কীর্তিমান বাঙালি

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় ব্যক্তিত্ব

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। দেশের বাইরে গিয়ে বিদেশি শক্তির সাহায্যে এক বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তুলে তিনি সরাসরি ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁর এই আক্রমণের জেরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আর বেশিদিন ভারতকে নিজেদের অধীনে রাখতে পারেননি।

১৮৯৭ সালের ২৩ জুন এখনকার ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে সুভাষচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি অবশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুরের কাছে কোদালিয়া গ্রামে। ১৯১৯ সালে দর্শনে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করেন তিনি। এরপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসেন। এই পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করলেও, ১৯২১ সালে সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন এবং দেশে ফিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অধীনে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কলকাতা শহরের মেয়র হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে ইংরেজরা জেলে বন্দী করে। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সেই পদ ত্যাগ করেন। এরপর জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গেও তাঁর মতবিরোধ হয়। তখন কংগ্রেসের মধ্যেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক উপদল তৈরি করেন। এরপরই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গৃহবন্দী করে।

১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বাড়ি থেকে অন্তর্হিত হন। এরপর দেশের বাইরে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সৈন্য ও রসদ সংগ্রহ শুরু করেন। প্রথমে জার্মানির সঙ্গে কথা বলেন। পরে জাপানের সক্রিয় সাহায্য আদায় করেন। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে রেডিও বার্লিন থেকে নিয়মিত বেতার সম্প্রচারও শুরু করে দেন সুভাষ। পরের বছর পূর্ব এশিয়ায় গিয়ে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। এই ফৌজে তিনিই হন সর্বাধিনায়ক। দেশবাসী তাঁকে ‘নেতাজি’ অর্থাৎ ‘মহান নেতা’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৪২ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি ‘আর্জি-হুকুমৎ-এ-আজাদ হিন্দ’ বা ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ ঘোষণা করেন। এই সরকার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। জাপানি বাহিনীর সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান চালায়। মণিপুরের কোহিমা দখল করে স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এই বাহিনী। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও দখল করেছিলেন তাঁরা। নেতাজি এই দ্বীপের নাম রেখেছিলেন ‘শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ’।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সকল দেশবাসীকে এক অখণ্ড জাতিসত্ত্বায় বেঁধে জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের জওয়ানদের মধ্যে তিনি ভালবাসা ও আনুগত্যের এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি দেশ স্বাধীন হলে সেদেশের প্রশাসন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কেমন হবে, তাও ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু তাঁর পরিবারবর্গের আপত্তিতে এই সম্মান দেওয়া হয়নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: “স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।” আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাঁকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতারর একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: “নেতাজি ভবন” (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও “নেতাজি” (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।

বলা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানের তাইপেইতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সত্যতা আজও প্রমাণিত হয়নি।

তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button