কীর্তিমান বাঙালি

শেখ আবদুল হাকিম : মাসুদ রানার মাঝেই বেঁচে থাকবেন

তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। ওই বয়সেই ভারত ভাগের পটভূমিতে রচনা করলেন একটি অসাধারণ মৌলিক উপন্যাস। নাম দেন ‘অপরিণত পাপ’। সেবা প্রকাশনী থেকেই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে। শেখ আবদুল হাকিমের ওই উপন্যাস সম্পর্কে প্রকাশনীর কর্ণধার ও লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের অভিব্যক্তি ছিল এমন—‘যদি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের আন্তরিক মত জানতে চান, তাহলে আমি বলব বইটি সত্যিই আমাদের সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রম। পাণ্ডুলিপিটি পড়ে আমি এতই বিস্মিত, মুগ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম যে সারাটা দুপুর আমাকে বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে হয়েছিল।’

আশির দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকার পত্রিকা অফিসগুলোতে যে আড্ডা হতো তার মধ্যে সেরা ছিল রহস্য পত্রিকার সান্ধ্য আড্ডা। সেখানে চা ও চানাচুর খাওয়ানোর বরাদ্দ দেওয়া হতো অফিস থেকেই। কবি ও লেখকদের জমায়েত থাকলেও সেই আড্ডা সবচেয়ে বেশি জমিয়ে রাখতেন শেখ আবদুল হাকিম ও রকিব হাসান। প্রচণ্ড আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন হাকিম। জানতেনও অনেক। মানুষটা ছিলেন অতি অমায়িক, হাসিখুশি। নির্মল মনের মানুষ। শুধু অনুবাদক নন, সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকও ছিলেন তিনি। সাহিত্যিক বলতে যে ধরনের মানুষের ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে পোশাকে-আশাকে তেমনি খাঁটি মানুষ ছিলেন তিনি।

কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী, মাহমুদুল হকসহ আরো অনেকের সঙ্গে সখ্য ছিল শেখ আবদুল হাকিমের। তবে অপরিসীম বন্ধুত্ব ছিল বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে। বন্ধু বিপদে আছেন খবর পেলেই বুলবুল চৌধুরী অসুস্থ শরীরেই সূত্রাপুর থেকে ছুটতেন নন্দীপাড়ায়, হাকিমের বাড়িতে। তাস খেলা ছিল প্রিয়। সপ্তাহে অন্তত একটি দিন তাঁরা তাস খেলায় ডুবে থাকতেন। তাঁদের এমন বন্ধুত্ব হয়তো সৃষ্টিকর্তাও ভাঙতে চাননি। তাইতো একই দিনে দুই বরেণ্যকে তুলে নিয়েছেন দূর অজানায়।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম সম্পর্কে ওপরের অভিমতগুলো তাঁর সতীর্থদের দেওয়া। পঁচাত্তর বছর বয়সে এই বরেণ্য লেখক প্রয়াত হন শনিবার (২৮ আগস্ট), রাজধানীর বাসাবো পূর্ব নন্দীপাড়ার নিজ বাড়িতে। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টের রোগে ভুগছিলেন তিনি।

জন্ম ১৯৪৬ সালে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। বাবা শেখ আবদুর রফিক। তাঁরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। দেশভাগের পর চলে আসেন ঢাকায়।

গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেখ আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হন। সেবার জনপ্রিয় সিরিজ ‘কুয়াশা’র দশম কিস্তি দিয়েই যাত্রা শুরু। তবে এর আগেই লিখে ফেলেন নিজের প্রথম উপন্যাসটি।

সেবা প্রকাশনীর রহস্য পত্রিকার প্রথম চারটি সংখ্যা বের হয় ১৯৭০ সালে। এরপরই তা থেমে যায়। পরে ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয় প্রথম সংখ্যাটি। সেখানে একে একে বেরোয় ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্পাই থ্রিলার, কিশোর ক্লাসিক; বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিকগুলোর কিশোরোপযোগী অনুবাদ, কিশোর থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস। ফলে রহস্য পত্রিকাও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় থেকে বহু বছর শেখ আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীর ‘রহস্য পত্রিকা’র সহকারী সম্পাদক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন।

সেবা ও শেখ আবদুল হাকিম—এই দুটি নাম প্রায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেবা প্রকাশনীর জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস সিরিজ ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানার’ নামের স্পাই থ্রিলার কাহিনির অসংখ্য বইয়ের নেপথ্য লেখক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া নিজ নামেও এই ধারার বহু রোমাঞ্চ উপন্যাসের অনুবাদ ও মৌলিক উপন্যাস রচনা করেন। সেই আটের দশকেই পাঠকদের মধ্যে বিপুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয় তাঁর অনুবাদে ‘মারিও পুজোর গডফাদার’। ওই চারটি বইয়ের প্রচ্ছদও ছিল তাক লাগানো। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘দড়াবাজ স্পাই’, কেন ফলেটের দ্য ম্যান ফ্রম সেন্ট পিটার্সবার্গ অবলম্বনে দুই খণ্ডে ‘আততায়ী’, আগাথা ক্রিস্টির কাহিনি অবলম্বনে ‘কামিনী’ ইত্যাদি। সে সময় বইগুলো দেশের পাঠক সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি ও ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের আড়াই শরও বেশি বইয়ের নেপথ্য লেখক ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম।  সেবা প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে এসে দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত অনুবাদ ও মৌলিক গ্রন্থ রচনার কাজ করেছেন। ফলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ জনপ্রিয় হলেও রোমান্টিক, অ্যাডভেঞ্চারসহ নানা বিষয়ে বই লিখেছেন তিনি।

শেখ আবদুল হাকিমের মতো একজন পেশাদার লেখকের জীবদ্দশায় সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে মনে করেন অনেকেই। যে ধরনের সাহিত্যের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, এ দেশে সেটি ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল সাহিত্য হিসেবে দেখা হয় না। অথচ সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন হলে অনেক উঁচুতে স্থান পেতেন এই লেখক ও অনুবাদক। তবু ‘মাসুদ রানা’র মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। ছায়া-লেখক হিসেবে সেবা প্রকাশনীর সব পাঠকের মনে অনন্তকাল জীবন্ত থাকবেন শেখ আবদুল হাকিম।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকণ্ঠের শিলালিপিতে, প্রকাশকাল: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

একাত্তরকে জানতে যুক্ত থাকুন ইউটিউব চ্যানেলটিতে: সালেকখোকন

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button