যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করে তারা দেশকেও অসম্মান করবে
সালটা ১৯৬৯। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন চলছে। নানা বৈষম্য আর প্রতিবাদ দানা বাধতে থাকে। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই ঘটে আরেক ঘটনা। আমাদের এলাকায় আদিবাসীরা ছিল বেশি। স্যাটেলমেন্টের সরকারি ফি আদায় করতে আদিবাসী এলাকায় যায় ওই অফিসের লোকেরা। কিন্তু আর্থিক দৈন্যের কারণে আদিবাসীরা সে ফি দিতে পারে না। অফিসের লোকেরা তখন তাদের বাড়ি থেকে গরু ধরে এনে বেচে দেয়। এ খবর পাই সহপাঠী সাঁওতাল বন্ধু ফ্রান্সিস ও জোসেফের কাছে।
ধামকুড়া স্কুল থেকে আমরা রওনা হই কমলাপুর স্যাটেলমেন্ট অফিসের দিকে। আশপাশের হাই স্কুল ও প্রাইমারি স্কুলের ছাত্ররাও যুক্ত হয় আমাদের সঙ্গে। সবাই মিলে স্যাটেলমেন্ট অফিস ঘেরাও করি। খবর পেয়ে ভেতর থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে অফিসার বেরিয়ে আসে। গুলির ভয় দেখিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বলে– ‘আমাকে চেনস, আমি মোনায়েম খানের আত্মীয় হই।’
মোনায়েম খানের নামটা শুনতেই যেন ছাত্রদের মনে বিস্ফোরণ ঘটে। ‘ধর ব্যাটাকে’ বলেই শুরু হয় মারামারি। ওরাও গুলি চালায়। ছাত্ররা তখন রেললাইন উপড়ে ফেলে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় মামলা হলে আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্র বয়সেই জেলে ছিলাম চারমাস। পরে এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেব আমাকে ছাড়িয়ে আনেন।
স্কুলে ভোটাভুটিতে জিএস হয়েছিলাম। স্কুল জীবন অন্যরকম ছিল। ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কও চমৎকার ছিল। এখন তো লেখাপড়াটা টিক চিহ্নের ভেতর বন্দি হয়ে গেছে। এ-প্লাসের চিন্তায় পাগল সবাই। নৈতিকতার শিক্ষাও কমে গেছে। অনেক অভিভাবকই ফাঁস করা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে সন্তানের হাতে। ছাত্র-ছাত্রীরা খেলাধুলা করে কম। ফেসবুক আর গেমস নিয়া ব্যস্ত তারা। এ কোন জাতি তৈরি করছি আমরা?
প্রশ্ন রেখেই আলাপচারিতা শুরু করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম। আইজুদ্দিন মন্ডল ও রহিমন বেওয়ার তৃতীয় সন্তান সিরাজুল। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার পালপুর গ্রামে। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই চলে আমাদের আলোচনা।
সিরাজুলদের পরিবার ছিল বড়। আট ভাই ও এক বোনের সংসার। বাবার কৃষি পেশায় পরিবার চলত নানা টানাহেচরায়। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি পালপুর প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ধামকুড়া হাট স্কুলে ভর্তি হন ষষ্ট শ্রেণীতে। পরে দশম শ্রেণীতে চলে আসেন প্রেমতলী হাই স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই এসএসসি পরিক্ষার্থী।
রাজশাহী ও চাপাইয়ে মালদহের লোক ছিল বেশি। এদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলিম লীগের অনুসারী। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিতেন এইচ এম কামরুজ্জামান। ছাত্রনেতা ছিলেন মহসিন, বুলু,কুদ্দুস প্রমুখ। সত্তরের নির্বাচনে সারাদেশে জয়লাভ করলেও ক্ষমতা পায় না আওয়ামী লীগ। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, রেসকোর্স ময়দানে। ওই ভাষণই বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণা।
সিরাজুলের ভাষায়–‘ভাষণটি আমরা শুনি একদিন পর, রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন–‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই…..আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো….।’ এই কথাগুলোতেই সব স্পষ্ট হয়ে যায়।’
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। জেলা শহরগুলোও তারা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। রাজশাহীতে ইপিআর ক্যাম্প ও পুলিশ লাইনে ওরা বাঙালি সদস্যদের ওপর প্রথম আক্রমণ করে। ওদের সাথে যুক্ত হয় অস্ত্রধারী বিহারীরাও। এ সময় বহু হতাহত হয়। তখন অনেক বাঙালি সদস্য জীবন বাঁচাতে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসে। লাঠিসোটা আর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সিরাজুল, মাহবুব, মন্টু, আবুল কালাম আজাদসহ স্থানীয় শত শত বাঙালি। তারা প্রতিরোধ গড়ে রাজশাহী কোর্টের পশ্চিমে, কাশিয়াডাঙ্গা ও কাঠালবাড়িয়ায়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে পারে না। এক সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে আত্মগোপনে চলে যায় যে যার মতো।
আপনি তখন কী করলেন?
সিরাজুল বলেন–‘এপ্রিলের শেষ দিকের কথা। রাজশাহী থেকে আর্মিরা বিভিন্ন জায়গায় অ্যাডভান্স হচ্ছে। এলাকায় বিহারী ছিল বেশি। আমাদের কাছে পাকিস্তান মানেই ছিল বিহারী। ওরা ছিল উগ্র। বিহারী মুসলিম মাস্টার শান্তি কমিটি গঠন করে। কারা কারা আওয়ামী লীগের অনুসারি সেটা দেখিয়ে দেওয়াই ছিল তার কাজ। এসব দেখে আব্বা ভয় পেয়ে যায়। আমারে ডেকে বলেন– ‘তুমি চইলা যাও। না হইলে ওরা মাইরা ফেলবে। বঙ্গবন্ধু যদি বাইচা থাকে তাহলে তোমরা আসতে পারবা। না হলে আসতে পারবা না। লড়াই শুরু হইছে। দেখবা, কিছু একটা ঘটবো। ’ এরপরই আমি ইন্ডিয়া চলে যাই।’
রাজাবাড়ির হাট দিয়ে পদ্মা পাড় হয়ে সিরাজুল চলে আসেন মুর্শিদাবাদের টিকলির চরে, ফুপুর বাড়িতে। আখেরিগঞ্জ হাটে তখন হাজার হাজার শরণার্থী। মুর্শিদাবাদের লোকেরা তখনও মুক্তিযুদ্ধকে সার্পোট করেনি। তারা বলতো–‘পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র। আমাদেরই ভাই। সেটাকে তোমরা ভাইঙ্গা দিবা?’
ভিডিও : কেমন দেশ চান জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম
ওদের কথায় মন খারাপ হতো। মুসলিম হলে ওরা কেন গণহত্যা চালালো? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় সিরাজুলের মনে। অতঃপর একদিন তিনি নাম লেখান সেকালিপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে। কিছুদিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর ২ জুলাই তারিখে ভারতীয় আর্মিরা আসে ক্যাম্পে। বাছাই করে অন্যদের সঙ্গে সিরাজুলকেও পাঠিয়ে দেয় ট্রেনিংয়ে, বিহার চাকুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাকী ইতিহাস শুনি তাঁর জবানিতে।
‘ট্রেনিং হয় আটাশ দিন। ভারতীয় শিক ও গুরখা রেজিমেন্টের সেনারা ছিলেন। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ৩৫২০৮। পাহাড়ের ওপর ছিল ক্যাম্প। গ্রেনেড থ্রো ও বিভিন্ন অস্ত্র চালানো শিখি। প্রথম দিকে মার্ক ফোরের ধাক্কা আমরা সহ্য করতে পারতাম না। আমার ব্যাচে ছিল ৪০-৫০জন। কসম প্যারড হয় চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে। পরে আমাদের অস্ত্র দেওয়া হয় সাত নম্বর লালগোলা দুইল্লাউড়ি ক্যাম্প থেকে।’
কথার পিঠে কথা চলছিল। ক্রমেই একাত্তরের স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে থাকেন সিরাজুল। মুক্তিযুদ্ধে দুধর্ষ এক অপারেশনের কথা জানান তিনি। তাঁর ভাষায়– ‘সাত নম্বর সেক্টরে প্রথম অপারশেন ছিল নওগায়, রাণীনগর রেললাইনের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া। সেটি সফল হতেই মনোবল যায় বেড়ে। প্রস্তুতি চলে আরেক অপারেশনের। গোদাগাড়ির প্রেমতলীতে শান্তি কমিটির সভাপতি সিরাজুলের বাড়িতে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। নির্দেশ আসে সেখানে অপারেশন চালাতে হবে। আগেই একটা গ্রুপ ভেতরে ঢোকে। আমরা পুরা প্লাটুন পরে ঢুকি। কমান্ডে নুর হামিম বীরপ্রতীক। সঙ্গে ছিলেন নেভির খালেকও।
জোসনা রাত ছিল। ধানের জমি। আমরা জানতাম পাকিস্তানি আর্মিরা বাড়ির ভেতরে পজিশনে। কিন্তু তারা বাড়ির ছাদে বান্কার করে বসে ছিল। আমাদের রেইকি ছিল ভুল। ফলে প্রথমেই আমরা ওদের ফায়ারের মুখে পড়ি। আমরাও গুলি চালাই। বরেন্দ্র অঞ্চলে কান্দর (উঁচু-নিচু) জমি। অসম সাহস নিয়ে কান্দরের ওপরের দিকেই যেতে থাকেন খালেক ভাই। হঠাৎ গুলি লাগে তাঁর বুকে। গুলিটি পেছন দিক দিয়ে ভোগলা হয়ে বেরিয়ে যায়। কয়েক পাক ঘুরে চিৎকার দিয়ে তিনি ছিটকে পড়েন। রক্তে ভরে যায় তাঁর সারা শরীর। কোনোরকমে তাঁর পা ধরে নামিয়ে আনি। এক ঘন্টা চলে গোলাগুলি। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। খালেক ভাই মেন্টাল অবস্থায় এখনও বেঁচে আছেন রাজশাহীতে।’
প্রথম দিকে সিরাজুলরা গেরিলা অপারেশন করতেন। পরে বাছাই করে তাদের ১৭জনকে নেওয়া হয় ‘রেডে’। রেড মানে যে দলটি আক্রমণ করে, ধ্বংস করে চলে আসবে। কয়েকটা অপারেশনের পরই তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফ্রন্টে, চাপাঁইনবাবগঞ্জের ফরিদপুর বিওপিতে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়া ব্রিজ অপারেশনে নিহত হয় আশিজন সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা।
কীভাবে?
সিরাজুল বলেন–‘ চাপাঁইনবাবগঞ্জের সঙ্গে রাজশাহীর মূল সংযোগ সড়কে ছিল অভয়া ব্রিজটি। এ অপারেশনের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। আরও ছিলেন বদিউজ্জামান টুনু ভাই, কুষ্টিয়ার নুরুল ইসলাম প্রমুখসহ তিন প্লাটুন যোদ্ধা।
আমরা ছিলাম ফরিদপুর বিওপিতে। বন্যা শুরু হয়েছে মাত্র। রাতে নৌকায় রওনা দিয়ে কাছকাছি পাট খেতে এক গলা পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। কেউ কেউ পজিশন নেয় রোডের দুই ধারে। ওরা ব্রিজের ওপর বান্কার করে পজিশনে ছিল। রাত তখন সাড়ে তিনটার মতো। আমরা ফায়ার ওপেন করি। কিছু বুঝে ওটার আগেই তিন দিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়ে তারা। স্পটেই মারা যায় আশিজন পাকিস্তানি সেনা। তবে ওই অপারেশনে আমরা হারাই তৌহিদ নামে সিলেটের এক ছেলেকে। জীবনকে বাজি রেখেই সে নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে গুলি চালাচ্ছিল। তাঁর মতো লাখো শহিদের রক্তেই আমরা পেয়েছি প্রিয় বাংলাদেশ।’
এক অপারেশনে গুলিবিদ্ধ হন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম নিজেই। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তাঁর ডান পায়ের উরু ভেদ করে ভেইন ছিড়ে বেরিয়ে যায়। কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? প্রশ্ন শুনে এ যোদ্ধার চোখে অশ্রু ঝরে। আমরা তখন নিরব থাকি। অতঃপর নিজেকে সামলে তিনি বলেন ওইদিনের আদ্যপান্ত।
তাঁর ভাষায়–‘ফরিদপুর বিওপিও থেকে আমরা তখন ফ্রন্টে। নারায়নপুর, লাক্ষ্মীনারায়নপুর, কালিনগর, ইসলামপুর, মুলাটলি, বারেঘরিয়া, শিবগঞ্জ– পুরোটা নিয়ে আমাদের ডিফেন্স। ঈদের দিনেও প্রচন্ড লড়াই হয়। হতাহত হয় বহু ছেলে। এরপর যুদ্ধ করতে করতেই আমরা ইসলামপুর পর্যন্ত চলে আসি। পাকিস্তানি সেনারা মহানন্দা নদী পাড় হয়ে চলে যায় চাপাঁইনবাবগঞ্জে। আমাদের পজিশন তখন ইসলামপুর, নারায়নপুর, সূর্য নারায়নপুর– এ সব জায়গায়।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা ইসলামপুরে। সঙ্গে সাইদুর, নুর হামিম, আজাদ, দাউদসহ পুরা প্লাটুন। মহানন্দা নদীর ধারে হাসিনা গার্লস স্কুলের কাছে আমরা কাউন্টার অ্যাটাক করি। তখন সকাল ৯টা। প্রচন্ড লড়াই চলছিল। পাকিস্থানি সেনারা বিডি হলে, গোরাস্তানের ওপারে। ওরা প্রচণ্ড গুলি চালায় আরআর গান দিয়ে। আমরাও প্রত্যুত্তর দিই। ওরা তখন পিছু হটে। এগিয়ে গিয়ে দ্রুত বিডি হলের সামনে ওদের বান্কারে আমরা পজিশন নিই।
বেলা তখন ৪টা। পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ কাউন্টার অ্যাটাক করে। আমি আর সাইদুর ওদের টার্গেটে পড়ে যাই। এলএমজি চালাচ্ছিলাম। ওরাও থেমে থেমে গুলি চালাচ্ছে। বাচ্চু এমপির বাড়ির পাশ দিয়ে ক্রলিং করে দক্ষিণে যাব। একটু উঁচু জায়গা ক্রলিং করে পাড় হতে হবে। এগোতে গিয়ে একটি গুলি আমার ডান পায়ের উরু ভেদ করে ভেইন ছিড়ে বেরিয়ে যায়। প্রথম কিছু বুঝতে পারিনি। দেখলাম রক্তে পা ভেজা। সাইদুর আমাকে টেনে নিতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ওর দিকে গুলি চালাতে থাকে। আমি বলি–‘তুই বিপদে পড়বি। চলে যা।’ ও উত্তর দেয়– ‘আমি তোরে ছাড়া যামু না। তুই আমার পিঠে ওঠ, তোরে আমি ক্রলিং করে নিয়া যামু।’ আমার সে অবস্থা ছিল না। একাত্তরে সহযোদ্ধারা ছিল আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। সে সহযোদ্ধাদের সাহায্য পেতে পেছন দিকে সরে আসে।
রক্ত ঝরে গিয়ে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। চোখও ঝাপসা হয়ে আসে। মনে হলো মা ডাকছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা লাগে। পাশে ডোবার পানি খেতেই বমি হয়ে যায়। ভেবেছিলাম মরে যাব। হঠাৎ এক মহিলা এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় তার বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণ পরেই কানে আসে মাগরিবের আজান। এরপরই জ্ঞান হারাই। চোখ মেলে দেখি আমি মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর হাসাপাতালে। নার্স এসে জানায় আমাদের দেশ স্বাধীন। ওই মহিলা যদি না থাকত তাহলে হয়তো বেঁচে আসতে পারতাম না। এখন বয়স বাড়ছে। শীত এলেই ওই পায়ে ব্যাথা হয়। তখন একাত্তরটা মনে পড়ে যায়। হাঁটি খুড়িয়ে খুড়িয়ে। এ যুদ্ধটা মৃত্যুর আগ পর্যন্তই চলবে!’
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘স্বাধীনতা পেয়েছি, একটা পতাকা আর মানচিত্র পেয়েছি, কথা বলতে পারছি নিজ ভাষায়, কেউ শোষণ করতে পারছে না–এটাই ছিল তখন স্বপ্ন। সে স্বপ্ন তো বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরে দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হিসাব মিলাতে পারি না ভাই।’
কেন?
তিনি বলেন–‘স্বাধীন দেশে বাঙালিরাই হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে, স্বাধীন দেশের পতাকা তুলে দেওয়া হলো রাজাকারদের হাতে। আমি গরিব আর রাজাকাররা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। পৃথিবীতে কি এমন দেশ আছে যে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীরাও রাজনীতি করতে পারে?’
ভিডিও: তালিকা ও দেশভাবনার কথা বলছেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মূল্যায়ন করেছেন এই বীর যোদ্ধা ঠিক এভাবে:
‘একটা যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর সাহসী পদক্ষেপ ছিল। তিনি আপ্রাণ চেষ্টাও করেছেন। সারা পৃথিবী থেকে ত্রাণ আসছে। সেটা যে যেভাবে পারছে পকেটে ভরছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শীর্ষ লেভেলেও দ্বন্দ শুরু হয়। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর শক্র বাড়তে থাকে। তিনি সবাইকে বিশ্বাস করতেন। বুকে জড়িয়ে ধরতেন। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর উদারতাকে ধারণ করতে পারিনি।’
কথা ওঠে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল বলেন–‘সব যুদ্ধাপরাধীকেই আইনের আওতায় আনা উচিত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বড় যুদ্ধাপরাধী ১৯৬জনকে ক্ষমা করেন নি। বরং তার আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইন হয়েছিল বলেই বর্তমানে ট্রাইবূন্যাল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়– ‘ইতিহাস বলে ঘরের শক্র বিভীষণ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার নেতা। যে দেশের মানুষকে তিনি এতো ভালবাসেন সে দেশের কেউ তাকে মারতে পারবে এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। কিন্তু তার পায়ের নিচেই বসে ছিল শক্রু। বাংলার কলঙ্কজনক ইতিহাস এই হত্যাকাণ্ড। পঁচাত্তরের পনের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৃত্যু ঘটেছিল।’
এরপরই ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার বন্ধ করে দেন তিনি। সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী বানান শাহ আজিজের মতো যুদ্ধাপরাধী ও দালালকে। তখনকার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল বলেন– ‘জিয়া ইতিহাসকে কলুষিত করেছে। আমাদের স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছে রাজাকারদের হাতে। তখন মনে হতো এটা চোখে দেখার আগেই কেন আল্লাহ তুলে নিয়ে যায় না। এই স্বাধীনতা তো আমার চাই নাই। এখনও দেখেন তার দল রাজাকারদের দল ছাড়া চলতেই পারে না। আবার সরকারও রাজাকারের দলকে নিষিদ্ধ করছে না। এ সব কি মানা যায় বলেন।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ১৯৭২-১৯৭৩ সালেই চূড়ান্ত করা দরকার ছিল বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। তিনি বলেন–‘অস্ত্র জমাদানের তালিকা, ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্তদের তালিকা ও বিভিন্ন সেক্টরের তালিকা এক করেই তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। ১ লাখ ২৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এখন আড়াই-তিন লাখ। এরা কোথা থেকে এলো? ট্রেনিং নাই, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন মাত্র– তাকেও মুক্তিযোদ্ধা বলছেন। তাহলে ক্যাটাগরি করা জরুরী ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার থেকেও বেশি জরুরী ছিল রাজাকারদের তালিকা করা। তাই রাজাকারদের তালিকা আগে চূড়ান্ত করেন।’
মুুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদানের কথা তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল। অতঃপর দুঃখ করে বলেন–‘একাত্তরে আমাদের এখানে তিন’শরও বেশি আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। দেশ স্বাধীনের জন্য ওরা বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু কি পেল ওরা। ওদের জমি দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালী বাঙালিরা। আমার বাসায় থাকে অনিল। ও সাঁওতাল। রাজশাহীর পাল পাড়াতে বাড়ি। ওদের নামে সব জমির রেকর্ড। অথচ সেটা দখল করে মসজিদ করা হয়েছে। হেবা না হলে তো ওই মসজিদ অবৈধ। ওখানে নামাজ পড়লে কি নামাজ হবে? সহযোদ্ধা আদিবাসী বিশ্বজিত আছেন। আমি দেশ পেলাম। কিন্তু ওদের শোষণটা তো রয়েই গেল!
স্বাধীন দেশে ভাললাগা অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন–‘দেশের সুনাম ও মানুষের শান্তি দেখলে ভাল লাগে। তখন মনে হয় মুক্তিযুদ্ধটা স্বার্থক হয়েছে।’
খারাপ লাগে কখন?
‘যখন দেখি কোটার আন্দোলনে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের গালি দিচ্ছে, নিজেকে রাজাকারের বাচ্চা বলছে–তখন খুব কষ্ট পাই। আমরা নাকি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা তো বঙ্গবন্ধুকে বলিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০% কোটা রাখুন। সরকার চাইলে কোটার সংস্কার করুক। কিন্তু এই ইস্যুতে মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী স্লোগান কারা দিল? তাদের পরিচয়টাও স্পষ্ট হওয়া উচিত। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করে তারা দেশকেও অসম্মান করবে।’
শত সমস্যা পেরিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবে– এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের। তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন–‘তোমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটাকে ধারণ করো। দেশটাকে ভালবেসে এগিয়ে নিও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লড়াইটা তোমাদেরকেই এগিয়ে নিতে হবে।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম।
ট্রেনিং নেন : ভারতের বিহার চাকুলিয়ায়।
এফএফ নম্বর : ৩৫২০৮।
যুদ্ধ করেছেন : সাত নম্বর সেক্টরের রাজশাহী ও চাপাঁইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।
যুদ্ধাহত : ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেল বেলা। ফ্রন্ট ফাইটে চাপাঁইনবাবগঞ্জের বিডি হলের সামনে পকিস্তানি সেনাদের গুলি তাঁর ডান পায়ের উরু ভেদ করে মেইন বেইন ছিড়ে বেরিয়ে যায়।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১ জুন ২০১৮
© 2018, https:.