ভ্রমণকথা

রেলনগরী পাকশী

লালন সেতুর দিকে চলে গেছে পাকা রাস্তাটি। কিন্ত আমরা ওমুখো হই না। ডানদিকে আরেকটি রাস্তা সেটি গিয়ে মিশেছে একটি সুরঙ্গ পথের সঙ্গে। সুরঙ্গটির অবয়ব দেখি ব্রিটিশি। ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বলেই হয়তো এমন ভাবসাব। রেল লাইনের নিচ দিয়ে চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে সুরঙ্গ পথটি। মটরসাইকেল থামতেই সুরঙ্গের ভেতর মনের সুরঙ্গ খুঁজি আমরা। হঠাৎ রেল আসার শব্দ। গম গম শব্দে কেপে ওঠে ভেতরটা। ওপরে রেলের ঝিকঝিক ঝিকঝিক চলার ছন্দ। একটি রেল ছুটে চলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দিকে। বুকের ভেতর টের পাই অন্য কোন অনুভূতি।
সুরঙ্গ পার হতেই চোখ ভরে যায় সবুজ দৃশ্যে। বড় বড় সব গাছ। সবজি ক্ষেতে ফুল আর বাঁধাকপির গ্রামীণ পরশ। সারি সারি সীমের বাগান। মাচায় মাচায় ফুটে আছে অজস্র সাদা-নীল সিমফুল। হালকা শীতের অনুভূতি চারপাশে। নানা দৃশ্যের আলিঙ্গনে দোল খায় মন। পাঁচ শহীদের মোড় হয়ে আমরা চলে আসি রেল পাড়ায়।
বন্ধু শামীমের কর্মস্থল ঈশ্বরদীতে । তার কাছে মুঠোফোনে শুনেছি ঈশ্বরদীর নানা গল্প। তাই জুয়েলসহ সিদ্ধান্ত হয় সেখানে যাওয়ার। রাত ১১ টার বাসে শ্যামলী থেকে রওনা হই আমরা। বাসের নামটিও বেশ। ঈশ্বরদী এক্সপ্রেস।
ঈশ্বরদীতে যখন পা রাখি তখন কাক ডাকা ভোর। হালকা কুয়াশার চাদরে যেন জড়িয়ে আছে প্রকৃতি। বাস থেকে নেমেই থ হয়ে যাই। চারপাশে সিক্ত মন ছোয়া এক দৃশ্য । অন্য রকম লাগে। চেনা দৃশ্যের অচেনা স্বাদ । মনে পড়ে যায় মার্সেল প্রস্তর কথা।  ভ্রমণ নিয়ে তাঁর স্মরণীয় উক্তিটি বারকয়েক কানে বাজে-‘সত্যিকারের আবিষ্কার যাত্রা মানে নতুন স্থান দেখা নয় বরং দেখার জন্য নতুন চোখ তৈরি করা।’ নানা দিকের নানা দৃশ্যে মজে গিয়েই মার্সেল এমন উক্তি করেছিলেন।  ক্রিং ক্রিং বেইলের শব্দ ভুলিয়ে দেয় মার্সেল প্রস্তকে। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি রিকশায় সোজা চলে আসি উপজেলার ভেতরে শামীমের কোয়ার্টারে।
ক্লান্তি কাটাতে ঘন্টা দুয়েক ঘুম। অতঃপর নাস্তা খাওয়া। পদ্মা নদীর নানা পদের মাছের  তরকারির সঙ্গে চলে খিচুরি। এককাপ গরম চা খেয়ে ঢেকুর তুলি। তারপর তিন বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পরি ঈশ্বরদীর পাড়া বেড়াতে। দুটি মোটরসাইকেলে বেড়িয়ে পড়ি আমরা।

স্বাধীনতার ৫ দিন আগে পাকিস্তানিরা বিমান থেকে বোমা ফেলে চেষ্টা করেছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজটিকে উড়িয়ে দিতে, সেই বোমার অংশ বিশেষ
স্বাধীনতার ৫ দিন আগে পাকিস্তানিরা বিমান থেকে বোমা ফেলে চেষ্টা করেছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজটিকে উড়িয়ে দিতে, সেই বোমার অংশ বিশেষ

প্রথম দেখব পাকশী । তেমনটাই পরিকল্পনা। ঈশ্বরদীর ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে একটি হলো পাকশী। গোটা এলাকাটি এক সময় ছিল রেলওয়ের দখলে। এ ইউনিয়নের মধ্যেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি। কথায় কথায় সুরঙ্গ পথ হয়ে আমরা চলে আসি রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে।
গোটা এলাকাটি বেশ ফাঁকা। চারপাশের দালান কোটার অবয়ব দেখেই টের পাওয়া যায় এখানেই এক সময় ছিল গমগমে ভাব। বড় বড় কড়ইগাছ এদিক ওদিক। জাকালো গাছের ছায়ায় ঢেকে আছে চারপাশ। ফাঁকা জায়গায় ফুটবল খেলছে তুরুণেরা। মাঝে মাঝে বল গিয়ে আছড়ে পড়ছে লাল দালানের ইট শুরকির দেয়ালে। রেলওয়ের ব্লির্ডিংগুলোর দরজা জানালাও সে আমলের কাঠে তৈরি। আমি আর জুয়েল সেগুলো স্পর্শ করে দেখি। অনুভবের চেষ্টা করি ব্রিটিশদের আমলটাকে।
বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে এসে অবাক হই। অফিসের সামনে ছোট একটি ইঞ্জিনসমেত ট্রেন । ডিসপ্লে করে রাখা হয়েছে সেটিকে। বডিতে হালকা নীলের মাঝে সাদা রঙের প্রলেপ। সামনের ইঞ্জিনে সাদা কালোতে লাল রঙের ফোটা। দেখতে বেশ অন্যরকম। দেখে মনে হয় ওয়েস্টার্ন ছবিতে দেখা কোন ট্রেন। এই বুঝি ধোয়া উড়িয়ে চলতে শুরু করবে।
বন্ধু শামীম জানাল ট্রেনটির ইতিকথা। এটিই রূপসা- বাগেরহাট সেকশনে প্রথম চালু হওয়া ন্যারো গেজ (২ ফুট ৬ ইঞ্চি ) ট্রেন। এটি চালু হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ সালে। বর্তমান সময়ে রেলপথের ব্রড গেজ ও মিটার গেজ সবার কাছে অতি পরিচিত। কিন্ত একসময় এ দেশেই ছিল মিটার গেজ ও ছোট ন্যারো গেজ রেলপথ। ছিল বাষ্পচালিত ইঞ্জিন। তাই কালের সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে ট্রেনটিকে। ট্রেনটির ঠিক পাশেই দেখি বোমাকৃতির কিছু একটা। সাদা আর লাল রঙের প্রলেপ দেয়া সেটিতে। ট্রেনের পাশে বোম। দেখতে বেশ খাপছাড়া লাগে। আমাদের দিকে তাকিয়ে শামীম মুচকি হাসে। বোমের রহস্য  ভাঙ্গতে সে জানালো ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কথা। স্বাধীনতার ৫ দিন আগে পাকিস্তানিরা দু’টি স্যাবর জেট বিমান থেকে বোমা ফেলে চেষ্টা করেছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজটিকে উড়িয়ে দিতে। সে সময় বোমার আঘাতে মারাত্মক ক্ষতি হয় ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের। এটিই সে সময়ে নিক্ষিপ্ত বোমার অংশবিশেষ।
শামীম আমাদের নিয়ে যায় রেলওয়ের একটি বাংলোর কাছে। বিশাল এই বাংলোটির  নাম ‘গেলে কুঠি’। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশাপাশি এটিও তৈরি করেন প্রকৌশলী উইলিয়াম গেইল। শামীম জানালো এই বাংলোতে বসেই নাকি তিনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নকশা জরিপ এবং নির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন করেন। তাই তার নাম অনুসারে বাংলোর নামকরণ করা হয় ‘গেলে কুঠি’। বাংলোর ভেতরে ঢুকতে গিয়ে হতাশ হলাম। গেইটে ঝুলানো বড় একটি সাইন বোর্ড। ডিসি সাহেবের অনুমতি কেউ ঢুকতে পারবে না। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই। দূর থেকেই দেখি বাংলোটিকে।
গেলে কুঠি দেখে আমরা আসি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে। বড় একটি মাঠের এক প্রান্ত থেকে দেখি বিদ্যালয়টিকে। এই বিদ্যালয়টিতেই হাতেখড়ি হয়েছিল ভারতের প্রখ্যাত কবি শঙখঘোষসহ বহু গুণীজনের।
চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে আমরা আসি পাকশী নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলে।  ১৩৩.৫৪ একর জমির উপর ছায়া ঘেরা পরিবেশে পেপার মিলটি নিরবে নিস্তদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। নেই কোন কোলাহোল আর শ্রমিকের পদচারণা। অথচ একসময় এই নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটিই ছিল দেশে সাদা কাগজ তৈরির একমাত্র কাগজকল।
সূর্যটা একেবারে মাথার ওপর। পেট বাবাজি খানিকটা অশান্ত। পাকশীর পথ ঘাট প্রান্তরকে বিদায় জানিয়ে আমরা ছুটি ফিরতি পথে। সুরঙ্গ পথ পেরিয়ে ছুটে চলে আমাদের মটর সাইকেল। পেছনে পড়ে থাকে পাকশীর কীর্তিগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তে

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button