আদিবাসী

জাতির নাম কেন মালো?

সমতলের আদিবাসী- ০১

আদিবাসী মালোরা এ অঞ্চলে এসেছে ভারতের রাঁচি থেকে। এদের গানেও মিলে তার সত্যতা ‘রাঁচি থেকে আসলো ঘাসী, তারপর হলো আদিবাসী।’ ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার শীতল গ্রামে রয়েছে প্রায় দেড়শটি মালো পরিবার। একসময় এদের পূর্বপুরুষরা বাস করত রংপুরের তাজহাটে। কলেরা ও ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে বহুপূর্বে এরা এসে বসতি গড়ে শীতল গ্রামে। দিনাজপুর ছাড়াও রংপুর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, উচায়,পলিচাঁদপুর, চাঁদপুর, পাথরঘাটা,বীরনগর, বদলগাছী, পাহাড়পুর, নওগাঁ,মহাদেবপুর, মানমাছি, সোনাপুর, হিলি, শাহজাদপুর, ধারজুরু, দাউদপুর প্রভৃতি এলাকায় মালো অধিবাসীদের বসবাস। এছাড়া মৌলভীবাজার জেলার মৃতিংগা চা বাগান, চাটলাপাড়া চা বাগান, দেওয়ানদি চা বাগান, দেওরাছড়া চা বাগান, চম্পাহাড়ি চা বাগান, আলীনগর চা বাগান ও সনচড়া চা বাগানেও মালোরা বাস করেন। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের রাঁচি ও জলপাইগুড়িতে অধিক সংখ্যক মালো আদিবাসী রয়েছে।

জাতির নাম কেন-মালো? ইংরেজ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা প্রজাদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়। এতে প্রজারা অসন্তোষ প্রকাশ করে। ফলে বিভিন্ন স্থানে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই আন্দোলনে মালোরাও অংশ নেয় এবং এক সময় জমিদারদের কাছে পরাজিত হয়। ফলে জমিদারদের অধীনে তাদের বন্দি জীবন কাটাতে হতো। এছাড়াও জমিদাররা মালোদের দিয়ে ঘোড়া, মহিষ ও গবাদি পশুর ঘাস কাটার কাজ করাতো। সে কারণে মালোদের ঘাসী বলেও ডাকা হতো। এদের অনেকেই বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারদের লাঠিয়াল ও বরকন্দাজ হিসেবেও কাজ করতো। স্থানীয়রা এদের চিনে নেয় বুনা বা বুনো হিসেবে। আবার অনেকেরই ধারণা, বিহারের মালভূমি ও মালই টিলার অধিবাসীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল আছে বলেই এদের মালো নামে ডাকা হয়।

এ আদিবাসীরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে মালো ছাড়াও অঞ্চলভেদে নায়েক, রাজ, সরকার ব্যবহার করেন। এদের এক-একটি গ্রাম পরিচালিত হয় তিন সদস্যের পরিষদের মাধ্যমে। গ্রামপরিষদের পদগুলো নির্বাচন করা হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সকলের মতামতের ভিত্তিতে। মাঝিহারাম বা গ্রাম প্রধানের পদ ছাড়াও রয়েছে পারমানিক ও গুরদিক নামের দুটি পদ। গ্রামের সবার কাছে নানা খবরাখবর পৌঁছানোর কাজটি করেন পারমানিক। আর মাঝি হারামের বিচারের রায় পাঠ করে শোনাতে হয় গুরদিককে। মালো আদিবাসীদের গোত্র বিভক্তি তাদের বংশ পরিচয়কেই তুলে ধরে। এদের ১৩টি গোত্র রয়েছে। গোত্রগুলোর নাম-পরনদীয়া, নায়েক, খাসোয়ার, খাটোয়ার সিং, দুয়ারসিনী, হেটঘেটিয়া, কার্টাহা, ভুঞা, রাজ, অহীর,মন্ডলগোত্র, সিমের লেকোয়া প্রভৃতি। এদের সমাজে একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। মালো সমাজে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত। এদের পরিবারে মেয়েরা বাবার কোনো সম্পত্তি পায় না। তবে কোন পরিবারে বাবা মারা গেলে মা ও বোনদের দেখার দায়িত্ব অবশ্যই বড় ভাইকে পালন করতে হয়।

মালোদের প্রধান খাবার ভাত। দৈনন্দিন জীবনে এরা ভাত, মাছ, শুকরের মাংস, মুরগি, শুঁটকি খেয়ে থাকে। যেকোন উৎসব ও অনুষ্ঠানে এদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও বিভিন্ন ধরনের মাছ উল্লেখযোগ্য। অভাবের সময় এরা জঙ্গল থেকে পিসকা ও বাবগু আলু সংগ্রহ করে জীবন চালায়। অন্য আদিবাসীদের মতো মালোদেরও প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। যে কোন উৎসব ও পূজা-পার্বনে এরা হাড়িয়া ব্যবহার করে।

এদের ঘরগুলো সাধারণত মাটি আর ছনে ছাওয়া হয়ে থাকে। ঘর তৈরিতে এরা বাঁশের বেড়া ও খড়ের ছাউনি ব্যবহার করে। প্রচন্ড গরমে এদের ঘরগুলো বেশ শীতল থাকে। এরা ঘরের দেওয়ালে লাল মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরণের আলপনা এঁকে রাখতে পছন্দ করে। বাড়িগুলো পরিচ্ছন্ন এবং বাড়ির উঠানের মাঝে তুলসি ছাড়াও ফুলের গাছ লাগানো থাকে। এক সময় মালোদের নিজস্ব আদিবাসী পোশাক ছিল। সময়ের হাওয়ায় তা বদলে গেছে। সস্তা হওয়ায় বর্তমানে শাড়িই মালো নারীদের প্রধান পোশাক। মালো পুরুষরা পোশাক হিসেবে সাধারণত লুঙ্গি এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে ধুতি ও ফতুয়া পড়ে। নারীদের পছন্দের অলংকারের মধ্যে রুপার বড় বড় ঝুমকা, মালা, নোলক, বাজু, বিছা, খাড়– প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

মাছ ধরা এবং মাছ বিক্রয় করা মালোদের জাতিগত পেশা। তবে বর্তমানে মালোরা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে জীবনযাপন করছেন। মালো নারীরা ধান রোপন, ধান কাটা, নিড়ানো, আগাছা তোলা ইত্যাদি কাজ করেন। এরা কৃষি যন্ত্রপাতি হিসেবে হাসুয়া, কাস্তে, কোদাল, দা,বটি প্রভৃতি এবং মাছ ধরার যন্ত্রপাতি হিসেবে জাল, ডিয়াল, কুন্নি ব্যবহার করে থাকে। তবে এখন জীবিকার প্রয়োজনে এরা নানা পেশায় নিজেদের যুক্ত করছেন। খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত অনেক মালোই এনজিও-তে চাকরিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খ্রিস্টীয় বাণী প্রচারের কাজ করছেন।

এ আদিবাসীরা নিজেদের ভাষাটিকে বলে মালো ভাষা বা ঘাসী ভাষা কিংবা বুনেরা ভাষা। এরা মূলত কথা বলে সাদরী ভাষায়। তবে এখন বাংলাভাষাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। চিঁড়াকে মালো ভাষায় বলে-চিউরা, আমকে-আমবা, বোনজামাইকে-বোহনে, হলুদকে-হেরদি, চিরুনিকে- ককোই, কোলাকুলিকে-বিটবিট বলে। যৌতুক না দেওয়াই ভাল- বাক্যটিকে মালো ভাষায় বলে-ডিমেন না নেয়াই ভালো। কনেকে সিঁদুর পড়াবে দুলা- বাক্যটিকে বলে-কনিকাকে সিঁন্দুর পরাবে দুলা বাবু। আমরা এই ভাষাটা সবসময় বলি না বাক্যটিকে মালোরা বলে-হামনি এ ভাষাটা সব সময় কিহে না। কোথায় যাচ্ছ? বাক্যটিকে মালো ভাষায় বলে-কাহা যা বি?। কী করছ? বাক্যটিকে বলে-কী করনিম? মালোরা শিক্ষার দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। মালো আদিবাসী শিশুরাও তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত। ফলে বর্তমানে এ জাতির শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে বাংলা ভাষায়। তবে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বর্তমানে এদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত মালো আদিবাসী ছেলে-মেয়ে আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। জয়পুরহাট জেলার মালোরা শিক্ষার দিক থেকে এগিয়েছে। সেখানকার মালোদের মধ্যে এমএ পাশ কয়েকজন ছাড়াও ডাক্তার, প্রভাষক ও চাকুরিজীবি রয়েছেন।

মালো সমাজে নবজাতক জন্মানোর ৭দিন পর নুয়া অনুষ্ঠান করা হয়। নুয়া অর্থ নাপিত। ওইদিন ডাকা হয় সামজের সবাইকে। নাপিত এসে কেটে দেয় সবার চুল-দাড়ি। নুয়া হওয়ার পরই পুরুষেরা নবজাতকের ঘরে প্রবেশ করতে পারেন। এছাড়াও মালোরা বাচ্চা জন্মানোর ৫ অথবা ১২ দিন পর বরোহি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওইদিন কাটা হয় বাচ্চার চুল। এরপর সব কাপড়-চোপড় ধুয়েও শুদ্ধ করা হয়। মাটির জিনিস থাকলে ভেঙ্গে ফেলা হয় তাও। মালোদের বিশ্বাস এতে অশুচি দূর হয়ে যায়। বোরহির দিনই এরা নবজাতকের নাম রাখে এবং ওইদিন সবাই তার মুখ দর্শন করেন।

মালো বিয়ের পাকা কথা হয় কনের বাড়িতে। এ সময় কনে পক্ষকে ভাল ভাল খাবারের সঙ্গে খেতে দিতে হয় প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। হাড়িয়া ছাড়া মালোদের সম্মান রক্ষা হয় না। একসময় এদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামর্থ অনুযায়ী ছেলেকে যৌতুক দিতে হয়। কিন্তু যৌতুক প্রথাকে মালোরা তেমন ভাল চোখে দেখেন না। মালোদের বিয়ের পর্ব পাঁচটি সাজনা সাজা, লগন, কৈইলনী, মারোয়া ও বিহা।

সাজনা সাজো পর্বে বরপক্ষ কনেকে সাজানোর জন্য হলুদের শাড়িসহ চিউরা (চিঁড়া), গুড়, তেল, হেরদি (হলুদ), আয়না, ককোই (চিরুনি), দুইটা মাটির পুথুল, চুরি, কানফুলি, নাককুটি, মালা, ফিতা, পানসুপারি, জবা ও গাদা ফুল, কুশ (এক প্রকার জঙ্গলি ফুল), গংগিকা নুপূর (শামুকের নুপুর), পুতুলের খেটিলা (খাট) পাঠায়। এরা কনের জন্য সাদা রঙের কাপড় হলুদে ডুবিয়ে তৈরি করে বিশেষ ধরণের শাড়ি। মালো ভাষায় এটি-হরদি লেংগন লুগা।

লগন পর্বে কনের মা-বাবাকে প্রথমে প্রার্থনা করতে হয় আদিরীতি মেনে। অতঃপর কনেকে ঘরের ভেতর রেখে গায়ে হলুদ দেন তার চাচা-চাচি, মামা-মামি ও নিকট আত্মীয়রা। সবাই মিলে বাড়ির উঠানে তখন আঁকে নানা রঙের আলপনা। অতঃপর কনেকে এনে উঠোনে বসানো হয় পূর্বমুখো করে। নিয়ম মেনে কনের একপাশে বসে বরের ভাই, অন্যপাশে কনের ভাই। সবার উপস্থিতিতে এরা একজন অন্যজনের বুকে পানপাতা ছোঁয়ায় এবং একে অন্যকে বিয়াই বলে সম্বোধন ও বিটবিট (কোলাকুলি) করে। চারপাশে তখন মাদল-ঢোলের বাদ্য বাজে। কনে তখন দাঁড়িয়ে সবাইকে প্রণাম করে।

মালো বিয়েতে গায়ে হলুদের তিন দিন পর হয় কৈইলনী পর্বটি। এ সময় দিনে ও রাতে উপোস থাকতে হয় কনেকে। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই দুধ আর রুটি। কৈইলনীর দিন খুব ভোরে উঠে জিগা গজ, বাঁশপাতা, ধান, সুপারি, ১ টাকা, অরপন, সিঁন্দুর, ছোট ছোট সাদা কাপড়, সুতা, সঙ্গে নিয়ে কনেকে উঠোনে গিয়ে বসতে হয় মায়ের কোলে। ওই অবস্থাতেই কনে মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। সঙ্গে আনা জিনিসগুলো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে তবেই ভাঙতে হয় উপোস।

ছবি: সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সারাবাংলা ডটনেটে, প্রকাশকাল: নভেম্বর ২৫, ২০১৯

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button