কলাম

উন্নয়নের কুড়াল কেন গাছের ওপরই পড়ে

গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাটা গাছের ছবিগুলো। তা দেখেই বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। কী অপরাধ ছিল গাছগুলোর? বড় বড় জীবন্ত গাছের বুকে যখন করাত চালানো হলো, তখন কেমন কষ্ট হয়েছিল গাছগুলোর? তারা কি চিৎকার করে কিছু বলতে চেয়েছিল? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গাছগুলোর ওপর যে জীব ও প্রাণীরা নির্ভরশীল, তাদেরইবা কী হবে? অসহায়ের মতো তারাও কি কিছু বলতে চেয়েছে? গাছগুলো কি তাদের হত্যার জন্য আমাদের বিচার চাইবে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের অতলে।

ঢাকা মহানগরে সবুজের ভেতর একটু নিঃশ্বাস নেওয়া ও হাঁটার জায়গা খুব বেশি নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রমনা পার্কের পুরো এলাকাটিকে রাজধানীর ফুসফুস বললে ভুল বলা হবে না। সেই ফুসফুসে চলছে  শ্বাসকষ্ট ঘটনার প্রস্তুতি। মহা-উদ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কাটা হচ্ছে শতাধিক গাছ। কেন? সেখানকার বিভিন্ন স্পটে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও ওয়াকওয়ে তৈরি করতেই বৃক্ষনিধনের এমন উদ্যোগ। করোনার মহামারীতে যখন বিগত সময়ে প্রকৃতি ধ্বংস করার আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নতুনভাবে প্রকৃতি রক্ষার পথ খুঁজছে বিশ্ব, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার এমন খবর আমাদের হতবুদ্ধিতাকেই স্পষ্ট করে।

গাছ কাটা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা উঠলেই কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন উন্নয়নের। উন্নয়ন হোক। কিন্তু উন্নয়ন পরিকল্পনা কেন পরিবেশবান্ধব হয় না  সেটি নিয়েই আমাদের প্রশ্ন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ হাঁটতে যায় শত শত গাছ আর সবুজের আলিঙ্গনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই। অথচ সেখানে হাঁটার পথ তৈরির নামেই পুরনো গাছ কাটা হয়েছে! যাদের কাছে বিশ-ত্রিশ বছরের পুরনো বড় বড় গাছ রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়নি, বরং উদ্যানে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও ওয়াকওয়ে তৈরির নামে গাছ কাটতেই যারা উৎসাহী, তাদের নিয়ে সরকার কীভাবে টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটছে?

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের অবস্থান কোথায়? সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শিতাবিষয়ক সূচকে ২০২০ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)’ শীর্ষক যৌথ এই গবেষণায় কোনো দেশের ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়। যেগুলো হলো : বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ ও কৃষি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতেই রয়ে গেছি। এটি বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়, কারণ আমাদের দেশের আয়তন কম, সে তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। এ রকম উচ্চমাত্রার জনঘনত্বপূর্ণ দেশ পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শী না হলে দেশবাসীর স্বাস্থ্যসহ সামগ্রিক জীবনমান ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু আমরা আসলে কোন পথে হাঁটছি? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার ঘটনাই স্পষ্ট করে কেন আমরা পরিবেশ রক্ষায় এত পিছিয়ে!

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারকেলের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে এই উদ্যানের উদ্বোধন করে এর নামকরণ করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। জাতির আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত উদ্যানটি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই উদ্যানে গাছ কেটে খাবারের রেস্টুরেন্ট নির্মাণের ফলে উদ্যানে ইকোলজিক্যাল পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্যও নষ্ট হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ, আধুনিক নগর উপযোগী সবুজের আবহে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলা ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেখানে এক হাজার গাছ লাগানোর কথাও তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। কিন্তু সেই মহাপরিকল্পনাটি কেন পরিবেশবান্ধব হলো না, এমন একটি বৃক্ষভরা উদ্যানে পরিবেশবিদ বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে গাছ না কেটে বা কম গাছ কেটে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেত কি না  সে বিষয়ে তারা কোনো বক্তব্য দেননি! গাছ কাটার আগেই কেন গাছ লাগানোর ঘোষণাটি দেওয়া হলো না? তা ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাস্টারপ্ল্যানটিও জনসাধারণকে জানানো উচিত ছিল।

যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের আগে তার পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা জরুরি। সংবিধানের ১৮(এ) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারের দায়িত্ব পরিবেশ সংরক্ষণ করা; কেননা, গাছ পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান এবং আমাদের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এই উদ্যান ঘিরে কী কী উদ্ভিদের জীবন নির্ভর করে, তাদের উৎপাদিত অক্সিজেন এবং শোষিত কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কত। এগুলো না থাকলে ওই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর তার কোন ধরনের প্রভাব পড়বে, উদ্যানের গাছগুলোতে পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুড়সহ কত প্রজাতির প্রাণী বছরের কখন কী কারণে আসে, তা নিবিড়ভাবে সমীক্ষা করা প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে পরিবেশের এমন সমীক্ষা কি কর্তৃপক্ষ বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় করেছে? উত্তরটি অবশ্যই না।

জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই গাছ কাটা হলে উদ্যানের গুল্ম, ফার্ন, ছত্রাক, লাইকেন, অণুজীব, পাখি, বেজি, কাঠবিড়ালি, সাপ, বাদুড়, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচোসহ নানা প্রাণ চিরতরে তাদের বসত হারাবে। ফলে সেখানে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হবে।

দম বন্ধ করা ইমারতে ঠাসা এ শহরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা খুব বেশি নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি নগরের উদ্যান। যেগুলো আছে তার অবস্থাও জরাজীর্ণ। ঢাকা শহরে যে কয়টি সবুজ বলয় রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার অন্যান্য এলাকার চেয়ে রমনা পার্ক-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়। যার প্রধান কারণ সবুজায়ন। সকাল-বিকেল হাজার হাজার মানুষ এখানে হাঁটতে আসেন। এ ছাড়া এ নগর জীবনের দম বন্ধ হয়ে ওঠা পরিবেশ থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে নগরবাসী এখানে আসে অবসর সময় কিংবা ছুটির দিনগুলো কাটাতে। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ হোক।

ইতিহাসের সাক্ষী সবুজের সমারোহ গাছগাছালির ছায়াঢাকা পাখিডাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট আর ওয়াকওয়ে কার জন্য, কাদের স্বার্থে করা হচ্ছে? সরকারকে নগরের গাছ কেটে উন্নয়ন পরিকল্পনার এমন বুদ্ধি কারা দেন? সেটিও প্রকাশ্য হওয়া দরকার। দেশে কি এমন প্ল্যানার নেই যারা গাছ না কেটে উন্নয়নকাজকে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন? উন্নয়নের কুড়াল কেন শুধু গাছের ওপরই পড়ে!

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৮ মে ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button