কলাম

নদী রক্ষায় হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন জরুরি

এক নদীর জন্ম নিয়ে চাকমা সমাজে প্রচলিত লোককথা দিয়ে শুরু করছি। এক গ্রামে ছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি বেশ অলস ছিলেন। এতই অলস যে কলার খোসা পর্যন্ত ছাড়িয়ে খেতে চাইতেন না। তার ঘরে দুই কন্যা। তিনি কোনো কাজই করতেন না। ফলে জুমচাষের ভার ছিল কন্যাদের ওপর। বৈশাখ মাস। খুব ভোরে দুই বোন ছুটলেন জুমক্ষেতে। চাষের জন্য পাহাড় তৈরি করতেই কেটে যায় সারা দিন। তবুও কাজ শেষ হয় না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। চারদিকে নামে অন্ধকার। প্রচন্ড বাতাস বইছে চারপাশে। এদিক-ওদিক আশ্রয় খুঁজতে থাকে তারা। কিন্তু না, কোথাও কোনো বাড়িঘর নেই।

দুই বোন তখন কপাল চাপড়ে কাঁদতে থাকে। বড়বোন তখন উচ্চকণ্ঠে বলে সাপ-ব্যাঙ, দেবতা-দানব, ভূত-প্রেত, রাজা-প্রজা যেই এখানে একটি ঘর তুলে দেবে, আমি তাকেই বিয়ে করব। ওখানেই ছিলেন টিপরার রাজপুত্র। তিনি বিরাট এক সাপের বেশে এসে বাঁশ দিয়ে ঘর তুলে দেন। ওই ঘরেই আশ্রয় মেলে দুই বোনের। বড় বোন তখন ওই সাপকেই বিয়ে করেন।

সকাল হতেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন তাদের অলস বাবা। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ওই সাপটিকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। তখনই সাপরূপী রাজপুত্রের নিথর দেহ পড়ে থাকে মাটিতে। বাবার এমন আচরণে বড় মেয়ে ভীষণ কষ্ট পায়। মনের দুঃখে ওখানে বসেই সে কাঁদতে থাকে। দুই চোখে অবিরত জল পড়ে। দিনে দিনে ওই জল জমেই  তৈরি হয় একটি নদী। এরপর স্বামী হারানোর কষ্টে সে নদীতে ডুবেই মারা যায় মেয়েটি। নদীটির নাম গোমতী নদী। সে থেকেই চাকমাসহ পাহাড়িরা এ নদীকে বিশেষ ভক্তির চোখে দেখেন। তাদের নদীটি অতি পবিত্র।

নদী নিয়ে প্রচলিত এমন কাহিনীগুলো সাহিত্যের পাতায় বেঁচে থাকলেও এদেশের নদীগুলোর অবস্থা এখন মৃতপ্রায়। সীমাহীন দখলদারিত্ব, ব্যক্তিগত অসচেতনতা, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতার সুযোগে ধ্বংস হচ্ছে নদী।

কয়েকদিন আগেই পালিত হলো বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার পালন করা হয় দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভাইরাসমুক্ত বিশ্বের জন্য চাই দূষণমুক্ত নদী।’ ১৯৮০ সালে প্রথম ‘নদী দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেন কানাডার খ্যাতনামা নদীবিষয়ক আইনজীবী মার্ক অ্যাঞ্জেলো। পরে ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংস্থাগুলো নদী দিবস পালনে এগিয়ে আসে। প্রায় ৭০টির মতো দেশে কয়েক লাখ মানুষ এ দিবস পালনে নানা কার্যক্রমে অংশ নেন।

বাংলাদেশেও নদীপ্রেমীরা বিশ্ব নদী দিবস পালন করেছেন নানান আনুষ্ঠানিকতায়। নদীকর্মী মার্ক অ্যাঞ্জেলো ঘুরে বেড়িয়েছেন হাজার নদী, অনেক নদী পুনরুদ্ধারের উদ্যোগে সরাসরি জড়িত ছিলেন, নদীদূষণ রোধেও কাজ করেছেন। বর্ণমালার ক্রমানুসারে গড় গড় করে তিনি একের পর এক বলে যেতে পারেন নদীর নাম। ৭০ ছুঁই ছুঁই কানাডীয় এই নদীকর্মী মনে করেন, নদীর সুরক্ষায় মানুষকে আরও বেশি উদ্যমী হতে হবে। বিশেষ করে নদী দূষিত হওয়ার আগেই এর সুরক্ষায় সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা বাস্তবে কেমন?

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বলছে, এখন নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৬টির মতো। কিন্তু নদীগুলোর সংকটে পড়ার বড় কারণ এর দূষণ। অধিকাংশের মাঝখানে চর পড়েছে। সরু হয়ে যাচ্ছে নদীপথ। ফলে আগের রূপটি হারিয়ে অধিকাংশ নদীই মৃতপ্রায়। একসময় নদীতে ভট ভট আওয়াজ ছিল না। এখন নৌকাগুলোতে লেগেছে ইঞ্জিন। জ্বালানিবর্জ্য পড়ছে নদীতে। এক সময় নদীপাড়ের মানুষ মাছ ধরতেন জাল দিয়ে। এখন কারেন্ট জালের কারণে নদীর কিছুই বাদ পড়ে না। সব ধরনের জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদও উঠে আসে জালে। নদীতে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহারও বেড়েছে বহু গুণ। জালে গোল মাটির চাকা ব্যবহার করা হতো। সেখানে এখন ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিকের বোতল। লঞ্চ, ফেরি ও নৌকার শিক্ষিত বা নিরক্ষর সব যাত্রীই হাতের কাছের পলিথিন, পানি ও জুসের বোতল, কাগজ, কাপড় যাই হোক তা-ই নদীতে ফেলেন। ফলে দূষিত হয়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নদীর ইকোসিস্টেম।

পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণের মূল উৎস শিল্পবর্জ্য। প্রতিদিন রাজধানীতে ১৫ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৪ লাখ ঘনমিটারই অপরিশোধিত অবস্থায় ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোতে গিয়ে মেশে। শিল্পকারখানার বেপরোয়া দখল, দূষণ ও ভরাটের ফলে চট্টগ্রামে শীতলক্ষ্যা নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। পাশাপাশি বহু গুণে বেড়েছে নদীপাড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদী দখলের দৌরাত্ম্য।

নদী কমিশনের দেওয়া তথ্য মতে, একটিও নদী দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নদীর জায়গা দখল করে বাড়িঘর ও শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার তোলা হয়েছে। ঘরবাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। ফলে নদীদূষণসহ মূল নদীর প্রবাহ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এভাবেই হত্যা করা হচ্ছে নদীগুলোকে।

নদী নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে বলছে ‘মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্য সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সরকার আইনপ্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। এখন সবারই ভাবনা পরিবেশের জন্য নদীরক্ষা করা। যদি তা না করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ সব নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা দিয়ে নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে ‘আইনগত অভিভাবক’ উল্লেখ করে আদালত যে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে তৃণমূলে তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি এখনো। নদীরক্ষায় হাইকোর্টের ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বিশেষ প্রয়োজন। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতনতার পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও সোচ্চার হতে হবে।

কিছুদিন আগেও করোনাভাইরাসের তান্ডবের কারণে শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ ও বাণিজ্যিক তৎপরতা স্তিমিত হওয়ার সুযোগে প্রকৃতি ফিরে পেয়েছিল আপন প্রাণ। ফলে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান দ্বিগুণেরও বেশি উন্নত হওয়া ও জীববৈচিত্র্য পরিবর্তনের খবর উঠে আসে গণমাধ্যমে। অনেক ক্ষতির মধ্যেও করোনা আমাদের শিক্ষা দিল যে, আমাদের আচরণের জন্যই হচ্ছে প্রকৃতি ও নদীদূষণ, যা পাল্টাতে হবেই। নদীকে বাঁচাতে শুধু সচেতন হলে চলবে না, সবাইকে আইন মানতেও ‘বাধ্য’ করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও নদীরক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্র নদীরক্ষায় জিরো টলারেন্স দেখাবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ অক্টোবর ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button