আদিবাসীকলাম

হারিয়ে যাচ্ছে মান্দিদের আদি উৎসব

সারা দেশে পালিত হচ্ছে মান্দিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘ওয়ানগালা’। ‘ওয়ানগালা, ওয়ানগালা আচিকরাং ওয়ানগালা, ওয়ানগালা, ওয়ানাগালা… মিদ্দিনা রুগালা।’ এ সময় এমন গানের সুর ওঠে মান্দি গ্রামগুলোতে। কীভাবে পালিত হচ্ছে এ উৎসবটি? তা জানার আগে কেন মান্দিরা ওয়ানগালা পালন করে? সেটি তুলে ধরছি।

সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার সময় এ উৎসবের আয়োজন চলে। তার আগে মান্দিদের নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ থাকে। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। এদের বিশ্বাস, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদ্‌গম ও তার পরিপক্বতা ঘটায়। তাই ফসল গ্রহণের আগে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় এ উৎসবে। একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলা হয়ে থাকে। মান্দিরা ওয়ানগালার প্রথম দিনকে ‘রুগালা’, দ্বিতীয় দিনকে ‘সাসাত স’আ’ ও তৃতীয় দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’। নানা আচারের মাধ্যমে তারা দিনগুলো পালন করে।

ধান পাকলে ড়্গেতের কিছু অংশের (আ’সিরকার স্থান) ধান কাটা হয় সর্বশেষে, ধূপ উৎসর্গ করে। অতঃপর তা অঁাটি বেঁধে আনন্দ ধ্বনিতে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। গারোদের বিশ্বাস, ফসলের সঙ্গে দেবতারাও এভাবে বাড়িতে প্রবেশ করে।

উৎসবের প্রথমে মোরগ উৎসর্গ করা হয় সূর্যদেবতার নামে। অতঃপর বাড়ি বাড়ি চলে নতুন ধানের চাল দিয়ে ‘চু’ বা মদ তৈরির প্রস্তুতি। নকমা (গ্রামপ্রধান) সভা ডেকে উৎসবের দিন ঠিক করেন। অতঃপর ঘরের সবকিছু পরিষ্কারকরণের পাশাপাশি সবার জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক।

প্রথম দিনে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয় মদসহ নতুন ধানের ভাত, নতুন ফলমূল, শাকসবজি ও পশুপাখি। ওইদিন নকমা ঝরনা বা খাল থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে আনেন। দুপুরের আগে একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে ড়্গেতে যান। সেখানে আ’সিরকা স্থানে সূর্যদেবতার উদ্দেশে সেটি উৎসর্গ করে পূজা-অর্চনা করেন। অতঃপর বাড়ি ফিরে ঘরের মাঝখানে কলাপাতায় নতুন ধানের ভাতসহ অন্য শস্যসমূহ সাজিয়ে রাখেন। পাশেই রাখা হয় কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো। অন্যপাশে থাকে বাদ্যযন্ত্রগুলো। দুপুরের পরই নকমার বাড়িতে শুরু হয় ওয়ানগালার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা। এভাবে আদি থেকেই নানা আচারের মাধ্যমেই গারোরা ওয়ানগালা পালন করে আসছে, যা তাদের সংস্কৃতির অংশ।

ওয়ানগালা পালনের পেছনে মান্দি সমাজে বহুল প্রচলিত রয়েছে একটি অনবদ্য কাহিনী। যার ভাবার্থটি এমন– আদিকালের কথা। তখন মানুষ বনের আলু, কচু, গাছের ফলমূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করত। ধান, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। সূর্য দেবতা ছিলেন ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের একচেটিয়া অধিকারী।

তিনি এক দিন বাজারে যাচ্ছিলেন। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এ জগতের এক লোক। তার পরনে নোংরা পোশাক। খাওয়ার জন্য থলেতে রয়েছে আলু। সূর্য দেবতার মতো সুপুরুষদের পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখে লজ্জায় বড় এক পাথরের আড়ালে গিয়ে সে লুকায়। দেবতা তা খেয়াল করলেন। কাছে গিয়ে তাকে বেরিয়ে আসতে বললেন। নাম জানতে চাইলে লোকটি নাম জানাল। সে নাম মিলে যায় সূর্যদেবতার নামের সঙ্গে।

নামে নামে মিল থাকায় সূর্যদেবতা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লেন। গাছের ছায়ায় একসঙ্গে খেতেও বসেন। তিনি দেখলেন, তার বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। তার খুব মায়া হলো। তাকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। অতঃপর ধান ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের বীজ বপন করেন কি না জানতে চাইলেন। বন্ধুটি উত্তরে বললেন, ‘ধান কী, তা তারা জানে না।’

শুনেই সূর্য দেবতার দয়া হয়। বললেন, ‘আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি ঝুম চাষ করে ঝুমক্ষেতে ধান বুনবে। যখন ধান পাকবে, আমাকে স্মরণ করবে। আমার আশীর্বাদে, আমার দানে আনন্দ করবে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাবে। তাহলে প্রতি বছর তোমাকে ও তোমার পরিবার-পরিজনকে আশীর্বাদ করব। এ আমার প্রতিশ্রুতি।’

বাড়ি ফিরে সূর্য দেবতার প্রতিশ্রুতি মতো তার দাসকে দিয়ে বন্ধুর কাছে ভালো ধানের বীজ পাঠালেন। ওই দাস ছিল খুব ঈর্ষাপরায়ণ। বীজগুলোকে সে আগুনে ভেজে নষ্ট করে তারপরই পৌঁছে দিল। সরল বিশ্বাসে বন্ধুটি ড়্গেতে তা বুনলেন। দখিনা বাতাস এলো। বৃষ্টিও হলো। কিন্তু বীজ থেকে কোনো চারা গজাল না। তা দেখে তিনি হতাশ! সূর্য দেবতা তাকে ঠকিয়েছেন ভেবে কষ্ট পেলেন। একদিন দেবতার অন্য দাসদের পেয়ে ক্রোধে তাদের বেঁধে রাখলেন।

তাদের কান্নার শব্দে সূর্য দেবতা এসে হাজির হন। বন্ধুর মুখে সব শুনে ব্যথিতও হন। অতঃপর বলেন, আমি পুনরায় তোমাকে সতেজ ধানের বীজ পাঠাব। তাই করলেন তিনি।

নব-উদ্যমে পরিশ্রম করে বন্ধুটি ড়্গেতে ধানের সে বীজ বুনলেন। বীজ থেকে এবার ধানগাছ গজিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল। তা দেখে মনে আনন্দের দোলা লাগে।

ধান পাকছে, কয়েক দিন পরই কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেক ঘটনা! দেবতার কয়েকজন দাস গোপনে ড়্গেতের কিছু ধান কেটে চুরি করে নিয়ে যায়। অতঃপর সূর্য দেবতার কাছে অভিযোগ করে, ‘দেখ, আগে তোমাকে না দিয়েই পাকা ধানগুলো তোমার বন্ধু কেটে খেয়েছে। তোমাকে সে উপেক্ষা করেছে, অসম্মান করেছে।’

দাসদের কথায় দেবতা রাগান্বিত হন। অতঃপর বন্ধুর ছেলে ও দাসদের ধরে এনে বন্দি করে রাখেন। এ খবর শুনে সূর্য দেবতার কাছে ছুটে যান বন্ধুটি। অভিযোগ শুনে অনুনয় করে বলেন, ‘কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে কেটে নিয়েছে। আমি তোমাকে সম্মান করি ও করব।’ দেবতা এবার পুরো ঘটনা বুঝতে পারলেন। ভুল শুধরে নতুন করে তারা আবার বন্ধুত্ব গড়েন।

এরপর নতুন ফসল ওঠে। ওই বন্ধু প্রথম মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে দেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন মদিরা ও ধূপ প্রভৃতি উৎসর্গ করেন। আকাশ, সূর্য ও উর্বরতার দেবতা তখন খুশি হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘এ ব্যক্তি ও তার বংশধরদের ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্য আশীর্বাদযুক্ত হোক। প্রতি বছর ফসল কাটার ঋতুতে আমি পৃথিবীতে ফিরব আশীর্বাদ করতে।’ মান্দিদের বিশ্বাস, ওয়ানগালার মাধ্যমে তাই-ই হয়ে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে।

সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে মান্দিদের উৎসবগুলো। এবারও বিভিন্ন স্থানে ওয়ানগালা উৎসবটি কেবল নাচ-গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মধুপুরে বসবাসরত আদি ধর্ম সাংসারেক পালনকারী কয়েক পরিবার ছাড়া এ দেশে মান্দিদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তারা ওয়ানগালা উৎসব পালন করলেও তা কেবল নাচ-গান আর কিছু আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। ধর্মান্তরের ফলে পূর্ব পুরুষদের আদি আচারগুলো অনেকের কাছে এখন কুসংস্কার মাত্র। ফলে এ প্রজন্মের অনেক মান্দিও বঞ্চিত ও নিরুৎসাহিত হচ্ছে ওয়ানগালার আদি রীতি সম্পর্কে জানতে। এভাবে মান্দিরা হারিয়ে ফেলছে এ উৎসবের আদি রূপটিকে।

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখতে ওয়ানগালা উৎসবের আদি আচার ও অন্তরালের গদ্যগুলো প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। এ উদ্যোগ নিতে হবে মান্দিদেরই। এ ছাড়া রাষ্ট্রেরও উচিত এই উৎসব পালনে উৎসাহিতকরণের পাশাপাশি প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা করা। কেননা, ওয়ানগালার মতো উৎসবগুলো বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে। তাই মনে রাখতে হবে, ওয়ানগালা শুধু মান্দিদের উৎসবই নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩০ নভেম্বর ২০১৯

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button