাড়ছে দিন দিন। সাঁওতালরা মনে করেন, তাদের সত্তায় সিধু-কানু বারবার ফিরে আসে। তাই আজও অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের রুখে দাঁড়ানোর প্রাণশক্তি সিধু-কানু।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button