কলাম

গুজব ও গণপিটুনিতে হত্যার দায় কার?

যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক  অনুসন্ধান করে দেখতে পান, মানুষ গুজব ছড়াতে পছন্দ করে। চেনা মানুষ বা তারকা এবং বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে গুজব বা অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সহজাত প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। নিজের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মানুষ কখনো কখনো বেশ স্বার্থপর ভূমিকাও নেয় এবং নির্দিষ্ট গুজব ছড়িয়ে দেয়। যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যেতে পারে, সেটি গুজব হিসেবে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

গুজব আর গণপিটুনি নিয়ে এখন চিন্তিত সারা দেশের মানুষ। ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ এমন মিথ্যে আর বিভ্রান্তিমূলক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। যার জের ধরে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। বেড়েছে প্রবল সন্দেহ প্রবণতাও। ফলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে উত্তেজিত হয়ে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশের কাছে সোপর্দ না করে নিজেরা বিচারহীন হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। এরকম ঘটনা ঘটছে সারা দেশেই। বেসরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ৩৬জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৯জন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এইসব গণপিটুনির শিকার অধিকাংশই হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। ভাববিনিময় ও প্রকাশভঙ্গির প্রতিবন্ধকতাই কাল হয়েছে তাদের। অথচ সরকার এদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বাস্তবায়নে সর্বোতভাবে কাজ করছে।

বাড্ডায় এক নারী তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। উত্তেজিত জনগণ কলাপসিবল গেইটের তালা ভেঙে টেনেহিঁচড়ে তাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বের করে এনে এই নৃশংস ঘটনা ঘটায়। মানুষ কতটা নির্মম হলে একটা মানুষকে এভাবে মারতে পারে! মাহারা ওই শিশুটির ছবি নিয়ে নানা সংবাদ উঠে আসছে গণমাধ্যমে। শিশুটির মুখের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। কত মানসিক ট্রমা কাটিয়ে বড় হতে হবে তাকে! যখন সে বড় হয়ে প্রশ্ন করবে কেন তোমরা এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছ আমার মাকে? কী উত্তর দেব আমরা? কী উত্তর দেবে এই দেশ?

যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পান, মানুষ গুজব ছড়াতে পছন্দ করে। চেনা মানুষ বা তারকা এবং বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে গুজব বা অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সহজাত প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। নিজের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মানুষ কখনো কখনো বেশ স্বার্থপর ভূমিকাও নেয় এবং নির্দিষ্ট গুজব ছড়িয়ে দেয়। ফলে ছোটখাটো কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব গুজব খুব দ্রুতগতিতে ছড়ায়। কিন্তু মানুষ কেন গুজব ছড়ানোর মতো প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না- সে বিষয়ে কয়েক বছর আগে একটি অনুসন্ধানী গবেষণার প্রতিবেদন ছাপা হয় একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যেতে পারে, সেটি গুজব হিসেবে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফলে ওই গুজবটি অন্যকে বলতেও মানুষ বেশি উৎসাহ বোধ এবং নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।’ যেটি মাঝেমধ্যেই ঘটে আমাদের দেশে। ২০১৩ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে হাস্যকর গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল বগুড়াসহ কয়েকটি শহরে। ফলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে তখন।

পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯ কোটি ৫ লাখ। যদিও এটি ২০১৮ সালের হিসাব। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য মতে, এদের মধ্যে ৮ কোটি ৪৭ লাখ মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী এবং বাকি ৮৩ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে এই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই গুজবগুলো ছড়িয়ে পড়ছে অধিকসংখ্যক মানুষের কাছে। কেউ কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই গুজবের পোস্টগুলো তৈরি করে বিভিন্ন পেইজ বা আইডির মাধ্যমে প্রমোট করে। সেইসব পোস্ট যাচাই-বাছাই না করেই লাইক বা শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে গুজবগুলো ছড়িয়ে পড়ে লাখো মানুষের কাছে। ফলে তৈরি হয় বিভ্রান্তি। গুজবের সংবাদকে সত্য ভেবে আতঙ্কিত বোধ করে মানুষ। সন্দেহ দানা বঁাঁধে মনে। এতে কখনো কখনো উত্তেজিত হয়ে ওঠে তারা।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুজব ছড়ানোর জন্য খুবই বিপজ্জনক জায়গা। এর আগেও ফেইসবুকের গুজবের কারণে ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা করা হয়েছিল। একইভাবে ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়। ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়ও ঘটেছিল হামলার ঘটনা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গত চার-পাঁচ বছরে গুজবের ঘটনায় গণধোলাইয়ে একশোরও বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগই ঘটেছে গরু রক্ষার ইস্যুকে কেন্দ্র করে। যেখানে গুজব ছড়ানো হতো হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। সরকারের হস্তক্ষেপে এক পর্যায়ে অ্যাপ কোম্পানিটি ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু নিয়ম বদলাতেও বাধ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ এমন সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার আগেই কেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকল, সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। কয়েকদিন আগেই তারা সক্রিয় হয়ে গুজবকে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে কয়েকশ ফেইসবুক পেইজ, ওয়েব পোর্টাল ও আইডি বন্ধ করে দিয়েছে। এই কাজটিই কেন তারা আগে করল না। এর মাধ্যমে কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা প্রকাশ পায় না?

‘ছেলে ধরা’ ও ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ গুজবকে ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করেছে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন হাজার হাজার অনলাইন পত্রিকাও। তারা তাদের লাইক ও হিট বাড়াতে নিউজগুলোতে বিকৃত তথ্য ও বিভ্রান্তিমূলক ছবি ব্যবহার করে, বিশ্বাসযোগ্য শিরোনাম বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফলে মানুষের মধ্যে গুজব বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। এই সব মানহীন তথাকথিত নিউজ পোর্টালগুলোর বিষয়েও সরকারের চিন্তা করা উচিত। গুজবে মানুষ কেন উত্তেজিত হয়ে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে? এ নিয়ে নানা জনের নানা মত উঠে আসছে গণমাধ্যমে। তবে যেই এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত হোক না কেন, দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে পুলিশকেই এই দায় নিতে হবে। আর যে সমাজে জাস্টিস সিস্টেমের বিকাশ হয়নি সে সব সমাজে এমন ঘটনা ঘটবেই। গুজব ছড়ানো ও গণপিটুনির মতো ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এমন কথা বলেছেন পুলিশ প্রধান। বর্তমান সরকারকে বিপাকে ফেলতে একটি চক্র নানা রকম অস্থিতিশীল ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে আগে থেকেই; এমন সংবাদ একাধিকবার গণমাধ্যমেও এসেছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠেÑ আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করছে? ঘটনা ঘটার আগেই কেন তারা তৎপর হয়ে উঠলেন না?

গুজব ছাড়ানো ও গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যার দায় আসলে কার? প্রথমত ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ এমন গুজবে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের ওপরই এই হত্যার দায় বর্তায়। তাই শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই নয় সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন মানুষকে মানবিক করে গড়ে তোলার প্রতিও। তাহলে এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে তৈরি করা খুব সহজ হবে না। এই ঘটনার দায় এড়াতে পারে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগও। বিচার বহির্ভূত কোনো হত্যাই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। গুজব ও গণপিটুনির ঘটনায় প্রত্যেক পরিবারকেই সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। এ ঘটনায় হত্যার দ্রুত তদন্ত ও বিচার হওয়া প্রয়োজন। এদের এমন সাজা হওয়া প্রয়োজন যা উদাহরণ সৃষ্টি করবে কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে অশুভ তৎপরতা চালানোর বিরুদ্ধে। তবেই মানুষ আইনের প্রতি থাকবে শ্রদ্ধাশীল। এজন্য আমাদের সবাইকেই কাজ করতে হবে।

প্রচ্ছদ অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৯ জুলাই ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button