কলাম

ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সমাধান নয়

করোনাভাইরাসজনিত রোগের (কভিড-১৯) বিস্তার রোধে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব কলেজ ও বিদ্যালয় আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে সব স্তরের শিক্ষার্থীরা আবারও সেশনজটসহ শিক্ষা জীবনের অনিশ্চিত পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। এরই মধ্যে কভিড মহামারীর কারণে স্থগিত হওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। ফলে স্থগিত হওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। তাহলে কীসের ভিত্তিতে পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হলো এবং কোন তথ্যের ভিত্তিতেই আবার পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা এলো? সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

করোনা সংক্রমণের বর্তমান অবস্থার ভেতরই চলছে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো। বাজার ও শপিং মলগুলো খোলা। গণপরিবহনও চলছে আগের নিয়মে। স্টেডিয়ামে চলছে ক্রিকেট খেলাও। বিয়ের অনুষ্ঠানসহ ঘরোয়া রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও বন্ধ নেই। জেলাপর্যায়ে অনেক জায়গাতেই মেলা আয়োজনের খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে। কভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ঢাকায় বাণিজ্যমেলা বন্ধের সুপারিশ করলেও তা এখনো চলছে কিছু বিধিনিষেধের ভেতরে। এত কিছু খুলে রাখা গেলে কেন তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করে দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? এ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। চলছে সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধে সমালোচনাও। করোনাভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধে সরকার আন্তরিক থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে তা চালু রাখা যায় সে বিষয়ে আরও চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অভিভাবকরা। করোনা সংক্রমণের সময়টায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। বিশেষ নিয়মে (কথিত অটোপাস) পাস করিয়ে দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভর্তির কার্যক্রম শেষ হয় অনেক দেরিতে, ২০২১ সালের শেষের দিকে। ফলে তাদের জীবন থেকে এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে একটি বছর। সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পুরোপুরি অনার্স ক্লাস শুরু করতে পারেনি। এরই মধ্যে আবারও ক্লাস বন্ধ হওয়ার নির্ধারিত সময়ে সব ব্যাচের পরীক্ষা পেছাবে। শুধু অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার গুণগত মানও বজায় থাকবে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোবে কত বছরে? তাই এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাগুলোও জানতে চায় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছুটি বাতিল ও অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে দ্রুত শিক্ষার্থীদের পাঠদান সমাপ্ত করার পরিকল্পনা থাকলেও এর মাধ্যমে তারা কতটুকু শিখছে? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়! করোনা সংক্রমণকালে উচ্চশিক্ষায় ক্ষতি কতটুকু হচ্ছে? সেটি জানতে কথা হয় দুজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। রুয়েটে ‘ট্রিপল-ই’-তে পড়ছেন মো. তালহা সাদ। শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলে ২০১৯ ব্যাচের এই শিক্ষার্থী ২০২২ সালে তৃতীয় বর্ষে থাকার কথা। কিন্তু ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় তারা এখনো দ্বিতীয় বর্ষের গন্ডি পেরোতে পারেনি। এখন আবার সশরীরের ক্লাস বন্ধ হওয়ায় তারা হতাশার মধ্যে পড়েছেন বলে জানান। তার ভাষায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অধিক। তারা অন্যদের তুলনায় সচেতনও। তাদের ভ্যাকসিন কার্যক্রমও সমাপ্ত করেছে সরকার। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাস অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল। তা না হলে শিক্ষার্থীরা যেমন মানসম্পন্ন শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি নির্দিষ্ট সময়ে বের হতে না পারলে তাদের ভেতর নানা হতাশাও কাজ করবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশও।’

এ প্রসঙ্গে প্রায় একই মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাহাতও। অনলাইনে চারুকলার ক্লাসে কী সব শেখা যায়? এমন প্রশ্নে মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘সশরীরে দুই মাসের ক্লাসে যা শিখেছি গত দুই বছরের অনলাইন ক্লাসেও তা শিখতে পারিনি।’ তার মতে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই শতাধিক শিক্ষার্থী নেই। যেহেতু অধিকাংশের ভ্যাকসিন নেওয়া আছে তাই সরকারি নিয়মেই সশরীরের ক্লাস না হওয়ার কারণ দেখি না। তা ছাড়া হলগুলো খোলা আছে। বরং সেখানেই অধিক শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এখন না হলেও করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবার আগে সশরীরে ক্লাস শুরু করা উচিত।’

এই দুই শিক্ষার্থীই মনে করেন, করোনা পরিস্থিতি রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে এমনটা না ভেবে সরকারের উচিত করোনা মাথায় রেখেই শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। যেখানে অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি সশরীরে ক্লাসের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা যেমন মানসম্পন্ন শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি দীর্ঘদিন বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ রাখার কারণে মারাত্মক সেশনজটও তৈরি হবে, যা সমাধান করা সরকারের পক্ষেও কঠিন।’ তাই এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে এই শিক্ষার্থীরা।

করোনায় কতটুকু ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা? করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে এবং কভিড-১৯ মহামারী শুরুর দুই বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে শিশুদের পড়াশোনার ওপর মহামারীর প্রভাব নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।

সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় তা পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করেছে, তাদের নিয়মিত পুষ্টিপ্রাপ্তির উৎস কমিয়ে দিয়েছে এবং তাদের নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ক্রমেই উঠে আসা তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে যে, কভিড-১৯ শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চহারে উদ্বেগ ও বিষণœতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়ে, কিশোর-কিশোরী এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীরা অধিক হারে এই সমস্যাগুলোর সম্মুখীন।

ইউনিসেফের শিক্ষাবিষয়ক প্রধান রবার্ট জেনকিন্সও বিষয়টি নিয়ে খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা শিশুদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রায় অপূরণীয় মাত্রার ক্ষতি প্রত্যক্ষ করছি। তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটাতে হবে এবং শুধু বিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেওয়াই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের নিবিড় সহায়তা প্রয়োজন। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক বিকাশ এবং পুষ্টি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে স্কুলগুলোকে শুধু শেখানোর নির্ধারিত গ-ির বাইরেও যেতে হবে।’

করোনা সংক্রমণের সময়টায় গ্রামপর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও টিকা প্রদান কার্যক্রমসহ বর্তমান সরকারের অনেক উদ্যোগই প্রশংসিত হয়েছে। তাই সরকারের শিক্ষাবিষয়ক পরিকল্পনাগুলো আরও সুচিন্তিভাবে নেওয়া উচিত। ঢালাওভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নয়। বরং শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান কার্যক্রম সমাপ্ত করার পাশাপাশি বিশ^বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও শিশু শ্রেণির শিক্ষাকার্যক্রম বিষয়ে আলাদা আলাদা পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণই হতে পারে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৭ জানুয়ারি ২০২২

© 2022, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button