বিশ্ব আদিবাসী দিবস আজ। কেন এই দিবস? তা জানতে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
১৯৯৩ সালকে আদিবাসীবর্ষ ঘোষণা করে জাতিসংঘ। অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী মানুষদের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় ৯ আগস্টকে ‘বিশ্ব আদিবাসী’ দিবস হিসেবে পালনের।
২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে এ দিবসটি বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। বেসরকারিভাবে উদযাপিত হলেও বিশ্ব আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিয়েছেন সুধীসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। আদিবাসী দিবসের বিভিন্ন প্রকাশনায় বাণী দিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন- ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া, ২০১০ সালে খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ।
আদিবাসী নিয়ে বির্তক শুরু হয় ২০০৮ সালে। সে সময় হঠাৎ করেই আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবে অস্বীকার করতে থাকে সরকার। কিন্তু কেন? বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় যে, আদিবাসীদের যৌক্তিক মতামতকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটি বিশেষ বাহিনীর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্তটিই চূড়ান্তরূপ পায় বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। সংশোধিত সংবিধানের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্টপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।”
আবার ৬ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে ‘বাঙালি’ ছাড়া অন্য সব মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।” ফলে সেখানে অন্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে।
একইভাবে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রণীত হয় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’ আইনটি। এর ২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ।
একদিকে সরকার বলছে দেশে কোনো আদিবাসী নেই, আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
আরো পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়- বৃটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও সরকারি দলিলে “আদিবাসী“ শব্দটির ব্যবহার ছিল। পার্বত্য চট্রগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০, পূর্ববঙ্গ জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০, আয়কর আইনসহ সরকারি বিভিন্ন পরিপত্র, দলিল ও হাইর্কোটের রায়ে “আদিবাসী“ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
যে সরকারের আমলে অস্বীকার করা হয়েছে আদিবাসীদের, সেই ক্ষমতাসী আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার-২০০৮ এ ১৮(২) ধারায় “আদিবাসী“ শব্দটি ব্যবহার করে উল্লেখ করা হয়েছে, “পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।”
ইশতেহারের ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অনুন্নত সম্প্রদায় ও অনগ্রসর অঞ্চল’ শীর্ষক অনুচ্ছেদেও ‘আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন’ এবং আরও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমান আইন মতে আদিবাসীরাই যদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হন, তবে তো সরকার বলেই দিচ্ছে এদেশে আদিবাসী আছে। একইসঙ্গে এটি স্পষ্ট হচ্ছে কোনো এক বিশেষ কারণে তাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হচ্ছে। তারা যদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হয় তাহলে বাঙালিরা হচ্ছে বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী। যদি কোনো কারণে সরকার বাঙালিদের ‘বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী’ বলে ডাকার নির্দেশনা জারি করে- তবে কি বাঙালি সমাজ তা মেনে নেবে?
এ বছর বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে নানা শঙ্কার মাঝে। সরকার চায় না এদেশে এই দিবসটি পালিত হোক। ফলে সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা না করার জন্য সব জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পূর্বে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত এক চিঠিতে পার্বত্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনে যাতে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা করা না হয়।
একসময় যেসব নের্তৃবৃন্দ ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবসে’ আদিবাসীদের নানা আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন তারাই এখন ক্ষমতায় থেকে নজরদারি করছেন সে অনুষ্ঠানের। আবার সরকারের মধ্যে থেকেও শিল্পমন্ত্রী, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু সরকারের ওই নির্দেশনা ও অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করছেন। ফলে আদিবাসী নিয়ে সরকারের ভেতরেই মতবিরোধ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু সবার মনে একটিই প্রশ্ন। আদিবাসীদের `আদিবাসী` হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সরকারের সমস্যা কোথায়?
এ বিষয়ে গত ৫ আগস্ট ২০১২ ইং তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তজার্তিক কমিশনের সদস্য
ইফতেখারুজ্জামান জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী থেকে চাপ এসেছে যে, যেসব দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওইসব দেশে আদিবাসী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। আর তাই আদিবাসীদের সংজ্ঞাটিও বদলে ফেলা হয়েছে।”
এ বিষয়ে আরো তথ্য পাওয়া যায় চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “প্রথমত আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, যা সরকার বোঝা মনে করে। দ্বিতীয়ত সাংবিধানিক স্বীকৃতির সাথে আদিবাসীদের ভূমির অধিকাররসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে যা হয়ত সরকার দিতে চায় না। তা ছাড়া আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়ার সাথে সাথে সরকারকে প্রায় অর্ধশতাধিক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও নিজস্ব সংগঠন করার অধিকার।” (সাপ্তাহিক, ৭ জুলাই ২০১১)।
কাজেই যদি দেখানো যায় যে এদেশে কোনো আদিবাসী নেই, তাহলে আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণ বা অধিকার প্রতিষ্ঠার ওইসব শর্ত পূরণেরও প্রশ্ন থাকে না। এ কারণে সরকার বলতে চায়, এদেশে কোনো আদিবাসী নেই।
অনেকেই মনে করেন ‘আদিবাসী’ বিতর্ক তৈরি করে সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে টালবাহান করছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলেও তা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি অদ্যাবধি। বরং নতুন করে ভূমি বিরোধ তৈরি হচ্ছে পাহাড়ে।কী সেই বিরোধ? বাঙালিদের পুনর্বাসনের সময় প্রতিটি পরিবারকে কিছু জমির মালিকানা সংক্রান্ত যে কবুলিয়তনামা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখন তারা প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। অথচ স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া সেখানে কোনো জমি কেনাবেচা হওয়ার বিধান নেই। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় নিয়মবর্হিভূতভাবে এই প্রভাবশালী চক্র পাহাড়ে গড়ে তুলছে বিভিন্ন প্রকল্প। পার্বত্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটির অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। ফলে এখন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের পক্ষে শক্তি হিসেবে কাজ করছে এই প্রভাবশালী চক্রটিও। এ ধরণের ভূমি দখলের ঘটনায় সাজেক, রামগড়, মহালছড়ি, বরইতলীতে সংঘাত হয়েছে এবং এখনও তা থেমে নেই। মহালছড়ি থেকে রাঙামাটির পথে গামারিডালা এলাকাটি সম্পূর্ণই এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এভাবে পাহাড়ে বাড়ছে রক্তপাত। বাড়ছে আদিবাসীদের কান্না।
শান্তিচুক্তি হয়েছে, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এখনও প্রায় ক্ষমতাশুন্য। সরিয়ে নেওয়া হয়নি আর্মি ক্যাম্পগুলো। যে নির্দেশনার বলে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তা-ও বাতিল করা হয়নি। শুধু পাহাড়িরাই নয়, পার্বত্য অঞ্চলে যে কোনো পর্যটককেই থাকতে হয় কড়া নজরদারিতে। বিদেশি সাংবাদিকদের এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না সেখানে।
গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেই পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আস্থার সঙ্কট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধন অশান্ত পরিবেশ তৈরি করছে। শুধু পার্বত্য অঞ্চলেই নয়, গোটা দেশের আদিবাসীরাই আজ অবহেলা, বঞ্চনা আর অত্যাচারের মুখে হারিয়ে ফেলছে তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু।
এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীরাও বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অথচ স্বাধীন দেশে তারা পাচ্ছে না নিজেদের স্বীকৃতিটুকু। আমরা চাই না একটি স্বাধীন দেশে অন্য জাতিকে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বলতে। চাই না আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দিয়ে হীন মানসিকতার বাঙালি হতে। চাই আদিবাসীদের হাতে হাত রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে, ০৯ আগষ্ট ২০১২
© 2012 – 2018, https:.