আপনার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করছে কে?
সৈয়দ হারুন
মনে রাখবেন, এই পৃথিবীতে আপনি ছিলেন না। আপনি এসেছেন। আবার চলেও যাবেন। আপনি যেমন নিজের ইচ্ছায় আসেননি, তেমনি নিজের ইচ্ছায় যাবেন না। আপনাকে পাঠানো হয়েছে। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি এমনি এমনি আপনাকে পাঠাননি। এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট কাজের জন্যেই আপনাকে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষ এসেছে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। যে কাজে তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন, সেই কাজগুলি কি আপনি করতে পেরেছেন?
আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? এমন প্রশ্নের উত্তর আপনি চট করে দিয়ে দিতে পারেন। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা বলবেন ব্যারিস্টার , শিক্ষক, পুলিশ অফিসার, আর্মি কিংবা অন্য কিছু। কেউ কেউ বলে ফেলবেন স্কুলের পরীক্ষায় রচনায় ২০ নম্বর থাকত। ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী’ এই রচনা লিখে ১৮ নম্বর পেয়েছিলাম। রচনা লিখে ২০-এর মধ্যে ১৮ পাওয়া অনেক বেশি।
আমার প্রশ্ন হলো, জীবনে যে লক্ষ্যটিকে আপনি নির্ধারণ করে নিয়েছেন, সেটা কি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত নাকি বাবা-মা, চাচা- চাচি, আত্মীয়স্বজনের তৈরি করে দেয়া সিদ্ধান্ত! আপনি যখন জন্মেছেন, তখন থেকেই এসব শব্দের কথা শুনেছেন। মা-বাবা বলেছেন। চাচা-খালা বলেছেন। বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। ইঞ্জিনিয়ার হবেন। ব্যারিস্টার হবেন। এই কথা আপনি কান দিয়ে শুনেছেন। আপনার ব্রেইনে তা রেকর্ড হয়ে রয়েছে। ব্রেইনে একবার যা রেকর্ড হয়ে যায়, তা আর কখনো ডিলিট বা মুছে ফেলা যায় না। হয়তো আপনি তা স্মরণ করতে পারেন না। কিন্তু বাবা-মায়ের উচ্চারণ করা এই শব্দ থেকেই সূত্রপাত ঘটেছে আপনার জীবনের লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে জাগতিক চাহিদায় আপনি তৈরি করে নিয়েছেন আপনার জীবনের বর্তমান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাবা-মা কিংবা চাচার জাগতিক প্রয়োজনটিই প্রধান্য পেয়ে থাকে।
ডাক্তার হলে অনেক উপার্জন। একটু নামডাক হলেই অনেক রোগী। টাকায় টাকা। বাড়ি-গাড়ি, সব হবে। সমাজে সম্মানও বেড়ে যাবে। ডাক্তারের বাবা। ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যারিস্টার। যে পেশাই তারা নির্ধারণ করে থাকুক না কেন, লক্ষ্যের উদ্দেশ্যটা হলো অর্থপ্রাপ্তি। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাবার ব্যর্থতার দায়িত্ব সন্তানের লক্ষ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। যেমন বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু অল্পের জন্য মেডিকেলে ভর্তি হতে পারেননি। তার স্বপ্ন, ছেলে ডাক্তার হবে। একজন বাবা বিসিএস দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পরে পুলিশের এসআই পদে যোগ দিয়েছিলেন। এখন ইন্সপেক্টর। অথচ তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট একজন বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে এএসপি পদে যোগ দিচ্ছেন। তিনি তাদের স্যালুট করছেন। এই বাবার স্বপ্ন, তার ছেলেও বিসিএস দেবে। এএসপি হবে। বাবা তার সন্তানের মধ্য দিয়ে নিজ স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইছেন। লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। এর অর্থ এ রকম, যে লক্ষ্যটিকে আপনি নিজের বলে দাবি করছেন, সেটি আপনার নিজের নয়, অন্যের। বাবা-মা কিংবা অন্য কারও।
এবার বলুন আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? কোন উদ্দেশ্যে আপনি সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন? আমি জাগতিক চাহিদার বিপক্ষে নই। এই পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা চাওয়ার এবং পাওয়ার অধিকার আপনার আছে। পাশাপাশি শান্তিতে, স্বস্তিতে, আনন্দে থাকার অধিকারও আপনার আছে। জাগতিক চাহিদায় আপনি যে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছেন তাতে আপনি সফল হয়েছেন। অর্থ-বাড়ি-গাড়ি সবই হয়েছে। কিন্তু শান্তি পাচ্ছেন না। স্বস্তি পাচ্ছেন না। কী যেন করতে হবে, কী যেন করতে চান ঠিক বুঝতে পারছেন না। হয়ত মাঝেমধ্যেই আপনার মনে হয়, জীবনে আপনি আরো বেশি কিছু করতে পারতেন। হয়তো অনুভব করছেন, আপনার ভেতর এমন একটি সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে, যা আপনার জীবনে সাফল্য এনে দিতে পারত। যা করছেন, তার বাইরেও আপনার অনেক কিছু করার আছে। যদি এমনটা হয় তাহলে বুঝতে হবে, যে লক্ষ্যটিকে সামনে রেখে আপনি এতদূর এগিয়ে এসেছেন, সেটি হয়ত আপনার নিজের লক্ষ্য ছিল না।
একটি উদাহরন দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাকিব আল হাসান। এই নামটির সঙ্গে সবাই পরিচিত। ক্রিকেট বিশ্বের এক উজ্জ্বল নাম। সে যদি অন্য কিশোরদের মতো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা জজ ব্যারিস্টার হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেত, তাহলে তার অবস্থান এখন কোথায় থাকত? সে তার লক্ষ্য স্থির করেছিল ক্রিকেটার হবার জন্য। বাবা-মা তাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চাপ না দিয়ে ছেলেকে তার নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করেছিলেন। ভর্তি করেছিলেন বিকেএসপিতে। এরই ফলে আজকের এই সাকিব আল হাসান। অর্থ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি সবই অর্জন করেছেন তিনি। বিকেএসপিতে ভর্তি না করে তার বাবা-মা যদি সে সময় সাকিব আল হাসানকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে দিতেন তাহলে কী হতো। বিষয়টি আপনি নিশ্চয় কল্পনা করতে পারছেন।
আপনি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়ত বা অন্য কোনো পেশায় আপনি দক্ষ। তবুও স্বস্তি পাচ্ছেন না। মনে আনন্দ নেই। গতানুগতিক জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। মাঝেমাধ্যেই মন ছুটে যেতে চাইছে অন্য কোথাও। যে লক্ষ্য নিয়ে আপনি এতদূর এসেছেন, সেটি হয়ত আপনার নিজের লক্ষ্য ছিল না। যদি তা হতো তাহলে আপনার মনে এই অস্বস্তি বা যন্ত্রণা থাকত না। মনে কী ছিল, সেটা কি জানেন? জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে মনের কাছে।
মন। আপনার সবচাইতে শক্তিশালী অঙ্গ। একে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। বোঝা যায় না কোথায় সে থাকে। মন যে আপনার আছে তাতে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই। এর যে প্রচন্ড শক্তি আছে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। অথচ আপনার অন্যান্য ফিজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট অর্থাৎ অন্যান্য অঙ্গের মতো একে আপনি ব্যবহার করতে পারেন না। কেন পারেন না! কারণ অন্যান্য অঙ্গকে আপনি ট্রেনিং দিয়েছেন। ডান হাতকে ট্রেনিং দিয়েছেন, বাঁ হাতকে ট্রেনিং দিয়েছেন। চোখ, কান, পা সব অঙ্গকেই ট্রেনিং দিয়েছেন। যে অঙ্গকে যেভাবে ট্রেনিং দিয়েছেন, সেটি সেই কাজ সুন্দরভাবে করে থাকে। যেমন খাবার কাজটার ট্রেনিং ডান হাতের। বাঁ হাত দিয়ে ঠিকমতো খেতে পারবেন না। একবার ভেবে দেখুন তো মনকে ব্যবহার করার কোনো ট্রেনিং আপনি দিয়েছেন কি?
মনের কাছে যেতে হলে, মনকে কাজে লাগাতে হলে কিংবা মনের কাছ থেকে সত্যটা জানতে হলে, তাকে ট্রেনিং দিতে হবে। আধুনিক বিশ্ব এটাকে মাইন্ড ট্রেনিং বলে। মাইন্ড ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি জানা থাকলে আপনি মনের কাছে যেতে পারতেন, শুধু জীবনের লক্ষ্য জেনে নেওয়া নয়, আরো অনেক কিছুই সম্ভব হবে একে ব্যবহার করে, যা আপাতদৃষ্টিতে আপনার অসম্ভব বলেই মনে হবে।
মনে রাখবেন, এই পৃথিবীতে আপনি ছিলেন না। আপনি এসেছেন। আবার চলেও যাবেন। আপনি যেমন নিজের ইচ্ছায় আসেননি, তেমনি নিজের ইচ্ছায় যাবেন না। আপনাকে পাঠানো হয়েছে। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি এমনি এমনি আপনাকে পাঠাননি। এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট কাজের জন্যেই আপনাকে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষ এসেছে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। যে কাজে তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন, সেই কাজগুলি কি আপনি করতে পেরেছেন? আপনি এখনো পৃথিবীতেই আছেন। তার অর্থ আপনার আরো কাজ বাকি আছে। সেই কাজটি সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে জানব? আপনি নিজেই তা জানেন।
যুক্তিবাদী মন আপনাকে আপনার নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। বুঝতে দেয় না আপনি নিজে কোন লক্ষ্যে এগোতে চান। আপনাকে আপনার নিজের কাছে যেতে হবে। নিজের কাছে গিয়ে জানতে চাওয়ার পদ্ধতি হচ্ছে মেডিটেশন, ধ্যান, গভীর চিন্তা। মেডিটেশনের মাধ্যমে নিজের কাছে গেলে আপনি যেমন আপনার লক্ষ্যটি জানতে পারবেন, তেমনি বুঝতে পারবেন কীভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। মেডিটেশনের মাধ্যমে, বা গভীর চিন্তায় নিজের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি সিলভা আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিস্টেম। এর হেড কোয়ার্টার আমেরিকার টেক্সাসে। সারা বিশ্বেই এদের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান এম কিউ মিশন।
তাই আজই সেট করে নিন আপনার জীবনের লক্ষ্যটি। মাইন্ড ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে পৌঁছে যান জীবনের কাঙ্খিত স্থানে। তাহলেই দেখতে পাবেন বাকিটা সময় হয়ে উঠছে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রুপে।
লেখক : ইন্টারন্যাশনাল মাইন্ড ট্রেনার ও কান্ট্রি ডাইরেক্টর, সিলভা আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিসটেম
ছবি : এমকিউ মিশন
silvabangladesh@yahoo.com
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময়ে, ১৯ অক্টোবর ২০১৪
© 2014 – 2018, https:.