আদিবাসী

টিকে থাকার প্রেরণায় কারমা উৎসব

ভাদ্র মাস। তাল পাকা গরম। চারদিকে ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। বড় গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছেন ঘর্মাক্ত পথিকরা। রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ ধানক্ষেত। বাতাসের ঝাপ্টায় মাঝে মধ্যেই দুলে উঠছে কাঁচা ধানগুলো। সবুজের সে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে বহু দূর অবধি। আমাদের গন্তব্য দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। নাম ঝিনাইকুড়ি। হালজায় মৌজায় অবস্থিত এ গ্রামটি বাংলাদেশে বসবাসরত কড়াদের একমাত্র গ্রাম। নিশ্চিহ্নপ্রায় এ জাতির মাত্র ১৭টি পরিবার বাস করছে এখানে। কড়ারা তাদের পূর্বপুরুষদের জাত-ধর্ম ও বিশ্বাসগুলোকে আজও আগলে রেখেছেন। তারই অংশ হিসেবে আয়োজন চলছে কারমা উৎসবের।
শুধু কড়ারাই নয়, সাঁওতাল, তুরি, ওঁরাও, পাহান, মাহালিসহ সমতলের বেশ কয়েকটি জাতির উৎসব এটি। কড়ারা এটিকে কারমা উৎসব বললেও অন্যদের কাছে এটি কারাম উৎসব। এ উৎসবটি পালিত হয় প্রতি ভাদ্রের পূর্ণিমার চাঁদে। উৎসবে বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের সঙ্গে পূজা করে এরা। এ বৃক্ষটি তাদের কাছে অতিপবিত্র। উৎসবে তারা অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানায় দেবতা কারাম গোসাঁইয়ের নিকট।
বিকাল হয় হয়। আমরা পা রাখি গ্রামটিতে। তার আগেই একদল যুবক ডাল কাটতে চলে গেছে গভীর শালবনে। গোত্রপ্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। আগে থেকেই তিনি উৎসবের জন্য খিল কদমের ডাল কেটে আনা ও তা বিসর্জনের জন্য মনোনীত করে দিয়েছেন অবিবাহিত এক যুবককে। বিবাহিত কোনো যুবকের দ্বারা এ গাছের ডাল কাটা একেবারেই নিষেধ।
কড়ারা দিনাজপুরের ধর্মপুর শালবনের গহিনের ‘খিল কদম’ গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে। এ গাছের ডাল কেটে আনার রয়েছে বিশেষ নিয়ম। জগেন জানালেনÑ এ আচার পালনে লাগে তেলের পিঠা, ধূপ, পাটখড়ি, সিঁদুর। সাধারণত বিকালের দিকে ডাল কাটতে বের হতে হয়। ফিরে আসতে হয় সন্ধ্যার পর-পরই।
যে ডাল কাটবে সে গাছটির কাছে গিয়ে প্রথমে গোসল সেরে পবিত্র হয়ে নেয়। পরে ধুতি পরে গাছটির গোড়ার জংলা পরিষ্কার করে পানি দিয়ে মাটি লেপে দেয়। এ সময় গাছটিকে পূর্বদিকে রেখে তাকে বসতে হয় পশ্চিমে। অতঃপর সেখানে পাটকাঠি জ্বালিয়ে, ধূপ দিয়ে, তিনটি সিঁদুর ফোঁটা গাছে ও মাটিতে লাগিয়ে সে ভক্তি দেয়। এরপর গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয় দুটি তেলের পিঠা। মনে মনে বলতে থাকে- ‘কারাম গোসাঁই প্রতিবছরের মতো আজও আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, তোমার পূজা দেব বলে।’ গাছের গোড়ায় তিনটি কোপ দেওয়ার অঙ্গভঙ্গি করেই সে গাছের ডালে উঠে বসে। অতঃপর ‘বিসক্রম’ বলে এক বা তিন চটে কেটে নেয় খিল কদম গাছের বড় একটি ডাল বা ছোট তিনটি ডাল। সে ডাল মাটিতে ফেলা একেবারে নিষেধ থাকে। তাই যুবকটি ডালটি মাটিতে পড়ার আগেই তুলে নেয় ঘাড়ে। ডালসহ সে গ্রামের কাছাকাছি আসতেই ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে রাখা হয়। শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো হয় মাড়োয়াটিকে। অতঃপর ঢাকঢোল বাজিয়ে খিল কদম গাছের ডালটিকে বরণ করে মাড়োয়ার চারপাশে আড়াই পাক ঘুরে তা মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।
সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিটি বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আঙিনা পরিপাটি করে সাজানো হয়। সবার ঘরেই এ সময় তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যায়। কড়ারা বলেÑ তেলের পিঠা ছাড়া কারমা উৎসব হয় না। উৎসবের শুরুতেই গ্রামপ্রধান বা তার মনোনীত যে কোনো ব্যক্তি ধুতি পরে ডালটির সামনে পূজা দেন। ডালটিকে পূর্বদিকে রেখে পূজারিকে বসতে হয় পশ্চিমে। মাটি লেপা একটি স্থানে কলাপাতা বিছিয়ে পাশে রাখা হয় একটি কাঁসার থালা। থালায় থাকে প্রদীপ, কাঁচা ছোলা, জুঁইফুল, শসা ও সিঁদুর। এ সময় দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়ে কারমা উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়। প্রথমে কলাপাতায় চাল ছিটিয়ে মোরগ দুটিকে খেতে দেওয়া হয়। পরে তার মাথায় হাঁড়িয়া ঢেলে সিঁদুর দিয়ে বলি দেওয়া হয়। অতঃপর মোরগ দুটির ঠোঁট কেটে পূজাস্থলের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। এ পর্বটি শেষ হওয়ার পর-পরই উপোসের ডালা দুটি এনে রাখা হয় কারমা ডালের (খিল কদম) সামনে। কী এই উপোসের ডালা? কারমা উৎসবের পাঁচদিন আগ থেকে কড়ারা ধর্মের পরীক্ষা শুরু করে। বাঁশ দিয়ে এরা দুটি ডালা তৈরি করে নেয়। একটি ডালা থাকে ছোট, অন্যটি বড়। কড়াদের কাছে একটি কারমা ও অপরটি ধারমা। ডাল দুটির মধ্যে এরা কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয়। নিয়মানুসারে ওইদিন থেকেই এরা উপাস (উপোস) থাকতে শুরু করে। এ সময়টাতে মাছ, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ খাওয়া নিষেধ। খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। গরম ভাত খাওয়া যায় না। তাই ভাত খেতে হয় ঠা-া করে। যে কয়জন উপোস থাকে, সে কয়টি ছোট কাঠি পুঁতে দেওয়া হয় ডালায়। ডালায় প্রত্যেকের সীমানাও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। উপোসকারী অবিবাহিত হলে কাঠির গায়ে কাজল আর বিবাহিত হলে সিঁদুর লাগানো হয়। ডালাতে প্রতিদিন ছিটানো হয় হলুদ ধোয়া পানি। এদের বিশ্বাস উপোস অবস্থায় ধর্মমতে না চললে ডালায় তাদের হাতে লাগানো বীজ থেকে কোনো চারা গজাবে না। উৎসবের দিন নতুন চারা গজানো ডালা দুটিকে রাখা হয় খিল কদম গাছের ডালের সঙ্গেই।
কারমা উৎসবে কড়ারা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সবাইকে দাওয়াত করে। সাধ্যমতো সবাই নতুন কাপড় পরে। মেয়েরা শাখা, সিঁদুর, টিকলি, খাড়– পরে নেয়। বলি পর্বের পরেই শুরু হয় উৎসবের পেছনের পৌরাণিক কাহিনি বলার আসর। মূলত এ কারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে কারমা বা কারাম উৎসবের বিশ্বাসটি। কাহিনি বলার পর্বে খিল কদম বা কারাম ডালটিকে ঘিরে বসে নারীরা। সেজেগুজে ঘোমটা টেনে বসে তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয় প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বাঘাস ও জুঁইফুল। গোত্রপ্রধান বা মাহাতো বলতে থাকেন উৎসবের পৌরাণিক কাহিনিটি। মাঝে মাঝে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলেন- ‘ফুল ফেকিয়ে।’ ঠিক তখনই সবাই এক মুঠো জুঁইফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে। কাহিনি শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয় কারমা ডালটির সঙ্গে। কারমা উৎসবের পূজার এই পর্বটিতে শুধু মেয়েরাই অংশ নিতে পারে। পূজা শেষে উপোসকারীরা উপোস ভাঙে।
অতঃপর রাতভর তারা ডালটির চারদিকে নেচে-গেয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে। নারীরা হাত ধরাধরি করে নাচে আর কণ্ঠ আকাশে তুলে গান গায়Ñ
‘তারক পাতা তেরকি
খেজুর পাতা দনা
নাচ গেয়ে ময়না
ভাতারে দেতো আয়না।’
ভোরবেলা গ্রামপ্রধান বা মাহাতো স্নান সেরে প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের ডালের মাথায়। এর পর-পরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। অতঃপর যে যুবকটি ডাল কেটেছিল, সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে সেটি কাঁধে তুলে ঢাকঢোলের তালে তালে বির্সজন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে।
কড়ারা মূলত কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ভাদ্র তাদের অভাবের মাস। কারণ এ সময় তাদের কোনো কাজ থাকে না। জমিতে তখন কাঁচা ফসল। আগে এ সময়ে এরা আগাছা বাছার কাজ করত। কিন্তু রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে আগাছাও এখন হয় না। অন্য কাজের সুযোগও তেমন নেই। কড়ারা এ সময় হয়ে পড়ে কর্মহীন। এ সময়টাতে এরা সরকারিভাবেও পায় না কোনো সাহায্য-সহযোগিতা। ফলে এ অঞ্চলের প্রান্তজনরা এক বেলা খেয়ে জীবন চালায়। বনের জংলি আলুই তখন তাদের ভরসা। এ সময় মহাজনদের কাছে চড়া সুদে আগাম শ্রম বিক্রি করেই চলছে এরা। যেটুকু জমি আছে তাও দখলে রাখতে পারছে না। স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালি ভূমিদস্যুদের শকুনদৃষ্টি পড়ছে তাতে। শত অবহেলা, অত্যাচার ও অভাব-অনটনের মাঝেও কড়াসহ অন্য জাতির প্রান্তজনরা কারমা উৎসবে আজও আশায় বুক বাঁধেন। সামনের বছরে নিশ্চয়ই দূর হয়ে যাবে তাদের সব অভাব-অনটন। দেখা মিলবে সৌভাগ্য ও সফলতার। বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার সংগ্রামে কারমা উৎসব এভাবেই তাদের প্রেরণা ও মানসিক শক্তি জোগায়।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমাদের সময়-এ, প্রকাশকাল: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫

WARNING:
www.salekkhokon.me-এ-এ প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

© 2015 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button