কীর্তিমান বাঙালি

শিল্পী আবদুস সবুর’র কথা

তিনি একজন প্রখ্যাত শিল্পনির্দেশক। তাঁর বাড়ির নিচতলাতেই ঘটত আমাদের সম্মিলন। দিনরাত কোরাস গানের রিহার্সেল আর ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে গণসংগীত পরিবেশনই ছিল আমাদের কাজ। সংগঠনটির নাম ছিল উত্তরসূরী। স্মরণীকা কিংবা অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রের ডিজাইন প্রয়োজন হলেই চলে যেতাম ওপরতলায়। কখনও কখনও চাঁদার রশিদসহ দলবেধে হাজির হতাম তাঁর কামরায়। তিনি গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন আমাদের কথা। প্রশ্নও করতে দু’একটা। গম্ভীরমুখে উঠে যেতেন খাশ কামরায়। অতঃপর একটি খাম এগিয়ে দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করতেন। প্রেরণা দিতেন গণমানুষের কাজ করাতে। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। মাঝেমধ্যে বারান্দার আরাম কেদারায় বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আকাশপানে। দূর থেকে আমরা তা দেখতাম।

বলছিলাম প্রয়াত শিল্পী আবদুস সবুরের কথা। বর্তমান প্রজম্মের কাছে বিস্মৃত হলেও পঞ্চাশের দশকে এদেশের চিত্রকলার পরিমন্ডলে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল এক শিল্পীব্যক্তিত্ব। তাঁর মনন- মেধা ও মনীষার মধ্য দিয়ে তৎকালে শিল্পশিক্ষক ও শিল্পানুরাগীদের মধ্যে তিনি ভিন্ন আসন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তৎকালে তাঁর সৃষ্টিতে ছিল বহু ভাবনার প্রকাশ। বাস্তবধারা ও বিমূর্ত যে-কোন কাজেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

তাঁর জীবনদশায় কোন চিত্রকলা প্রদর্শনী না হলেও বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসের উদ্যোগে গত ৩১ জানুয়ারি ২০১২ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেঙ্গল শিল্পালয়ে হয়ে গেল প্রয়াত এই কীর্তিমান শিল্পীর প্রথম একক চিত্রকলা প্রদর্শনী ‘অন্বেষা’।
শিল্পী আবদুস সবুরের শৈশব কেটেছে পুরোনো ঢাকার কলতাবাজারে ২৯ নং হাজী আবদুল মজিদ লেনে। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীকালে তৎকালীন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট ( বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ফাইন আর্টস্-এ  স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৫ সালে। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের আস্থাভাজন ছাত্র ছিলেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন লাহোরে। সেই সময় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। আবদুস সবুর প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের কাছে সিনেমা ফটোগ্রাফি শেখেন। ১৯৬২ সালে তৎকালীন এফডিসি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন)-তে প্রধান শিল্পনির্দেশক হিসেবে যোগদান করেন।
একটি রক্ষণশীল মুসলিম পারবারে জন্ম নিয়েও তিনি বেড়ে ওঠেন মুক্তমন নিয়ে। ১৯৪৩  -এর মন্বন্তর , ’৪৭-এর দেশ ভাগ, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনসহ নানা আন্দোলন-সঙগ্রামে তিনি যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন মুকুল ফৌজের সদস্য ছিলেন তিনি। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সত্যেন সেনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
দেশের চলচ্চিত্রে অমামান্য কৃতিত্বের জন্য বাচসাস পুরস্কার, জহির রায়হান পুরস্কার, পাঁচটি জাতীয় পুরস্কারসহ বহু সম্মামনা লাভ করেন তিনি।
আবদুস সবুরের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৪ জানুয়ারি, পুরোনো ঢাকার রোকনপুরে এবং তিনি ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন।

তথ্য ও ছবি : বেঙ্গল শিল্পালয়

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button