আদিবাসী

ভাষার দেশে রক্ষা পাক আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো

সুদেব পাহানের বয়স তখন ছয়। বাবা খোসকা পাহানের ইচ্ছে ছেলে তার সঙ্গে কাজে যাবে। সংসারে আসবে বাড়তি আয়। কিন্ত সুদেবের মা ভারতী পাহানের স্বপ্নটা ভিন্ন। অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই তার ছেলে বই হাতে যাবে স্কুলে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে সুদেব। কেউ তাকে ঠকাতে পারবে না। মুন্ডা পাহানদের সম্মান বাড়বে। গোদাবাড়ীর পাহান গ্রামে আলো ছড়াবে সুদেব।
দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গোদাবাড়ী গ্রামটিতে বিশটি মুন্ডা পাহান পরিবারের বাস। সুন্দর ভবিষ্যতের প্রলোভনে এরা ধর্মান্তরিত হয়নি এখনও। দারিদ্রের সঙ্গে নিত্যদিন সংগ্রাম করে টিকিয়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি আর সংস্কৃতিটাকে। কিন্ত সংসারে আয় না বাড়লে আসবে না সচ্ছলতা। তাই ছেলে সুদেবকে কাজে নেয়াতেই বাবার আগ্রহ বেশি।
গোদাবাড়ীর মুন্ডা পাহানরা কথা বলে সাদরি ভাষায়। এ ভাষাতেই মায়ের ঘুম পাড়ানি গান আর বাবার বকুনি খেয়েই বেড়ে উঠেছে সুদেব। রাত-দিন মায়ের কথায় আর উৎসব-আনন্দে আদিবাসী গানে সুদেবের আলিঙ্গন হয়েছে তার প্রিয় মায়ের ভাষাটির সঙ্গে।
স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে সুদেবকে স্কুলে পাঠাতে সম্মতি দেন খোসকা পাহান। বুক ভরা আশা নিয়ে তারা সুদেবকে ভর্তি করায় স্থানীয় কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই দুরন্ত সুদেবের শিশুমনে ছন্দপতন ঘটে। তার মন থেকে আনন্দ-হাসি উবে গিয়ে জায়গা করে নেয় এক অজানা আতন্ক।
সুদেব হেসে খেলে বড় হচ্ছিল যে ভাষার আলিঙ্গনে। মায়ের সে ভাষাটিকে সে খুঁজে পায়না বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রচলন নেই তার আদিবাসী ভাষাটির। কেউ কথাও বলে না তার প্রিয় সাদরি ভাষায়। চারপাশের সকলেই বাংলা ভাষাভাষি। বাংলা তার কাছে অপরিচিত, অন্য জাতির ভাষা। ফলে শিক্ষালাভ করতে এসে শিশু বয়সেই বাংলা ভাষাটি তার ওপর আরোপিত হয়।
এভাবেই চলতে থাকল কিছুদিন। একেতো ভাষার ভীতি তার ওপর ক্লাসের বন্ধুদের আচরণে সুদেব একেবারেই মুষড়ে পরে। আদিবাসী বলে তাকে বসতে হয় আলাদা এক বেঞ্চিতে। কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না। অন্যরা সবাই তাকে আড়চোখে দেখে। তাই তার ভাব বিনিময়ের পথও হয় রুদ্ধ।
লেখাপড়া না জানায় সুদেবের বাবা-মায়ের পক্ষেও সম্ভব হয় না সুদেবকে সাহায্য করা। ফলে এক অজানা আতন্ক ক্রমেই তার মনে বাসা বাঁধে। দিনে দিনে স্কুলে যাওয়া তার কাছে রীতিমতো ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করে সে। বিদ্যালয়ের দুর্বল ছাত্রের তালিকায় নাম ওঠে সুদেবের। কেউ জানতেও পারে না সুদেবের এই পিছিয়ে পড়ার কারণটি। এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুদেব হারিয়ে ফেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটি। পড়াশুনায় ইতি টেনে শিশু বয়সেই শুরু হয় সুদেবের কাজে যাওয়া।
দিনাজপুরে সীমান্তবর্তী আরেকটি গ্রাম হালজায়। এই গ্রামে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বাস। গোটাদেশে কড়ারা টিকে আছে মাত্র ১৯ টি পরিবার। হারিয়ে যাচ্ছে কড়ারা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস।
কড়া পাড়ার শিতা কড়া আর কোলো কড়ার আদরের সন্তান কৃষ্ণ কড়া। শিশু বয়সেই কৃষ্ণ কড়া ভর্তি হয় নিকটবর্তী রাঙ্গন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রথমদিনেই কৃষ্ণ যেন সাগরে পড়ে। তার মায়ের কড়া ভাষায় বিদ্যালয়ে কেউ কথা বলে না। বন্ধুরা সকলেই বাঙালি। জাত যাওয়ার ভয়ে কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে সকলেই। অবজ্ঞা আর অবহেলায় কষ্ট পায় কৃষ্ণ। কিন্ত মায়ের উৎসাহে সাহস হারায় না। ফলে এক বেঞ্চিতে বন্ধুবিহীন একাই কাটিয়ে দেয় সে। অজানা বাংলাভাষা বুঝে পরীক্ষায় পাশ করা- সে এক দুরূহ ব্যাপার! তাই পাশ ফেলের মধ্যেই কেটে যায় তার ৫টি ক্লাস।
হালুয়াঘাটের এক গারো নারী সুমনা চিসিম। পেশায় একজন এনজিও কর্মকর্তা। পড়াশোনা  শুরু করেন নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি মিশন স্কুলে। প্রথম স্কুলে গিয়ে সেসময় সুমনাও খুঁজে পাননি নিজের মায়ের ভাষাটিকে। ফলে প্রথম দিনেই ভড়কে যান তিনি। সুমনার ভাষায় ‘আমার ক্লাস টিচার ছিলেন একজন বাঙালি। স্বভাবতই আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে, ভাষা বুঝতে না পারায় সঠিক উত্তর দিতে পারতাম না। বাঙালি ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করত। আমি বুঝতাম না কেন তারা হাসে। টিচারদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। তুমি ও আপনির ব্যবহার জানা ছিল না তখন। প্রথম প্রথম বাংলাভাষা না জানার কারণে নিজেও ছিলাম অন্ধকারে।’
ওপরের চিত্রগুলোতে এদেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষালাভের বাস্তব অবস্থা খানিকটা প্রকাশ পায়। কিন্তÍ সার্বিকভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের চিত্র আরও করুণ।
ভাষা শুধু প্রকাশমাধ্যমই নয়, বরং ভাষা প্রকাশের বিষয়কে নতুন রূপ দিয়ে অর্থবহ করে তোলে। তাই শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকাই প্রধান। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের দুধের মতো। নিজেকে প্রকাশে মাতৃভাষা দেয় সকালে সূর্যের দিগন্ত বিস্তারী আলো।’ কিন্ত এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী শিশুদের জন্য নেই কোন আদিবাসী ভাষায় পুস্তক কিংবা আদিবাসী ভাষাভাষি কোন শিক্ষক। ফলে আদিবাসী শিশুরা নিঃশব্দে বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষার সেই দিগন্ত বিস্তারী আলো থেকে।18শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। এই ভাষাই যদি শিশুর কাছে হয় দুর্বোধ্য আর ভীতিকর তবে প্রথমেই শিশুর মানসিক ও মানবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। এদেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার শুরুতেই বোঝার মতো চেপে বসেছে বাংলাভাষাটি। ফলে বিকশিত না হয়ে অন্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে আদিবাসী শিশুদের স্বপ্নগুলো। রাষ্ট্রীয় নিয়মেই আদিবাসী শিশুদের কোমল মনে বাংলা ভাষার কষাঘাত বাংলা ভাষাটিকে আগ্রাসী ভাষা হিসেবে মনে হওয়াও যুক্তিসংগত হয়ে উঠেছে।
বাঙালি সমাজের কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার শুরুতেই বিদ্যালয়ে আনন্দ-হাসির মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় ছড়া কাটছে, নিজের ভাষায় ভাব জমিয়ে বন্ধুত্ব করছে অন্য শিশুদের সঙ্গে তখন আদিবাসী শিশুরা নীরবে, নিস্তব্ধে চোখের জল ফেলে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। এমন দৃশ্য যেকোন বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে।
কিন্ত এদেশের মানুষই তো মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজের বর্ণমালাগুলোকে। বাঙালি জাতির সে ইতিহাস আজ গোটা বিশ্বের জানা।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট ভাষা। ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ জানায়। দ্রুত সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ। শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। পূর্ব পাকিস্তান নামে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হয় একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের অনুরোধে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২৩ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

আমাদের ভাষা দিবস আজ সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। কিন্ত ভাষার জন্য রক্ত দেয়া শহীদদের এদেশে রক্ষা পাচ্ছে না অন্য জাতির মাতৃভাষাগুলো, ভাষার দেশেই শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে – এ যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের চিত্র।
শিক্ষার অধিকার মানুষের স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯৫৭ সালের ৫ জুন ৪০তম অধিবেশনে ১০৭নং কনভেশনে আদিবাসী ও উপজাতীয় ভাষা বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কিছু নীতিমালা তৈরি করে এবং এ কনভেশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী অন্যতম দেশ।
কনভেশনের অনুচ্ছেদ ২১-এ উল্লেখ রয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় জনসমষ্টির অবশিষ্ট অংশের সাথে সমতার ভিত্তিতে সকল স্তরে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
অনুচ্ছেদ ২৩(১) এ উল্লেখ রয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে শিক্ষা দান করতে হবে। কিংবা যেখানে এটা সম্ভব নয়, সেখানে তাদের সমগোত্রীয়দের মধ্যে সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত ভাষায় শিক্ষা দান করতে হবে।’
অনুচ্ছেদ ২৩(২) এ উল্লেখ রয়েছে ‘মাতৃভাষা বা আদিবাসী ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা কিংবা দেশের একটি অফিসিয়াল ভাষায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’- এর ৩০ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যেসব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ওই ধরণের সংখ্যালঘু  সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংষ্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সাথে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ এবারের শিক্ষানীতিতেও আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাভাষার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আদিবাসীদের ভাষা থেকে বহু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাভাষায়। সাঁওতালি ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার আন্তরিক সম্বন্ধ রয়েছে। পন্ডিতেরা মনে করেন, সাঁওতালি ভাষা বাংলা ভাষার ব্যাকরণে প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশি শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা থেকে আগত। অথচ আজ হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী জাতির সে ভাষাগুলোও। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরই মধ্যে কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। প্রায় পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে আদিবাসীদের কুরুখ ও নাগরি ভাষা।
এদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের কয়টি ভাষা রয়েছে ? একাধিক তথ্যমতে পৃথিবীতে ৪টি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ভাষা পরস্পর এতটা ঘনিষ্ঠ যে এগুলোকে উপ-ভাষিক বৈচিত্র্য বলা যায়। যেমন তঞ্চঙ্গা মূলত চাকমা ভাষারই অংশ, রাখাইন মারমা ভাষার, লালং বা পাত্র গারো ভাষার এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী এবং হাজং বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে অবিহিত করা যায়। কিছু মতভেদ থাকলেও বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষার সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৭টি।
আদিবাসী ভাষাগুলোকে মূলত ৪টি ভাষা পরিবারে ভাগ করা যায়। অস্টো এশিয়াটিক, তিব্বতি- চীন, দ্রাবিড়, ইন্দো-ইউরোপীয়। বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাসমূহ আবার দুটি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে মোন-খমের ও মুন্ডারি শাখা। বর্তমানে প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখার অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাসি ভাষা। খাসি ভাষা মৌখিক ভাষা। এ ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে বর্তমানে এ ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়।
সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা দুটিই মুন্ডারি শাখার অন্তর্ভূক্ত। উভয় ভাষারই নিজস্ব কোন হরফ নেই। হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে এ ভাষা দুটি। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতাল বর্ণমালা তৈরি করে এবং তা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।
চীনা-তিববতি ভাষাসমূহ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন: বোডো, কুকি-চীন, সাক-লুইশ ও লোলো-বার্মিজ শাখা। মান্দি বা গারো, ককবোরক (ত্রিপুরা), লিঙ্গাম, পাত্র বা লালং, কোচ, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষাসমূহ বোডো শাখার অন্তর্ভূক্ত। মৈতেয় বা মণিপুরী, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো প্রভৃতি ভাষাগুলো কুকি-চীন শাখাভুক্ত।
রাখাইন, ওরাওদের কুড়ুখ, পাহাড়িকা ও মাহালি ভাষা দ্রাবিড় ভাষা পরিবারে অন্তর্ভূক্ত। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। রাখাইন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ওরাওদের কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা।
বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য পরিবারভূক্ত ভাষার মধ্যে বাংলা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এই পরিবারে আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা ভাষা এবং সাদরি ভাষাও রয়েছে। মণিপুরীদের বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং প্রভৃতি ভাষাও এই শ্রেণীভূক্ত।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। বিলুপ্তপ্রায় এসব ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেছে ইউনেস্কো। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। মাতৃভাষা সংরক্ষণে বাংলা একাডেমী, আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আদিবাসীদের ভাষারক্ষা কিংবা আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের বিষয়টি আসলেই প্রশ্ন ওঠে বর্ণ নিয়ে। আদিবাসীদের ভাষায় লিখিত কোন বর্ণ নেই। কিন্ত বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ইংরেজি ভাষারও নেই কোন নিজস্ব বর্ণ। ইংরেজি বর্ণগুলো রোমান হরফ থেকে নেয়া। তাছাড়া চাকমা, মারমা, রাখাইন, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, ম্রো. বম, গারো, খাসিয়া, হাজং, মণিপুরি, ওরাও, মুন্ডাসহ ১৫টি আদিবাসী ভাষায় লিখিত রচনা এখনও রয়েছে। ভাষা রক্ষা কার্যক্রমে যা সহায়ক হতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও আদিবাসীদের ভাষা রক্ষায় কিংবা আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে এদেশেই রয়েছে বেসরকারি কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
অতি সম্প্রতি গারো ভাষায় বর্ণমালার জন্যও রোমান হরফ বেছে নেয়া হয়েছে। গারোরা নিজেদের মধ্যে আচিক ভাষায় কথা বলে। ভারতের মেঘালয়ে অনেক আগে থেকেই গারোদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এমনকি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও গারো ভাষায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অচিক ভাষার কোনো লিখিত রূপ না থাকলেও সেখানে রোমান হরফগুলোকেই গারো ভাষার বর্ণমালা করা হয়েছে। আমাদের দেশে নেত্রকানার দুর্গাপুরের প্রয়াত দানিয়েল রোরাম, কলমাকান্দার মার্চিন রেমা, মধুপুরের প্রয়াত জন চিসিম কিছু গারো বর্ণমালা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্ত দীর্ঘ সময়েও এ ব্যাপারে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। বর্তমানে গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের ক্যাথলিক সম্প্রদায়, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কিছু উন্নয়ন সংস্থা গারো বর্ণমালার একটি লিখিত রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ১৯৯৯ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাঁওতাল শিশুদের জন্য দুটি স্কুল করেছে। রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জে ‘আশ্রয়’ নামে একটি সংগঠন ওরাও ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য দুটি স্কুল করেছে। বান্দরবানে ¤্রাে কালচারাল সোসাইটি ২০০১ সালে ম্রো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য  ৬০টি স্কুল করেছিল অর্থাভাবে যা চলছে ঢিমেতালে।
চাকমারদের মতো অনেক আদিবাসী ভাষায় এখনো লিখিত রচনা রয়েছে। মণিপুরীদের ভাষা মৈথয়ীর ইতিহাস বহু পুরোনো। সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্য ও অভিধান রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা হয় এই ভাষায়। মিয়ানমারে মারমা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বান্দরবানে জিরকুন সাহু নামে এক আদিবাসী বম ভাষায় অভিধান করেছেন। যেগুলো ভাষা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। তাই সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে সমন্বিত উদ্যোগে সহজেই রক্ষা করা যায় আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলোকে। ভাষার দেশে মাতৃভাষা রক্ষার শপথই হতে পারে ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পালনের মূল বিষয়।

সরকার  সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী শিশু স্কুলে যায়। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ মাতৃভাষার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই প্রয়োজন আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি।
একুশে ফেব্রুয়ারি সকল মানুষের কথা কয়। তাই এই দিনে আমরা চাই – এই ভাষার দেশে রক্ষা করা হোক আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলোকে। আমরা চাই না বাংলাভাষার যাতাকলে ঝরে পড়ুক এক একটি আদিবাসী শিশু। আমরা চাই রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারীদের এই দেশে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষা লাভ করুক তার চিরচেনা মায়ের ভাষায়।

ছবি : সংগৃহীত

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যা ভাষার কথায়  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তে

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button