কলাম

স্বাস্থ্যবিধির কালিহাতী মডেল

সামনেই কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধ আসছে। এরপর সারা দেশে মার্কেট বা দোকান এবং পরিবহন সেবা খুলে দেওয়ার আগে কালিহাতীর মতো সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার কার্যক্রমের মতো উদ্যোগ চালু করা যেতে পারে সারা দেশে। মানুষকে মাস্ক পরাতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে এটি সহায়ক হতে পারে।

সারা দেশ এখন করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উচ্চসংক্রমণের ভয়ে ভীত। এটি যেন ভারতের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে কারণে বিশেষজ্ঞ কমিটি পুরো দেশকে সাত দিনের শাটডাউনের প্রস্তাব করে। কিন্তু সরকার প্রথমে সীমিত পরিসরে এবং আগামী ১ জুলাই থেকে সাত দিন সারা দেশে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ ঘোষণা করেছে। যদিও সীমিত পরিসরের নামে প্রায় সবকিছুই চলেছে এত দিন। লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। মানুষের জীবিকা রক্ষার দিকটি অধিক প্রাধান্য দেওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু জীবন রক্ষা না পেলে জীবিকা দিয়ে কী হবে? আবার জীবিকা না টিকলে মানুষের জীবনইবা কীভাবে টিকবে? এমন আলোচনা দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে।

সংক্রমণ ঠেকাতে কেন কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে হচ্ছে এখন? সরকারদলীয় দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, মাস্ক পরাতে মানুষের অসচেতনতাই এখনকার পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরির দায়িত্বও সরকারের ওপর বর্তায়। মাঠপর্যায়ে সচেতনতা তৈরিতে দলের অংশগ্রহণ কতটুকু? সেটি তুলে ধরেননি নেতারা। তা ছাড়া করোনায় সরকারি বিধিনিষেধকে তুচ্ছজ্ঞান করে সরকারদলীয় এক সাংসদের সমাবেশ করার খবরও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। একজন আইনপ্রণেতার এমন কান্ড করোনায় সরকারের সব উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু ওই সাংসদের বিরুদ্ধে এখনো সাংগঠনিক কিংবা আইনগত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের খবর আমরা পাইনি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে একজন সাংসদই যদি করোনায় আইন ভঙ্গ করেন। তার বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে সরকার বিরত থাকে। তাহলে সাধারণ মানুষকে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আইন মানতে বাধ্য করা যাবে? ক্ষমতাসীন দলের উচিত দলীয়ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে তৃণমূল পর্যন্ত কঠোর নির্দেশনা দেওয়া।

করোনা প্রতিরোধে তৃণমূলে জনসচেতনতা তৈরিতে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার ওপর শুরু থেকেই বলে আসছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সাময়িকভাবে হলেও যেটি সুফল এনেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখানে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জনসহ অন্যরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরাতেও উদ্যোগ নিয়েছেন সবাই মিলেই। কেবল পুলিশ নয়, বিজিবি, গ্রামপুলিশ, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক ও জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগিয়েছে প্রশাসন। ফলে ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংক্রমণের হার ৫৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, পরপর দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ যদি প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে পরিস্থিতি বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর এ বিপর্যয় ঠেকাতে গেইম চ্যাঞ্জার হিসেবে তিনটি পদ্ধতির কথা বলছেন তারাভ্যাকসিন প্রদান, মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং রোগী বা সম্ভাব্য রোগীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা। এর মধ্যে প্রথমটি সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জিং হলেও অন্য দুটি তো হাতে আছে। সেসব কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেজন্য সোয়া বছরের বেশি সময়ও পেয়েছে সরকার। কিন্তু চলমান মহামারীর বছরব্যাপী অভিজ্ঞতা কী কাজে লাগল সেটি বোঝা যাচ্ছে না।

লকডাউন বা বিধিনিষেধ প্রয়োগের চেয়ে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় মানুষকে সচেতন করার চেষ্টাটা সামাজিকভাবে সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অথচ সারা দেশে কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মধ্যেই সেটি সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে মানুষকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কার্যকর নতুন কোনো কৌশল নিয়ে ভাবেনি সরকার।

এই পরিস্থিতির বিপরীতে কিছু সুন্দর দৃষ্টান্তও রয়েছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে শুরু হওয়া নতুন এক উদ্যোগ বা কৌশলের খবর আমাদের উদ্দীপ্ত করে, স্বপ্ন জাগায়, করোনায় টিকে থাকার প্রেরণাও জোগায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়টায় ভিন্নধর্মী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছেন সেখানকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। উপজেলায় সবার মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে গত ১১ জুন থেকে তিনি শুরু করেছেন ‘স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার’ সংগ্রহ অভিযান। এভাবে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা গেলে পুরো উপজেলার মানুষের জীবন যেমন বাঁচবে, তেমনি জীবিকাও রক্ষা পাবে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা। এ উদ্যোগে স্থানীয় সাংসদ ও টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক সার্বিক সহযোগিতা করছেন।

কেন এমন উদ্যোগ? গণমাধ্যমকে ইউএনও বলেছেনএখন মাস্ক পরিধানটাকে শতভাগ নিশ্চিত করা শুধু মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে পুরোপুরি সম্ভব নয়। সে কারণেই আমাদের এই সামাজিক আন্দোলন। যার যার জায়গা থেকে যদি সচেতন না হই তাহলে কঠোর আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে সেটি করা দুরূহ হবে। আমরা কালিহাতী উপজেলাকে বেশ কয়েকটি হটস্পটে ভাগ করেছি। যেখানে লোকসমাগম বেশি, বাসস্ট্যান্ড, হাটবাজার, চায়ের দোকান, সেবাপ্রদানকারী সংস্থা, ব্যাংক, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ প্রভৃতি এর আওতায়। এগুলোকে ভাগ করার পর সেখানে সেবা প্রদানকারী বা পণ্য বিক্রয়কারী বা পরিবহন মালিক বা শ্রমিকরা আছেন তারা স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার করছেন যে তারা নিজেরা মাস্ক পরবেন ও অন্যকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং মাস্ক পরিধানবিহীন কারও সঙ্গে পণ্য বিক্রয় বা সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

আমাদের উদ্দেশ্য একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা। অর্থাৎ তিনি একটা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করছেন স্বেচ্ছায়। এরপর মাস্ক না পরলে তার মনে হবে যে তিনি একটা অপরাধ করছেন। এই বোধটা যদি সৃষ্টি করা যায় তাহলেই করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ‘নাগরিক যদি নিজেই সচেতন হয় যে করোনা থেকে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে। তাহলে কিন্তু কঠোর লকডাউনেরও প্রয়োজন পড়বে না। তখন অর্থনৈতিক কর্মকা-ও সচল রাখা সম্ভব হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকা দুই-ই বাঁচবে। আমরা সেটিরই চেষ্টা করছি সম্মিলিতভাবে জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বণিক সমিতি, পরিবহন মালিক-সমিতির সদস্য ও নেতাদের সঙ্গে নিয়েই। এমপি মহোদয়ও সচেতনতার বিষয়ে নানাভাবে প্রচারণাকাজে নিজে যুক্ত থাকছেন। কালিহাতীতে এটি চলমান থাকলে আশা করি মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সামনে আমরা সুফল পাব।

পেশাগত দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই দেশ ও মানুষের কল্যাণের চিন্তায় সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গড়ে তোলার কাজ করছেন এই ইউএনও। মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিষয়ে ইতিমধ্যে তার উদ্যোগে কালিহাতী পৌরসভা, এলেঙ্গা পৌরসভা, নাগবাড়ী, বল্লা প্রভৃতি এলাকায় স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার গ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখনো চলমান।

সামনেই কঠোর লকডাউন বা বিধিনিষেধ আসছে। এরপর সারা দেশে মার্কেট বা দোকান এবং পরিবহন সেবা খুলে দেওয়ার আগে কালিহাতীর মতো সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার কার্যক্রমের মতো উদ্যোগ চালু করা যেতে পারে সারা দেশে। মানুষকে মাস্ক পরাতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে এটি সহায়ক হতে পারে। শুধু সচেতনতাই নয় মাস্ক পরাতে সামাজিক দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি করা জরুরি। তাহলেই করোনার সংক্রমণ কমার পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকা দুটোই রক্ষা পাবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৯জুন ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button