কলাম

পুরস্কার ও উপহার হোক মুক্তিযুদ্ধের বই

সামনেই মহান বিজয় দিবস। সারা দেশে সরকারিভাবে পালিত হয় এ দিনটি। উপজেলা পর্যায়ে তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের শুভসূচনা হয়। লাখো শহীদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে। স্মরণ করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত বীরদের সংবর্ধনা প্রদানসহ তাদের যুদ্ধস্মৃতি, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস শুনে থাকি তাদের মুখেই। কেননা, তারা বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

বিজয় দিবসে প্রতিটি উপজেলায় কুচকাওয়াজ, ডিসপ্লেসহ নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন চলে। এতে অংশ নেয় সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ডিসপ্লেতে ছাত্রছাত্রীরা চমৎকারভাবে তুলে ধরে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাপ্রবাহ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও প্রাধান্য পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, নাটক ও চলচ্চিত্র।

কিন্তু কেন এই আয়োজন? রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয়কে উদযাপনের মাধ্যমেই কি সীমাবদ্ধ থাকে এটি? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস এবং বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। যখন কেউ এই আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস জানবে, তখন সে যে শুধু দেশের জন্য একটি গভীর ভালোবাসা আর মমতা অনুভব করবে, তা নয়, এই দেশ, এই মানুষের কথা ভেবে গর্বে তার বুক ফুলে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে প্রজন্ম। এভাবেই বীরত্বের ইতিহাস ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এটিও বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। এ ছাড়া ওইদিন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রায় সব সরকারি কর্মকর্তা একটি টোকেন উপহারও পেয়ে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ জেলা ও উপজেলায় এই পুরস্কার ও উপহার হিসেবে দেওয়া হয় মেলামাইন বা নানা ধরনের ক্রোকারিজের মগ, গস্নাস, প্লেট প্রভ…তি।

প্রতিযোগিতার আয়োজন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হলেও কেন পুরস্কার বা উপহার হিসেবে থাকে না মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই? অনেকেই মনে করেন, জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে সরকারি নির্দেশনায় পুরস্কার বা উপহার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রুচি-অভিরুচি ও স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতেই তারা পুরস্কার ও উপহার কিনে থাকেন। তবে কেউ কেউ বিষয়টির গুরুত্ব দিয়ে বই কেনেন। কিন্তু এই সংখ্যাটি সারা দেশ বিবেচনায় খুবই নগণ্য।

জাতীয় দিবসে পুরস্কারের বই কেনা নিয়ে অনেকেই পাঠাভ্যাস না থাকার অজুহাতকে তুলে ধরেন। কিন্তু পাঠাভ্যাস তৈরির দায়িত্ব নেওয়া থেকেও তো পিছিয়ে গেলে চলবে না। ছাত্রছাত্রীরা যখন পুরস্কার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বই পাবে, তখন ওই বইটি পড়ার প্রতিও তার আগ্রহ বাড়বে। সেটি পাঠ করে সে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় বা কাহিনী সম্পর্কে জানবে। তার মনোজগতেও তখন একটি বড় পরিবর্তন ঘটবে।

সারা দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিজয় দিবসের প্রতিযোগিতা ও উপহারের জন্য যদি মাত্র ৫০টি করেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই কেনা হয়, তবে প্রায় তিন লাখ মুক্তিযুদ্ধের বই পাঠকের হাতে পৌঁছাবে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় সম্পর্কে জানার পাশাপাশি উপহার হিসেবে প্রিয়জনকে বই দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। এতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের চাহিদা যেমন বাড়বে, তেমনি তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনার কাজটিও গুরুত্ব পাবে।

মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ, ভালোবাসা, কষ্টের অনুভূতি ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাদের আকা•ক্ষা আর স্বপ্নগুলোও তুলে আনতে হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন যারা, তাদের ইতিহাসও তুলে ধরা প্রয়োজন প্রজন্মের মধ্যে। এটি শুধু তুলে আনলেই হবে না। বই আকারে সেটি সারা দেশে ছড়িয়েও দিতে হবে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে জানা ও ইতিহাস তুলে আনার কাজে আগ্রহী করতে হবে প্রজন্মকে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে না পারি, বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের ইতিহাস যদি প্রজন্মের মধ্যে পৌঁছাতে না পারি, তবে কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে প্রজন্ম। কীভাবে তাদের হাত ধরেই দেশটা হবে সোনার বাংলা! তাই এ ড়্গেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে বিজয় দিবসসহ সারা দেশের জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো। এর অন্যতম মাধ্যম হতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই।

এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ দ্রব্যাদি প্রদান বন্ধ ও মানসম্মত বই দেওয়ার কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। বিশিষ্টজনরা এই দাবি জানিয়ে আসছেন অনেক আগ থেকেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) একটি পরিপত্র জারি করে। যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার হিসেবে থালা, বাটি, মগ, জগসহ কোনো ধরনের ক্রোকারিজসামগ্রী না দিতে এবং এসবের পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে বই প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মাউশির তৎকালীন পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আবদুল মান্নানের স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়েছে, বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রোকারিজসামগ্রী বিতরণ করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসামগ্রী হিসেবে এসব পণ্য আদৌ পরিগণিত হয় না। ছাত্রছাত্রীদের উপহার হিসেবে শ্রেণি উপযোগী বই দিতে হবে। শিক্ষকরা এসব বই নির্বাচন করবেন। এটি নিশ্চিত করতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এটি সরকারের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, এই নির্দেশনা এখনো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি প্রতিফলিত হচ্ছে না। পাশাপাশি প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পুরস্কার হিসেবে বই প্রদানের নির্দেশনা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। এ ছাড়া এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও আন্তরিক ও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। কেননা, আমাদের কোমলমতি শিশুরা উপহার পাবে বই, বইয়ের সঙ্গেই কাটবে তাদের প্রহর। এর চেয়ে আশার কথা আর কী হতে পারে।

ছোট থেকেই শিশুদের হাতে ভালো ভালো বই তুলে দিতে হবে। শিক্ষাজীবনে পড়তে না পারার কারণে যত সমস্যার সৃষ্টি হয়। গুণগত মানের শিক্ষা অর্জনও সম্ভব হয় না শুধু পঠনদক্ষতার অভাবেই। শিশুদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে তাই তাদের হাতে ‘পড়তে শেখার’ সহজ ও আনন্দ পাওয়ার মতো বই দিতে হবে। এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে লেখক ও প্রকাশকদেরও। শিক্ষার্থীদের জন্য বয়সভিত্তিক মানসম্মত বই তৈরি করতেও করতে হবে। বিক্রির লোভে এক শ্রেণির বিক্রেতারা যেন নিমœমানের বই শিশুদের তুলে দিতে না পারে, সেদিকেও সবার দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

২০২০ সালে পূর্ণ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আবার ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মতারিখ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিববর্ষ’ পালিত হবে। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় দিবসগুলোকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালনের কথা বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে প্রতিযোগিতা ও উপহারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলো প্রদানের সরকারি নির্দেশনা প্রদান বিশেষ প্রয়োজন। বিজয় দিবসসহ সারা দেশের জাতীয় অনুষ্ঠানে পুরস্কার ও উপহার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই প্রদানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মতো নির্দেশনা দেওয়া হবে– এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button