জীবনকথা

খোকন বিক্রমপুরীর পতাকা

হরেক মানুষের আনাগোনা এই ঢাকায়। নানা মানুষের নানা কথা, নানা মত। ক্যামেরা নিয়ে বের হয়েছি সে মানুষগুলোর সান্নিধ্যের আশায়। মিরপুর থেকে শাহবাগ আসতেই বাসের মধ্যে হট্টগোল। গেট লক সিটিং বাস। অথচ বাসভর্তি লোক দাঁড়ানো। তাতে কি! ভাড়া দিতে হবে সিটিংয়ের। এ নিয়ে এক যাত্রীর সঙ্গে বচসা চলে কন্ডাক্টরের। হাতাহাতি হয় হয়। কিন্তু অন্য যাত্রীরা প্রায় নিশ্চুপ। জানালার ওপাশে হকারের হাঁকডাক, ‘গরম গরম খবর, চার টাকাতে দুনিয়া।’ দু-একজন পত্রিকা কেনেন। বাসের মধ্যেই শুরু হয় টক শো। এটিই নগরের নিত্যদিনকার চিত্র।

শিক্ষা ভবন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাব। হঠাৎ চোখের সামনে লাল-সবুজের পতাকা। একটি নয়, একই সঙ্গে কয়েকটি। পতপত করে বাতাসে উড়ছে। আমার ক্লান্ত দেহ তখন টানটান।
পতাকাগুলো বয়ে বেড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধ। বয়স সত্তরের মতো। কাঁধে একটি ঝোলা। মুখে সাদা দাড়ি। চোখের দৃষ্টিতে যেন ইতিহাস লুকানো। পান খাওয়া মুখে তাঁর হাসি খেলে যায়। আমার ক্যামেরাও ক্লিক ক্লিক শব্দ তোলে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই কথোপকথন চলে তাঁর সঙ্গে।
নাম তাঁর মজিবুর ঢালি। বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হলদিয়া গ্রামে। সবাই চেনে খোকন বিক্রমপুরী নামে। কেন এমন নাম? তাঁর উত্তর, ‘কাকা, এইডার একটা ইতিহাস আছে। শেখ মুজিব যখন জেলা ঘোষণা করে গভর্নর নিয়োগ দিচ্ছেন, লৌহজং তহন ছিল বিক্রমপুরের মইধ্যে। সবার লগে তহন আমিও বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাইয়া কইলাম, “স্যার, আমগো বিক্রমপুররে জেলা ঘোষণা করেন।” বঙ্গবন্ধু আমার ডাকনাম জাইনা কইলেন, “যাও, তুমি হইলা খোকন বিক্রমপুরী।” খোকন আমার ডাকনাম। সে থেকে সবাই এ নামেই ডাকে।’
খোকন বিক্রমপুরী নিজেই পতাকা তৈরি করে বিক্রি করেন ঘুরে ঘুরে। এ পেশা তাঁর ৪১ বছরের। শুরুর দিককার কথা উঠতেই বলেন, ‘দোসরা মার্চ ১৯৭১। আমি তখন দজির্র কাজ করতাম আজিমপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন আ স ম আব্দুর রব। সঙ্গে ছিলেন শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন। ওই মিটিংয়ে আমিও গেছিলাম। এরপর থেইকা ৫০ টাকা পুঁজি নিয়া পতাকা বানানো শুরু করি।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদপুর রাজিয়া সুলতানা রোডের কোলনী টেইলার্সে কাজ করতেন খোকন বিক্রমপুরী। বিহারিরা তখন ওই এলাকায় বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। আশপাশে ছিল আলবদর, আলশামসদের আনাগোনা। এরই মধ্যে দিনের বেলায় টেইলারিং কাজ আর রাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বানাতেন মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা।
তাঁর ভাষায়, ‘অনেক ভয় লাগত, যখন কাপড় কিনতে যাইতাম। লাল, সবুজ আর হলুদ কাপড়ডা কিনতে গেলেই লোকেরা মুখের দিকে চাইয়া থাকত। বুকের ভেতরডা তহন ধুকপুক করত।’
পতাকা কারা কিনত? খোকন বিক্রমপুরী বলেন, ‘গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আসত পতাকা নিতে। কর্নেল হায়দারের নাম করে আসত সবাই।’
স্বাধীনতার পর পতাকা নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়ান খোকন। তাঁর ভাষায়, ‘হোল বাংলাদেশ। ককসবাজার থাইকা পাটগ্রাম পর্যন্ত।’
পরিবারের কথা উঠতেই বলেন, ‘এক ছেলে সিঙ্গাপুর, এক ছেলে দুবাই আর মেয়েডারে বিয়া দিছি, শ্বশুরবাড়ি থাকে।’ খোকন বুকের ভেতর জমানো কষ্টের কথা বলেন কান্নাজড়ানো কণ্ঠে, ‘বড় ছেলে বিয়া করছে মত ছাড়া। ও ভিন্ন থাকে। নাতিন আছে, কিন্তু এহনো দেহি নাই।’
কষ্টের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে। খোকনকে স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ পাল্টাই। কথা হয় পতাকার দাম নিয়ে। তিনি বলেন, ‘পাঁচ ফুটটা ৮০-৯০ টাকা, আড়াই ফুটটা ৩০-৩৫ টাকা আর ১৫ বাই ৯ বেচি ২৫ টাকায়। সব সময় এক রেট। কোনো দিন হাজার টাকা বেচি, কোনো দিন খালি হাতে ফিরি। তবু পতাকা নিয়ে ঘুরতে আনন্দ লাগে।’
বাংলাদেশের পতাকার অসম্মান দেখলে মন খারাপ হয় খোকনের। তাঁর ভাষায়, ‘কোনো কোনো দিবসে এই পতাকা বাসাবাড়িতে উড়াইয়া রাখে। কিন্তু পরে কেউ আর পতাকা নামায় না। অথচ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই তো পতাকা নামানো নিয়ম। কত রক্তের বিনিময়ে আমরা পতাকা পাইছি। সে পতাকার অসম্মান দেখলে মনডা খারাপ লাগে।’
খেলার সময় যখন বাংলাদেশের হাজার হাজার পতাকা ওড়ে, ছাত্ররা যখন পতাকা কিনে নেয়, তখন অন্য রকম আনন্দ দোল খায় খোকনের মনে। নানা দেশের পতাকা বানালেও তিনি বানান না শুধু পাকিস্তানের পতাকা। কেন? উত্তরে বলেন, ‘কাকা, একাত্তরের কথা মনে হইয়া যায়। মন থাইকা পারি না।’
প্রতি সন্ধ্যাতেই খোকন ফিরে যান গ্রামে। শুক্র ও শনিবার ঘরে বসেই তৈরি করেন বাংলাদেশের পতাকা। সহধর্মিণী কাপড় কেটে আর পতাকা ভাঁজ করে সাহায্য করেন তাঁকে। এভাবে পতাকাকে ঘিরেই তাঁর সুখ-দুঃখ।
খোকন বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে চান বাকিটা জীবন। অন্য ব্যবসা করেন না কেন? এমন প্রশ্নে মলিন মুখে খোকন বিক্রমপুরীর উত্তর, ‘ছাড়তে পারি না কাকা, বুকটা ফাইটা যায়। যত দিন বাঁচুম, তত দিন বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে থাকুম।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথমআলোতে, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২

© 2013 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button