কলাম

লকডাউনে বন্ধু হোক বই

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ গৃহবন্দি। কীভাবে কাটছে তাদের সময়? আমাদের দেশে চাকরিজীবীদের অনেকেরই চলছে হোম অফিস। অনলাইন ক্লাসের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সামান্য অবসরেও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে। ফলে একসঙ্গে বসে এখন আর তেমন আড্ডা হয় না। পরস্পরের সঙ্গে কথা নেই। আড্ডাতে সবার চোখ আটকে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। প্রয়োজন, বিনোদন ও শিক্ষা সবকিছুই চলছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এভাবে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়েছে শতগুণ। ফলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছে আমাদের শিশুরা।

কিন্তু এই সময়টাতেই যদি নতুন নতুন বই চলে যেত ঘরে ঘরে। বড়দের উপযোগী গল্প, উপন্যাস, গবেষণা ও প্রবন্ধের বই। চাইলেই যদি শিশু-কিশোররা হাতের কাছে পেত মজার মজার সব বই। পরিবারের সবাই মিলেই বইপড়ার অভ্যাসটা যদি গড়ে তোলা যেত। তাহলে কেমন হতো? আদৌ কি সেটি সম্ভব?

করোনা ও প্রযুক্তিনির্ভরতার এমন পরিস্থিতির ভেতরই সম্প্রতি বইকে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার অভিনব এক কাজ শুরু করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের এক ছাত্র সৌম্যদীপ্ত বসু। ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বড়বেড়িয়া এবং রামরামপুর গ্রাম দুটির পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি করার উদ্যোগ নিয়েছে এই যুবক।

ছোটদের বই পড়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু বই তারা পাচ্ছে না। তাই বই পৌঁছে দিলেই পড়ুয়া পাওয়া যাবে। কোনো একজনের বাড়িতে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যদি কিছু বই রেখে লাইব্রেরি চালু করা যায়, তাহলেই সবার হাতে বই পৌঁছাবে। লকডাউনে বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু কে? এই ভাবনা থেকেই সৌম্যদীপ্ত তার ‘আলোকধারা’ সংস্থার মাধ্যমে ‘বোধি পীঠ’ নামে তিনটি লাইব্রেরি খুলেছেন সৌম্যদীপ্ত। যেখানে ছোটরা নিয়ম করে বই নিয়ে যায় পড়া শেষে নিয়ে এসে আবার নতুন বই নেয়। সবটাই চলছে কোনো মূল্য ছাড়া। ছোটদের হাত ধরে এখন তাদের বাবা-মায়েরা এবং অন্যান্য বয়স্করাও লাইব্রেরি বা পাঠাগারে যাতায়াত শুরু করেছেন।

কেমন ওই লাইব্রেরি বা পাঠাগার?

একজনের বাড়িতে কয়েকটা তাক নিয়ে জমা রাখা হয়েছে আশি থেকে একশ বই। আছে ভূত-পাখি-ছড়া বা টুনটুনির গল্প। সেখান থেকে বাচ্চারা পছন্দমতো বইপত্র নিয়ে যায়। ফলে লকডাউনে পড়ার অভ্যাসের যে ক্ষতি হয়েছে, সে ক্ষতি অনেকটাই মিটেছে গ্রাম দুটিতে। সেখানে প্রযুক্তির নির্ভরতার পাশাপাশি বই নিয়ে একটা ভালো সময়ও কাটছে সবার।

এত বই কীভাবে সংগ্রহ করা হলো? সৌম্যদীপ্তর ভাষায়, ‘কার্যক্রম দেখে অনেকেই বই দিয়ে সাহায্য করেছেন, টাকাও পাঠিয়েছেন কেউ কেউ। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহায্য চেয়েছিলাম। ফলে অনেকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে বই দিয়েছেন। উদ্যোগ নেওয়াটাই আসল। ভালো উদ্যোগ থেমে থাকে না।’

ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে সৌম্যদীপ্ত বসুর পাঠাগার ও বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়ার সংবাদটি যখন পড়ছিলাম তখন চোখের সামনেই ভেসে উঠছিল একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত পলান সরকারের মুখচ্ছবি। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউশা গ্রামের এই মানুষটি ত্রিশ বছর বিনা পয়সায় বই বিলিয়েছেন তার আশপাশের দশ গ্রামে। উপজেলার বারোটি গ্রামে তিনি পাঁচ হাজারেরও বেশি পাঠক তৈরি করেছেন।

পলান সরকার কীভাবে এটি করতেন? বই বিতরণের জন্য তিনি এলাকায় পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন। এ জন্য বেছে নিয়েছেন কয়েকটি বাজারের বইপ্রেমী দোকানিকে। দোকানের মালিক দোকানে মালামালের পাশাপাশি তার বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই তারা নিজেরাই আবার ফেরত দিয়ে নেন নতুন বই। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরনো বইগুলো নিয়ে আসতেন।

বই পড়ানোর কেন এমন উদ্যোগ? পলান সরকারের ভাষ্য ছিল, ‘ছোটবেলায় শুনেছিলাম, অন্নদান, বস্ত্রদান– অনেক রকম দান আছে। কিন্তু সবার সেরা দান জ্ঞানদান। তো আমি ঠিক করলাম, মানুষকে দেব যখন সেরাটাই দিই। আমাদের গ্রামটায় মানুষের লেখাপড়া কম। পেটের দায়েই ঘুরতে হয় ২৪ ঘণ্টা, বই পড়বে কী! সে কারণেই ভাবলাম কোনোভাবে যদি ওদের বই পড়ানো যায়।’

বইপড়া কেন জরুরি? বইয়ের মধ্যে আলো আছে, তাই বই পড়লে আলোকিত হওয়া যায়। আলো আসে আগুন থেকে। কার আগুন? যিনি বই লেখেন, তার আত্মার আগুন। এ আগুন দেশলাইয়ের আগুনের মতো নয়। বইয়ের মধ্যে থাকে ভালোবাসার আগুন, সৌন্দর্যের আগুন, পৃথিবীকে সুন্দর করার আগুন। মানুষ জন্মেছে প্রাণী হয়ে। সেটা এক ধরনের মানুষ। আর এক ধরনের মানুষ হচ্ছে বিকশিত মানুষ। মানুষের বিকাশের জন্য কেবল বই পড়লেই হবে। কারণ যে বই পড়ে, সে কবিতাও পড়ে, গান শোনে, চিত্রকলা বোঝে। পূর্ণিমার আলো, নীল আকাশ সবই বোঝে। আবার আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পাঠ্যবই পড়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিকশিত হওয়ার জন্য, বড় স্বপ্ন দেখার জন্য অন্য সৃজনশীল বই পড়া দরকার।’ বইপড়ার গুরুত্ব তুলে ধরতে এমনটাই বলেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ঢাকা মহানগরে বইপড়া কর্মসূচি শুরু হয় তার হাত ধরেই। যেটি আজ সারা দেশেই বিস্তৃত।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, ‘হে প্রভু তুমি আমার হায়াত বাড়িয়ে দাও, যাতে আমি আরও বই পড়তে পারি।’ মানুষ যদি নিছক দীর্ঘায়ু লাভের জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করে, তাহলে ব্যাপারটি হবে খুবই নিরর্থক। কিন্তু বই পড়ার মতো মহান ব্রত পালনের জন্য কেউ যদি দীর্ঘায়ু কামনা করে, তাহলে সে শুধু নিজেকেই আলোকিত করবে না, আলোকিত করবে আরও হাজারো মানুষকে। জ্ঞানের আলোর এই বিচ্ছুরণ একটি মহৎ সমাজ গড়ার পথে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমনটাই মনে করতেন এই জ্ঞানতাপস।

তাই করোনার এই সময়টাতে বইপড়া ও সহজে বই পাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে ঘরবন্দি শিশুদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। তারা যেন হাতের কাছে ভালো ও পছন্দের বই পায়, বই নিয়ে নানা উদ্যোগেও তাদের যুক্ত রাখা দরকার।

সারা দেশে পাঠাগারের সংখ্যা যেমন বাড়ানো উচিত তেমনি পাঠাগারগুলোকে পাঠাভ্যাস তৈরিতেও নানারকম কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। কর্মসূচির মাধ্যমে পাঠককে পাঠাগারে আনা কিংবা পাঠাগারের বই পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে সহজে বই পাওয়া নিশ্চিত করার মাধ্যমে বইপড়ার উদ্যোগ হতে পারে গ্রামে গ্রামে। যে কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে বা শিক্ষিত যুবকরা সম্মিলিতভাবে এমন মহতী কাজ হাতে নিতে পারে। আবার রাজধানী ও জেলা শহরের প্রতিটি ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে চাইলেই সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব বইয়ের সংগ্রহ। যেখান থেকে শিশুসহ ফ্ল্যাটের যে কেউ পছন্দের বই নিয়ে পড়তে পারবে। বই নিয়েই কাটবে বিশেষ সময়গুলো। মাঝেমধ্যে বইকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করা কি খুব কঠিন? বইপড়ার এমন উদ্যোগগুলো কি শুরু করা যায় না?

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৭ মে ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button