কলাম

তালে তালে লাঠিখেলা

বাংলাদেশে লাঠিখেলার প্রচলন শুরু হয় ওস্তাদ সিরাজুল হক চৌধুরীর হাত ধরে। অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৩ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। দেশ ভাগের পর তা পূর্ব পাকিস্তান লাঠিয়াল বাহিনী এবং স্বাধীনতার পর তা বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীতে নামকরণ করা হয়। লাঠিয়ালদের সংগঠিত করা ও ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রাখাই এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।

খবরটি জানাল জিয়নকাঠির বন্ধু জায়েদ। রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠে হবে লাঠিখেলা। চলছে বৈশাখী মেলা। মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবেই আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার। বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে আসবে বেশ কয়েকজন লাঠিয়াল সরদার। লাঠিখেলা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনাটিও ঠিক হয় মুঠোফোনে।

unnamed
ছবি: সালেক খোকন

২০ এপ্রিল ২০১২। ঘড়ির কাঁটায় সকাল নয়টা ছুঁই ছুঁই। সূর্য তখনো তপ্ত আলো ছড়ায়নি। পুলিশ লাইন মাঠ। এক কোণে লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠিয়ালেরা। লাঠিখেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। পোশাক পাল্টে বিশেষ ধরনের পোশাক পরছেন তাঁরা। কেউ কেউ হাতের লাঠিটি ঘুরিয়ে পরখ করে নিচ্ছেন। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ থেকে আছে তরুণ বয়সী লাঠিয়াল। দু-একজন নারী লাঠিয়ালও এসেছেন।
চোখ যায় মাথায় গামছা বাঁধা তিন যুবকের দিকে। পরনে রঙিন লুঙ্গি ও ধবধবে সাদা গেঞ্জি। দুজনের গলায় ঝুলছে ঢোল ও টরবরি। একজনের হাতে কাঁশি। বাদ্যগুলোতে তাল তোলার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
লাঠিয়াল সরদার রবজেল ইসলাম। সত্তরোর্ধ্ব বয়স। কুষ্টিয়ার মিরপুরের কবরবাড়িয়া গ্রামের লাঠিয়াল তিনি। খেলার আগে শিষ্যদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। কথায় কথায় জানালেন কী কী খেলা দেখানো হবে আজ। তাঁর ভাষায়, ‘একটা হলো নাটির আড়, একটা ছড়ির আড়, একটা জুড়া নাটি, নাটির ফাইটিং, নড়ির আড়, নাটি ঘুরানো, দুই নাটির বাটুল ঘুরানো, দড়ির বাটুল ঘুরানো, ছুড়ার খেলা, কুড়ুল খেলা, চরদখলের খেলা।’
কৃষিকাজের পাশাপাশি লাঠি খেলেন রবজেল সরদার। প্রফুল্ল মনে জানালেন ষষ্ঠ সাফ গেমস ও ভারতের নিখিল বঙ্গ নববর্ষ উৎসব সমিতির আমন্ত্রণে কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লাঠিখেলার স্মৃতির কথা।
কতজন শিষ্য আপনার?
‘শিষ্য নয়, আমার ছেইলে। নিজের হাতে তৈরি করা ৭০ জন।’
লাঠি তৈরি করেন কীভাবে?
‘নাটি অয় বাঁশের। নাটির যে জায়গাটা ব্যাঁকা, সেই জায়গাটা আগুনে ছ্যাঁক দিয়ে গরম করে চাপন দিতে অয়। এটা তো দশের খেলা। ১০ জনে দেখে। খেলতে আবার আমরা ১০ জন একত্র অই।’

unnamed-3
ছবি: সালেক খোকন

ঢোলের ছন্দ চলে অবিরত। দর্শকদের বৃত্তাকার ভিড় জমে লাঠিখেলাকে ঘিরে। একেক দলের লাঠিখেলা একেক ধরনের। খেলার সঙ্গে ঢোলের তালও যায় পাল্টে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় দর্শকদের করতালি।
লাঠিয়াল সরদার মুন্নাব আলী। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। লাঠি খেলার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে। একটু পরই মাঠে নামবেন তিনি। প্রশ্ন করতেই ভারী কণ্ঠের মাপা মাপা উত্তর। কত দিন ধরে লাঠি খেলছেন? মুন্নাব আলী বলেন, ‘আমার বয়স যখন পাঁচ আর এখন বয়স ঊনসত্তর’। লাঠিখেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুস্থ মস্তিষ্ক, তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন লাঠিখেলার মূলমন্ত্র।’
লাঠিয়ালদের লাঠি অন্যায় কাজে যুক্ত থাকে কি না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘ষোলআনাই নিষেধ। প্রশিক্ষণ নেওয়ার শুরুতেই অগ্নিশপথ করেছি, আমাদের লাঠি কখনো কোনো সময় অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হবে না।’
লাঠিখেলা হারিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এই লাঠির সরদার বলেন, ‘মানুষের মনের বিকাশ, বিদেশি আভিজাত্য ও অপসংস্কৃতিই এর মূল কারণ।’ ভালোলাগার অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে তিনি বলেন, ‘লাঠি খেলে আমরা কোটিপতি হতে চাই না। খেলা দেখে মানুষ আনন্দ পায়, ওস্তাদ বলে সম্মান করে—এতেই আমরা খুশি।’
কথা থামিয়ে মুন্নাব লাঠিয়াল মাঠে ঢোকেন। মোটা একটি বাঁশের লাঠি তাঁর হাতে। দুই হাতে তা নানা ঢঙে ঘুরান তিনি। অসাধারণ সে লাঠিখেলার দৃশ্য। দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করে।
নিজের পর্বের অপেক্ষায় আছেন আরেক লাঠিয়াল সরদার। গোঁফ তাঁর পেঁচানো। যেন কোনো গল্পের লাঠি সরদারের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। নিজের পরিচয় জানাতে বলেন, ‘আমি পদ্মার চরের অসমান সরদার।’ বয়স তাঁর ৭০। বাড়ি কুষ্টিয়ার বারখাতা গ্রামে। বাবা ইব্রাহিম বিশ্বাস ও দাদা ইদু বিশ্বাসও ছিলেন নামকরা লাঠিয়াল সরদার। তাই লাঠিখেলা তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। কোন সময়টাতে লাঠিখেলা বেশি হয়? উত্তরে তিনি বলেন, ‘ফসল ঘরে তোলার পর আর মহরমের সময়টাতে লাঠিখেলা বেশি হয়।’ তিনি বলেন, ‘তালে তালে চলে লাঠিখেলা। ফলে লাঠিয়াল ও দর্শকদের মনে আনন্দের দোলা লাগে।’
ডাক পড়তেই হুঙ্কার দিয়ে মাঠে নামেন অসমান সরদার। তাঁকে আক্রমণ করে ২০-২৫ জন লাঠিয়াল। শুরু হয় লাঠির লড়াই। খটখট শব্দে দর্শকদের মাঝেও নামে নীরবতা।
বাংলাদেশে লাঠিখেলার প্রচলন শুরু হয় ওস্তাদ সিরাজুল হক চৌধুরীর হাত ধরে। অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৩ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। দেশ ভাগের পর তা পূর্ব পাকিস্তান লাঠিয়াল বাহিনী এবং স্বাধীনতার পর তা বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীতে নামকরণ করা হয়। লাঠিয়ালদের সংগঠিত করা ও ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রাখাই এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।
ইতিহাসের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে লাঠিয়ালদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও লাঠিখেলা রক্ষায় নেই কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। খেলার ফাঁকে এভাবেই নিজের অভিমত প্রকাশ করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ্ আল-মামুন।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোর খোলাকলম বিভাগে, প্রকাশকাল: ৬ মে ২০১২

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button