আদিবাসী

কড়া বিহা (প্রথম পর্ব)

কড়ারা বিয়েকে বলে ‘বিহা’। জগেন জানায়, এরা গোত্রকে বলে পেরিস। কড়া আদিবাসীদের গোত্র ছিল ১১টি। যেমন—ছাগের পেরিস, হারদি পেরিস, সানদোয়ার পেরিস, চিরু পেরিস, তামগিরিয়া পেরিস, কাচদি পেরিস, করি পেরিস, নাগরু পেরিস, শুয়ের পেরিস, কৃষার পেরিস ও তিরকী পেরিস। কড়ারা মনে করে আগে তাদের সমাজে আরো বেশি গোত্র ছিল। নানা কারণে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে বর্তমানে কয়েকটি গোত্র নিয়ে চলছে তাদের সমাজব্যবস্থা।

পাকা রাস্তাটি শেষ অনেক আগেই। এরপরই শুরু হয় ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা। দুপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। মাঝ দিয়ে রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে কড়া পাড়ার দিকে।

গ্রামের নাম ঝিনাইকুড়ি। এটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজায়। এখানেই পাড়া করে বসবাস করছে কড়া আদিবাসীদের ১৬টি পরিবার। এ ছাড়া বৈরাগীপাড়ায় একটি এবং দিনাজপুর সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙার খাড়িপাড়ায় রয়েছে আরো দুটি কড়া পরিবার। সব মিলিয়ে কড়াদের মাত্র ১৯টি আদিবাসী পরিবার টিকে আছে এ দেশে।

বাংলাদেশে টিকে থাকা কড়া আদিবাসীদের গোত্র প্রধান জগেন কড়া। তাঁর ভাষায় কড়া অর্থ মাটি খোঁড়া। আর এ আদিবাসীর এমন নামকরণ হওয়ার কারণ হলো কোনো একসময় দীঘি খননের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা। ইংরেজ আমলে ভারতজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসীরাই। মূলত রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে এদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে।

কড়াদের দেওয়া তথ্যমতে, একসময় দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কড়াদের একাধিক গ্রাম ছিল। নানা কারণে এরা পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ভারতের ঝাড়খন্ড স্টেটের দুমকা, গোড্ডা, পাকুর, শাহীবগঞ্জ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে এখনো কড়াদের একাধিক গ্রাম রয়েছে। মোট ১৯ পরিবারে এ দেশে কড়াদের মোট সংখ্যা মাত্র ৮৫ জন। শিশুদের সংখ্যা ত্রিশের মতো।

কড়া আদিবাসীদের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় তিন সদস্যের গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। গ্রামপ্রধানকে এরা বলে মাহাতো। এ ছাড়া রয়েছে গোড়াৎ ও পারামানি নামের দুটি পদ। আগে কড়াদের কয়েকটি গ্রামের একজন প্রধান থাকত। তাকে বলা হতো পাঁড়ে। এরা গ্রাম পরিষদের পদগুলো নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে। এ নিয়ে কড়াদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য তৈরি হয় না।
কড়া গ্রামে যাতায়াত অনেক দিনের। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম ও সংস্কৃতির নানা আচার। গ্রামের মাহাতো জগেন কড়া ছাড়াও সুনিয়া কড়া, কিনা কড়া, সেড়তি কড়ার মুখ থেকে শুনেছি তাদের বিয়ে-সংস্কৃতির আদ্যোপান্ত।

কড়ারা বিয়েকে বলে ‘বিহা’। জগেন জানায়, এরা গোত্রকে বলে পেরিস। কড়া আদিবাসীদের গোত্র ছিল ১১টি। পাশে বসা সুনিয়া কড়া আঙুলের কর গুনতে গুনতে বলেন নামগুলো। যেমন—ছাগের পেরিস, হারদি পেরিস, সানদোয়ার পেরিস, চিরু পেরিস, তামগিরিয়া পেরিস, কাচদি পেরিস, করি পেরিস, নাগরু পেরিস, শুয়ের পেরিস, কৃষার পেরিস ও তিরকী পেরিস। কড়ারা মনে করে আগে তাদের সমাজে আরো বেশি গোত্র ছিল। নানা কারণে সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে বর্তমানে কয়েকটি গোত্র নিয়ে চলছে তাদের সমাজব্যবস্থা।

কড়া আদিবাসী সমাজে একই পেরিস বা গোত্রের লোককে একই রক্তের সম্পর্ক ধরা হয়। তাই একই গোত্রে বিয়ে একেবারেই নিষিদ্ধ ও পাপের সমতুল্য মনে করা হয়। সুনিয়া কড়ার ভাষায়, ওইটার বিহা কোনোদিন চলবার নয়। আবার কিনা কড়া বলেন, মায়ের বংশে যেতে পারে, কিন্তু বাবার বংশতে না।

কড়া আদিবাসী বিয়েতে ঘটক লাগে। ঘটককে এরা বলে এগুয়া। উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান পেলে এবং তার পেরিস বা গোত্র যদি মিলে যায় তবেই শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
পাত্রীপক্ষের সম্মতিতে ঘটক পাত্রপক্ষকে পাত্রী দেখাতে নিয়ে যায়। কড়া ভাষায়, ‘কেনিয়া দেখালে যায়েলছে।’ এ সময় ঘটকের সঙ্গে বরের বাবা-মা, গোত্রের মাহাতো, গোরাৎ আর পারামানি সঙ্গে যান। কড়াদের নিয়মানুসারে পাত্রীপক্ষ বরপক্ষকে এ সময় গোশত-মাছ বাদ দিয়ে শুধু নিরামিষ, ডাল-ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করে। তবে এ সময় হাড়িয়া পরিবেশন বাধ্যতামূলক থাকে। হাড়িয়া পরিবেশন না করলে কড়া বিয়েতে পাত্রপক্ষকে অসম্মান করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। হাড়িয়া নিয়ে কড়া সমাজে প্রচলিত আছে নানা ধরনের গান। পাশে বসা সত্তরোর্ধ্ব সেড়তি কড়ার কণ্ঠে সুর ওঠে তেমনি একটি গানের :

নিশা খেলে দিশা হলো ভুল
কানে পিনদিবে ধুতুরাকে ফুল।

আপ্যায়ন শেষে কনে সেজেগুজে উপস্থিত সবাইকে ভক্তি দেয়। বরপক্ষের সবাই তখন তাকে ভালোভাবে দেখে নেন। এ সময় কনের হাতে সাধ্যমতো টাকা আশীর্বাদ বা সালামি হিসেবে গুঁজে দেওয়া হয়ে থাকে। কড়া আদিবাসীরা এ আনুষ্ঠানিকতাকে গড় লাহগি বলে। পাত্রী পছন্দ হলে এ অনুষ্ঠানেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা করা হয়। কতজন আসবে, সে হিসাবটাও চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। এ আদিবাসী বিয়েতে লগনের কোনো বিষয় নেই। এরা চান্দ্রমাস হিসাব করে নিজেদের সুবিধামতো সময়ে বিয়ের দিন চূড়ান্ত করে। তবে বিয়ে চূড়ান্ত হলেও কনেপক্ষ একইভাবে বরের বাড়িতে লোকজনসহ যায় এবং সেখানে তাদেরও আপ্যায়িত করা হয়।

কড়াদের বিয়েতে যৌতুক প্রথার প্রচলন নেই। এদের সমাজে যৌতুক একেবারেই নিষিদ্ধ ও পাপের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এখনো বিয়েতে বরকে কনের বাবার কাছে পন বিহার পণ হিসেবে তিন কুড়ি বার টাকা পরিশোধ করতে হয়। একসময় এ টাকা পরিশোধ করতে বরপক্ষকে অনেক বেগ পেতে হতো। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় অনেক কিছু বদলে গেলেও কড়াদের বিহার পণের পরিমাণ আগের মতোই আছে। কড়াদের আদিবাসী রীতিতে পণ পরিশোধের পরেই বিয়ের লগোন বাঁধতে হয়।

সুনিয়া কড়া জানান বিয়ের লগোন বাঁধার নিয়মটি। কড়া ভাষায় এটি লগোন বান্ধা। কড়াদের আদিবাসী রীতিতে বিয়ের পাঁচ দিন আগে লগোন বাঁধতে হয়। এটা একটি বিশেষ আচার। এ আচার পালন করতে হয় সকালের দিকে। লগোন বাঁধতে কাঁচা হলুদ, কাঁঠাল পাতা, আরোয়া চাল, দুর্বাঘাস, আট আনা পয়সা, একটি পিঁড়ি, সাদা মার্কিন কাপড়, সুতা প্রভৃতি লাগে।

লাগান বান্ধা এর সময় দুই পক্ষের মাহাতো মুখোমুখি বসেন। তাদের পেছনে বসেন দুপক্ষের পাঁচজন করে লোক। প্রথমে দুটি কাঁঠাল পাতাকে ভাঁজ করে বিশেষ ধরনের দুটি ঠোঙা তৈরি করা হয়। ঠোঙায় রাখা হয় হলুদ, আরোয়া চাল, আট আনা, দুর্বাঘাস প্রভৃতি। অতঃপর দুটি আলাদা সুতায় প্রতিটিতে বিশেষ ধরনের পাঁচটি করে গিট দেওয়া হয়। পরে একদিন অতিবাহিত হলেই প্রতিটি পক্ষই সুতার একটি করে গিট খুলে ফেলে। এভাবে বিয়ের দিনকে প্রতীকী হিসেবে রেখে এর আগের দিনগুলোকে গিট দেওয়া ও তা একেএকে খুলে দেওয়া হয়।

অতঃপর সুতা দুটিকে রাখা হয় কাঁঠাল পাতার ঠোঙায়। বড় সাদা মার্কিন কাপড় নিয়ে এর দুপাশেও বিশেষ ধরনের গিট দেওয়া হয়। প্রথমে কাঁঠাল পাতার ঠোঙা দুটিকে দুপক্ষের মাহাতো পাঁচবার অদলবদল করে নেন। এরপরই ঠোঙা দুটিকে রাখা হয় সাদা মার্কিন কাপড়ের দুই গিটের ভেতরে। দুই পক্ষের মাহাতো তখন টান দিয়ে কাপড়ের গিটকে শক্ত করে বেঁধে দেন। কড়া ভাষায় একেই বলে লাগান বান্ধা। কড়ারা এ সময় গান ধরে :

বাবা লাগানো বান দিয়া
লানে সুতে লাগানা বান দিয়া
বাবা লাগানো বান দিয়া…
এরপর লগোন বান্ধা সাদা কাপড়টিকে রাখা হয় একটি পিঁড়ির ওপরে। এটিকে সবাই তখন দুর্বাঘাস ছিটিয়ে একে একে ভক্তি দিতে থাকে। কড়ারা এটিকে বলে লাগান চুমালিয়ে।

এরপরই দুই পক্ষের বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বর বা কনেকে হলুদ মাখানো হয়। একে হারদি বলে। এ সময় সবাই হাড়িয়া খায় ও নাচ-গান করে আনন্দ করে। এ সময় থেকে বর-কনের গোসল করা বারণ থাকে। গোসল করানো হয় পাঁচ দিন পর, বিয়ের দিন।

কড়াদের আদিবাসী সমাজে বিয়ের হলুদ দেওয়ারও বিশেষ নিয়ম রয়েছে। সুনিয়া বলেন, ‘যে হলুদ ছোঁয়াবে সে ছেলে হলে বর বা কনেকে হলুদ স্পর্শ বা ছোঁয়াবে শরীরের নিচ থেকে ওপরের দিকে। এ সময় ছেলেরা গাইবে :
একা পুতা একা হামে
দেখালু মাইগে
তাকা ওয়াহি হারাদি চারহার।

আর যে হলুদ ছোঁয়াবে সে মেয়ে বা নারী হলে বর-কনেকে হলুদ স্পর্শ বা ছোঁয়াবে শরীরের ওপর থেকে নিচের দিকে। তখন তাকে গাইতে হবে :
একা পুতা একা হামে
দেখালু মাইগে
তাকা ওয়াহি মাইরে হারা দি নাবাই।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৬ জুলাই ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

  1. ভারত বর্ষের কড়া(কডা) আদিবাসীর গত্র বা পেরিস :-(১)সামাৎ(রঘু রাজা), (২)সাপু(মন্ত্রি), (৩)বুৎকুৎ(বামুন- বামড়ে) (৪)নাগডু(নাগা), (৫)হুরেৎ(খুন্টু), (৬)সুরেন, (৭)হেমব্রম, (৮)তীরর্কি, (৯)কিশাড়, (১০)টুন্ডু, (১১) বালিশায়, (১২)তুমড়াং, (১৩)লুদাম(চিডু), (১৪)হর, (১৫) গাডি(গাড্ডি), (১৬) কাউরী, (১৭)হাঁসদা, (১৮)বারদা, (১৯) তুরসিদ(তুলসী), (২০) মুডাৎ, (২১) খাঁগার,(২২) সানদোয়ার, (২৩) হুরদুয়ার, প্রভৃতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button