চা শ্রমিকদের বিবর্ণ জীবনের গদ্য
তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। তবে সেটি মিলবে কমপক্ষে ২০ কেজি চা-পাতা তুলতে পারলে। এর কম হলে? প্রতি কেজিতে কেটে নেওয়া হয় ছয় টাকা। তাহলে ২০ কেজির বেশি পাতা তুললে কি কাটার হারেই বেশি টাকা দেওয়া হয়? একেবারেই না। তখন প্রতি কেজিতে দেওয়া হয় মাত্র দুই টাকা করে, যা শ্রম শোষণের পর্যায়ে পড়ে।
এ ছাড়া মজুরির বাইরে তারা রেশন হিসেবে সপ্তাহে পায় তিন কেজি আটা, তবে তা কিনে নিতে হয় দুই টাকা কেজি দরে। ছয় সদস্যের পরিবারে দিনে চাল লাগে আড়াই কেজি। মজুরির ওই টাকায় চাল ও অন্যান্য খরচ চালানো সম্ভব হয় না। ফলে অনেক পরিবার একবেলা উপোস থাকেন। এখানেই শেষ নয়, তারা যদি চা বাগানের জমিতে ফসল বা শাকসবজির চাষ করেন তাহলে রেশন দেওয়া হয় না। তাদের চালাঘরের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে সারা বছর। পাঁচটি টিন লাগলে দেওয়া হয় একটি। চিকিৎসার নেই ভালো কোনো ব্যবস্থা। সন্তানদের লেখাপড়ায় এনজিওদের স্কুলই একমাত্র ভরসা। ফলে অধিকাংশ শিশু পঞ্চম শ্রেণি পেরোতে পারে না। মজুরি কম হওয়ায় তাদের অধিকাংশই এনজিওদের কাছে ঋণগ্রস্ত। প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় তাদের। ফলে মজুরির টাকায় দিন এগোয় না। এসবই গণমাধ্যমে উঠে আসা খবর।
বলছি চা শ্রমিকদের কথা। যাদের অধিকাংশই সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, কালেন্দি, ভূমিজ, কর্মকার, বাগতি, মুদি, কানু, পানতাতি, কাহার, বারাইক, রাউতিয়া, কৈরিসহ নানা জাতের আদিবাসী মানুষ। যারা দৈনিক মাত্র ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। সারা দেশে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য আর মানুষের জীবনযাপন ব্যয়। কিন্তু চা শ্রমিক এই আদিবাসীদের জীবন এখনো বাঁধা পড়ে আছে নানা বৈষম্য, শোষণ আর দুঃখের আবর্তে।
মজুরি বাড়ানোর কথা দুই বছর পরপর। কিন্তু ২০১৮ সালের পর সেটি আর বাড়েনি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের বিক্রি বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদানও প্রায় ১ শতাংশ। তবুও কেন এই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পথে নামতে হলো? এত বছরেও কেনইবা তাদের দীর্ঘমেয়াদি মজুরি কাঠামো তৈরি করা হলো না? এসব নিয়ে আলোচনা চলছে নাগরিক সমাজে।
কিন্তু কীভাবে এই অঞ্চলে এসব চা শ্রমিকদের আগমন ঘটে? তা জানতে বেশ পেছনে ফিরতে হবে।
বিভিন্ন তথ্য বলছে, ১৮৬০-৭০ সালের দিকে আসাম ও সিলেট অঞ্চলে চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক সাফল্য দেখা দেয়। ফলে অনেক বিদেশি কোম্পানি তখন চায়ে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে চা বাগান বাড়তে শুরু করে। ১৯১০ সালের মধ্যেই সিলেট এলাকায় ১৫৪টি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়, যার অধিকাংশ মালিক ছিল ইউরোপীয়রা। তখন অধিক পরিমাণ শ্রমিকের চাহিদাও দেখা দেয়। বলা বাহুল্য, চা বাগানে প্রথম যে শ্রমিকরা কাজ করতেন, তারা সিলেটের স্থানীয় ছিলেন না।
চা শ্রমিকদের অভিবাসন ছিল অনেকটা দাস ব্যবসার মতো। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রলোভন, ভয় দেখিয়ে, অপহরণ করে, ভুল বুঝিয়ে বাসিন্দাদের ধরে আনা হতো। তাদের মধ্যে বিবাহিত নারী ও তরুণরাও ছিল। প্রতারণার মাধ্যমে তাদের নিয়ে এসে নিজেদের লোকজনই তাদের বিক্রি করে দিয়েছিল। তাদের এনে প্রথমে বিভিন্ন কেন্দ্রে জড়ো করা হতো। অতঃপর সেখান থেকে পাঠানো হতো চা বাগানগুলোতে। শ্রমিক সংগ্রহের পুরো প্রক্রিয়াটিতে যারা যুক্ত থাকত, তাদের বলা হতো আরকাত্তি।
ভারতের ছোট নাগপুর, মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, মাদ্রাজ প্রভৃতি এলাকা থেকে চা শ্রমিকদের আগমন ঘটে। বেশির ভাগই এসেছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকাগুলো থেকে। যারা ছিলেন গরিব, দুর্বল ও নিম্নবর্ণের হিন্দু। স্থানীয়রা তাদের ‘কুলি’ বলে ডাকতেন। শুরু থেকেই এই কুলিদের প্রতি স্থানীয়রা, চা বাগান মালিক এবং কর্মকর্তারা দাসের মতো আচরণ করত। ওই দাসত্ব মেনে নিয়েই চলতে হতো তাদের।
বাগান মালিকরা তাদের সম্পত্তি বলে মনে করতেন, মালিকরাই তাদের স্বাধীনতা নির্ধারণ করতেন, তাদের বিভিন্ন বাগানে আনা-নেওয়া করা হতো। বাগানের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। এখানে তারা এসেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়, কিন্তু এসেই সারা জীবনের জন্য বন্দি হয়ে পড়েন।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে চা শ্রমিকদের নিয়ে আসার অপরাধের কথা। ফলে আরকাত্তি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশরা শুরুর দিকে এভাবে চা শ্রমিকদের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে এলেও পরবর্তীকালে তাদের সন্তানরাই বংশপরম্পরায় চা বাগানের কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকে।
উনিশশো সাতচল্লিশ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর সিলেট ও চট্টগ্রামের চা শ্রমিকরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। এরপর থেকে তাদের বংশধররাই এখনো দেশের চা বাগানগুলোয় কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এসব বাগানে অবস্থান নিলে চা শ্রমিকরা তাদের খাবার, খবর ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেন। কিন্তু তবুও স্বাধীন দেশে চা শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। দেড়শ বছর পরেও বাংলাদেশের মূল সমাজের সঙ্গে তাদের সংযোগ খুবই সামান্য। শিক্ষা আর চাকরির সুযোগের অভাব আর অদৃশ্য এক শিকলে চা বাগানের মধ্যেই আটকে থাকে তাদের জীবনপ্রবাহ। দাসত্ব আর বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে এখনো বের হতে পারেননি চা শ্রমিকরা।
তাদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিকে শুধু যৌক্তিকই নয় বরং অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে তা খুবই সামান্য। যা চা শ্রমিকদের জীবনযাপনে খুব বেশি গতি আনবে না। ফলে তাদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
রবিবার রাতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে জানানো হয় শিগগির প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বসে তাদের মজুরি নির্ধারণ করে দেবেন। চা শ্রমিক নেতারা সময় দিতে নারাজ। ফলে এখনো চলছে ধর্মঘট। ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকারও বেশি দামের চা-পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের। তাই দেশের স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে এই অচলাবস্থা কাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
সরকার উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের পথে চলছে। তাহলে চা শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য কেন একই জায়গায় থেমে থাকবে? সরকারি তথ্য বলছে, দেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু চা শ্রমিকদের কেন একবেলা উপোস থাকতে হয়? রাষ্ট্রের উদ্যোগে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির চা-শিল্পীদের মজুরি বৈষম্য দূর করাসহ তাদের দাসত্ব আর বৈষম্যের জীবন থেকে মুক্তি মিলবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৫ আগস্ট ২০২২
© 2022, https:.