আদিবাসী

তুরি বিয়ে: কনের হাতের তালুতে তিল শুভ লক্ষণ

গায়ে হলুদের চতুর্থ দিনে তুরি আদিবাসীরা সূর্য পূজার আয়োজন করে থাকে। ওইদিনই মাড়োয়া পূজা করে বিয়ের মাড়োয়া তৈরি করা হয়। পঞ্চম দিনে বরকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাকে সাজিয়ে কপালে চন্দনের তিল দিয়ে আমগাছের সাথে বিয়ে দেয় তুরিরা। অতঃপর বরকে মায়ের কোলে বসানো হয়। মা আমের মুকুল ও দুধ-চিনির শরবত তার মুখে তুলে দিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। সর্বোপরি মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বর অন্যদের সঙ্গে কনের বাড়ির দিকে রওনা হয়।

তুরিদের বিয়েতে কনের বাড়িতেও কলাগাছ দিয়ে মাড়োয়া সাজাতে হয়। বরপক্ষ আসে রাতে। তাদের প্রথম দূরে কোন জায়গায় বসিয়ে জলপানের ব্যবস্থা করে এরা। অতঃপর মহতসহ উভয় পক্ষের দশজন আলোচনা করে নানা বিষয়ে। বরপক্ষ কনের বাড়িতে পৌঁছালে প্রথা অনুসারে প্রথমে তাদের শরবত খাইয়ে, চালন সাজিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। চালনের মধ্যে রাখা থাকে চিনি, বাতি, ঘিয়ের প্রদীপ, পান, সুপারি, সিঁদুর, দূর্বাঘাস ও ধান। কনের মা, খালা, ফুপু ও অন্যরা মিলে মোট পাঁচজন বরযাত্রীদের বরণের দায়িত্বে থাকে।
বরযাত্রী কনে সাজানোর জন্য ডালা নিয়ে আসে। তাতে থাকে শাড়ি, কাপড় ও সাজের উপকরণ। আরেকটি ডালায় থাকে কনের মায়ের জন্য একটি, নানি-দাদি, খালা-ফুপু ও চাদি সম্পর্কিত আত্মীয়দের জন্য মোট ১০টি শাড়ি। এসব ডালা কনের বাবাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বরণের পর পরই বর তার দুলা ভাইয়ের কাধে চড়ে বসে। সেখানে বসেই বর সঙ্গে আনা মিষ্টি মেয়ের মায়ের আচলে তুলে দেয়। মেয়ের মা তা গ্রহণ করলে বরকে মাড়োয়ার পিঁড়িতে বসানো হয়। তার সঙ্গে থাকে কনের ছোট ভাই বা বরের শালা। শালার হাতে থাকে লাল গামছা। মাড়োয়াকে কেন্দ্র করে গামছাটির দুই প্রান্ত দুইজন ধরে পাঁচ পাক দিয়ে থাকে। অতঃপর গামছা নিয়ে শালা চলে যায় এবং বরকে মাড়োয়ার ভান্ডারীর কোণে দাঁড় করানো হয়।
কনে সাজানো শেষ হলে কনেকেও মাড়োয়ায় আনা হয়। বর ও কনেকে পাশাপাশি পিঁড়িতে বসায় তুরিরা। এদের বিয়ের নিয়ম অনুসারে বরের দুলাভাইসহ দুজন বরের পিড়ি ধরে মেয়ের চারপাশে পাঁচপাক ঘুরে। অতঃপর পিড়িতে বসা কনেকেও বরের চারপাশে পাঁচপাক ঘোরানো হয়। এ সময়ই বর-কনের মালা বদল হয়।
এ আদিবাসী বিয়েতে মালা বদলের পর বর-কনেকে মাড়োয়ার পাশে বসানো হয়। এ সময় কনের বাবা হাত দিয়ে বরকে বস্ত্র দান করে। এরপর কনের বাবা বরযাত্রীদের সামনে হাত জোড় করে বিনীতভাবে কন্যা সম্প্রদান করেন। অতঃপর ভবিষ্যৎ পরীক্ষার জন্য চাল-তিলের পুঁটলিটির পঞ্চম বাঁধনটি খোলা হয়। কনে ও বরের বাবা মাড়োয়ায় মুখোমুখি বসেন। কনের বাবার কোলে কনেকে ও বরের বাবার কোলে বরকে বসানো হয়। এ সময় বর-কনের মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দুজনের পোশাকের আঁচল একত্রে বাঁধা হয়। মাড়োয়ার সকল অনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের বাড়ির ভেতরে এনে বর-কনেকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তুরি রীতিতে বাসর ঘরে বর-কনের সাথে নানী, দাদি সম্পর্কিত স্বজনরাও রাত্রিযাপন করে।
এদের বিয়ের পরে চলে দান পর্ব। দানের পরে শুরু হয় দশের খাওয়া পর্ব। খাওয়া শেষে তুরিরা হাড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে ও নারীরা ঝুমটা নৃত্য পরিবেশন করে। খিরো বালার কণ্ঠে বিয়ের গান :
০১। কিয়া ভিলো গে নুনী কেয়া ভেনো গে
শাক বাগুন জেরী গেল ধুমা উড়ি গেল
নুনী কেয়া ভেনো গে
কেয়া ভিনো গে..
ভাবার্থ :
কি হলো গো ছেলেমেয়ে
কি হলো গো?
শাক বেগুন পুড়ে গেল
ধুয়া উড়ে গেল
ছেলেমেয়ে কী হলো গো?
০২। তারক পাতা তেরকি
খেজুর পাতা দনা
নাচ গেয়ে ময়না
ভাতারে দেতো আয়না…।
তুরিদের বিয়ের পরের দিন বাসী বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কনে বাবার দেওয়া শাড়ি পরে বিয়ের আসরে বসে। অতঃপর বর-কনেকে মায়ের কোলে বসানো হয়। মা মিষ্টি মুখ করানোর জন্য দুজনকে ক্ষীর খাওয়ান এবং জামাইকে রূপার আংটি পরিয়ে আশীর্বাদ করে এবং কনে বিদায় দেন।
কনেকে নিয়ে বর নিজ বাড়ি পৌঁছালে বরপক্ষের পাঁচজন (বরের মা, খালা, ফুপু ও চাচিরা) একে একে বর-কনেকে বরণ করেন। এখানেও তাদের বরণের সময় শরবত খাওয়াতে হয়। বর-কনে উভয়কেই মাড়োয় বসানো হয়। সেখানে একটি ছোট পুকুর খনন করে তাতে আংটি খেলা চলে। এ খেলাটি মূলত বর-কনের বুদ্ধি যাচাইয়ের খেলা। অতঃপর ওই স্থানে দুজনকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরায় তুরিরা। এরপর একটি মাটির পাত্রে আগুন দিয়ে তার উপর একটি খালি মাটির পাত্র রাখা হয়। খালি পাত্রটি যথেষ্ট পরিমাণ গরম হলে সরিষা ছেড়ে দেওয়া হয়। সরিষা যখন তাপ পেয়ে ফুটবে ঠিক তখনই বর কনের হাত ধরে ওই ছোট পুকুরটি পার হবে।
বিয়ে নিয়ে তুরি সমাজে প্রচলিত আছে বেশ কিছু লোকবিশ্বাস। তুরিরা বিশ্বাস করে বিবাহিত নারীরা সিঁদুর না পরলে তাদের স্বামীর আয়ু কমে যায়। বিয়ের সময় কনের বাড়ির যাত্রাপথে বরযাত্রী যদি মৃতের যাত্রা দেখতে পায় তাহলে বিয়েকে শুভ বলে ধরে নেওয়া হয়। তুরিদের বিশ্বাস এতে নব বধুর পুনর্জন্ম ঘটেছে। আবার ওই সময় বাম দিক থেকে ডান দিকে শিয়াল ও অন্যান্য পশু যেতে দেখলে তাও শুভ হয়। এ ছাড়া ডান দিক থেকে বাম দিকে সাপ যেতে দেখলে সেটাও শুভ। কিন্তু ডান দিক থেকে বাম দিকে পশু গেলে তা অশুভ বলে ধরে নেওয়া হয়। তুরিরা বিশ্বাস করে এতে নব দম্পত্তির মধ্যে সারা জীবন ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকবে। একইভাবে এরা মেয়ে দেখতে গিয়ে শুভ-অশুভ বিষয় নির্ধারণ ও বিবেচনা করে। যেমন : মেয়ের হাত-পা মিলে যদি ২১ বা ততোধিক আঙুল থাকে তবে তাকে শুভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, লক্ষ্মীটেরার মেয়েরা ঘরে এলে সংসারের উন্নতি হয় বলে ধরে নেওয়া হয়, উপরের দিকে টানা চোখ থাকা মেয়েকে ঘরে আনলে সংসারে সুখ থাকে না, কনের হাতের তালুতে তিল থাকলে সংসারে উন্নতি হয়, কনের কানের গোড়ায় আঁচিলের মতো থাকলে তা মঙ্গলজনক, মুখের যেকোনো অংশে তিল থাকলে সে মেয়ে শান্ত ও হাসি-খুশি স্বভাবের বলে ধরে নেওয়া হয় প্রভৃতি।
আবার বরের বাড়িতে কনে বরণের সময় একটি খালি পাত্র যথেষ্ট পরিমাণ গরম হলে সরিষা ছেড়ে দেওয়া হয়। সরিষা যখন তাপ পেয়ে ফুটবে ঠিক তখনই বর কনের হাত ধরে ওই ছোট পুকুরটি পার হয়। এ ক্ষেত্রে তুরিদের বিশ্বাস, স্বামীর আগে যদি স্ত্রী মারা যায় তাহলে স্বামী ওই ঘাটে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করবে। আর যদি স্ত্রীর আগে স্বামী পরবাসী হয় তাহলে স্ত্রী ওই ঘাটে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে। দুজন যদি একত্রিত হয় তবেই এ ঘাট পেরুনো সম্ভব বলে এ আদিবাসীরা মনে করে।
তুরি সমাজে একাধিক বিয়ে বা স্ত্রী রাখার প্রচলন নেই। এদের সমাজে আগে বিয়ে বিচ্ছেদ প্রথা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটছে। গোত্র বা সমাজের প্রধান শালিস-বিচারের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ করে থাকেন। বিয়ে বিচ্ছেদের সময় এরা গান গায় :চ্যাড়া-পেয়ড়া জিমা লও
সাদা কাগজে লেখে দাও
বলো পিয়া, হাটে-বাজারে দেখা দিয়া, ময়া না ছাড়িয়ো!
ভাবার্থ:
বিবাহ বিচ্ছেদ বা ছাড়াছাড়ির কথা কাগজে লিখে দাও
তবে হ্যাঁ- বাজারে দেখা দিয়ো, মায়া-মমতা ছোড়ো না!
বিয়ে উৎসবকে ঘিরেই টিকে থাকে একটি জাতির আচার, নাচ, গান ও বিশ্বাসগুলো। যা সমৃদ্ধ করে ওই জাতির সংস্কৃতিকে। অভাব, বৈষম্যসহ নানা কারণে এ দেশের তুরি আদিবাসীরা আজ সংখ্যালঘু। সংখ্যাগুরুদের প্রভাবে লুপ্ত হচ্ছে তারা এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। ফলে নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে তুরিদের হাজার বছরের বিয়ে উৎসব ও আদি আচারগুলো।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ নভেম্বর ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button