কীর্তিমান বাঙালি

মোনাজাতউদ্দিন – এই দিনে স্মরি তোমায়

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে মোনাজাতউদ্দিন নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক, যাঁর কর্মপ্রেরণার শেকড় সঞ্চারিত ছিল গ্রামীণ সমাজ-জীবনের তলদেশ অবধি । পেশাগত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, স্বীয় সাধনা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মপদ্ধতিগুণে তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। মফস্বল সাংবাদিকতার নামে যে উন্নাসিক মানসিকতা  ছিল নগরবাসী মানুষের, তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় তা দূর করতে সক্ষম হন। বস্ত্তুত, মফস্বলের সাংবাদও যে গুরুত্বের ভিত্তিতে সাংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হতে পারে তারই দৃষ্টান্তস্থাপক মোনাজাতউদ্দিন । তিনি একজন সত , সাহসী ও শ্রমনিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন । তাঁর পেশা ও নেশা ছিল পথে পথে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করা ।  এ – পথে প্রধানত উত্তর বাংলার জনপদ, যদিও সমগ্র বাংলাদেশেই ছিল তাঁর সংবাদ আহরণের ক্ষেত্র । মাটির উর্বরতার চেয়ে রুক্ষতা ও শস্যহীনতার দিকেই তাঁর নজর ছিল বেশি । মানুষের তৈলাক্ত পোশাকি চেহারার ভেতরের কদর্য ও কন্কালসার নিরন্ন নির্যাতিত জনমানুষের জীবনবৃত্তান্তই তাঁর হাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে । সমাজ – জীবনের দগদগে ঘা, প্রশাসনের ঘাপলা, সুবিধাভোগীর দাপট,ভূমিহীন-গৃহহীন ভাসমান মানুষের বাঁচার লড়াই, আশ্চর্য দক্ষতায় ও ঋজু ভাষায় তিনি পাঠকের কাছে কমিউনিকেট করতে পারতেন । পাঠক তাঁর সংবাদ বা প্রতিবেদন পড়ে প্রথমে লজ্জায় কিংবা বেদনায় মাথা নিচু করেন এবং শেষ অবধি শিরদাঁড়া টানটান হয়ে ওঠে- প্রতিবাদে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয় । এখানেই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে, বস্ত্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে মোনাজাতউদ্দিনের সফলতা ।

তাঁর মতো পেশার প্রতি এত বেশি আন্তরিক সাংবাদিক দ্বিতীয়জন খুজেঁ পাওয়া কষ্টকর । প্রায় সার্বক্ষণিক সংবাদকর্মী হিসেবে কেবল সংবাদ প্রেরণ বা প্রকাশ করেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না । সংবাদ-উপকরণ, সংবাদের পেছনের মানুষজন ও সংবাদশিল্পের সার্বিক কল্যাণ ছিল তাঁর একান্ত বিবেচনায় । এ – মন্তব্যের প্রচুর প্রতাণ বিদ্যমান তাঁর প্রকাশিত পথ থেকে পথে, সংবাদ নেপথ্য, কানসোনার মুখ, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, নিজস্ব রিপোর্ট, ছোট ছোট গল্প, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গ্রামীণ পর্যায় থেকে, চিলমারীর একযুগ , শাহা আলম ও মুজিবরের কাহিনী, লক্ষ্মীটারী ও কাগজের মানুষেরা গ্রন্থে । ব্যক্তিত্ব-অভিজ্ঞতা, জীবনদৃষ্টির গভীরতা, ভাষার ঐশ্বর্য ও নিপুণ উপস্থাপনগুণে এসব সাংবাদবিষয়ক গ্রন্থ যেন সংবাদসাহিত্য হয়ে উঠেছে । সৃজনশীল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও প্রভূত সম্ভাবনা ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত আছে তাঁর প্রকাশিত স্বল্পসংখ্যক গল্প, ছড়া ও নাটকে ।

মোনাজাতউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর শহরে । তিনি রংপুরের কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর কারমাইকেল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। কলেজে পড়ার সময়ই তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় মনোযোগী হন। ছড়া-কবিতা-গল্প রচনা এবং সাময়িক পত্রিকার প্রচ্ছদ অংকনে সুনাম অর্জন করেন। বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় পিতার মুত্যুতে পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে এবং তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। ফলে তার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে এবং পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাশ করেন। মোনাজাতউদ্দিন প্রধানত দৈনিক সংবাদ-এর উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে এবং দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকাতেও কাজ করেছেন।

১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় মোনাজাতউদ্দিন গাইবান্ধার কালাসোনার চরের নিকট ফেরির উপর থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরি এই প্রতিথযশা সাংবাদিককে।

তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button