কলাম

বুয়েট শিক্ষার্থীদের ‘অভিযোগ বাক্স’

এক বাবার আর্তনাদের ছবি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। হ্যাঁ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিহত ছাত্র আবরার ফাহাদের বাবার কথাই বলছি। ঠিক তাকানো যায় না ওই ছবির দিকে। বুকের ভেতরে তীব্র কষ্টের মেঘ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে তার চোখ বেয়ে। আর্তনাদ করে গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘বাবারা, তোমরা আমার ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেললা। না জানি কত কষ্ট হইছে তার।’

একজন বাবার এমন উক্তি আর কান্না আমাদের বুকের ভেতরটাকে খামচে ধরে। আমরা জ্ঞানশূন্য আর স্থির হয়ে যাই। আবরারের সারা শরীরে পেটানো রক্তজমা ছোপ ছোপ দাগগুলো আমাদের পশুত্ব আর অসভ্যতার দিকে ইঙ্গিত করে। চোখের সামনে তুলে ধরে মস্ত বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কেন আবরারের মতো একজন মেধাবী মতপ্রকাশ করতে গিয়ে নির্মমতার স্বীকার হবে? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে কেন একজন পিতা বাড়ি ফিরবেন তার সন্তানের লাশ নিয়ে? আবরারের বাবার চোখে লুকিয়ে থাকা এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর কি মিলবে? কে দেবে সেই উত্তর-বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রলীগ, রাষ্ট্র নাকি সরকার?

যখন লিখছি তখন নিহত আবরার ফাহাদের জন্য শোক র‌্যালি করেছে ছাত্রলীগ। অথচ গত রবিবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগেরই বুয়েট শাখার কতিপয় নেতাকর্মী নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন তাকে। তাতেই তারা ক্ষান্ত হননি। ওই হত্যাকে জায়েজ করার কৌশল হিসেবে তাকে শিবির বানানোরও চেষ্টা করেন তারা। এত কিছুর পরও আবরারের জন্য ছাত্রলীগের শোক র‌্যালির মতো উদ্যোগ বুয়েটের শিক্ষার্থীসহ অনেকের কাছেই নিছক তামাশা বলে মনে হয়েছে। এই নির্মম হত্যাকান্ড মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে।

দেশব্যাপী আলোচনা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের মুখে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তারা গণমাধ্যমে আবরার ফাহাদ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছে। আবরারের কক্ষে মিলেছে মুক্তিযুদ্ধের বই। যেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও ক্রাচের কর্নেল বই দুটি। তার শিবির সংশ্লিষ্টতা এখনো খুঁজে পায়নি গণমাধ্যম। আর শিবির করলেই তাকে হত্যার কোনোরূপ আইনগত বৈধতা নেই কারও। তাহলে শোক র‌্যালি আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্রলীগ কি পরোক্ষভাবে এটিই স্পষ্ট করছে যে আবরার শিবিরকর্মী ছিলেন না। বরং ছিলেন একজন সচেতন ও মেধাবী ছাত্র।

আবরার হত্যাকান্ডে জড়িত বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবরারকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মূলত শিবিরের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরিতে সাহায্য করেছেন। আর সে সুযোগটি নেওয়ার চেষ্টায় মাঠে নেমেছে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরও। আবরার ইস্যুতে তারাও মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। একইভাবে বুয়েটের ছাত্র হত্যাকে ইস্যু করে সরকারের ব্যর্থতাকে তুলে ধরতে সারা দেশে কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপিও। ফলে আবরার হত্যা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

নিহত আবরারের অপরাধ কী ছিল? বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস। যেখানে যৌক্তিকভাবে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। যে প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তরগুলো ছাত্রলীগ আবরারসহ সবার সামনে তুলে ধরে সরকারের পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারত। কিন্তু তা না করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসের কারণে আবরারকে নির্মমভাবে হত্যা করে মূলত হত্যাকারীরা ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি তার স্ট্যাটাসের বিষয়টিকে লাখো মানুষের মাঝে সঞ্চারিত করেছে। হত্যা বা কোনো অপকর্ম করার পরে নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করলেই ছাত্রলীগ ঘটনার দায় থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায় না। প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কে কীভাবে অপকর্ম, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তা জানার দায়িত্বও কেন্দ্রীয় নেতাদের রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন দফায় ক্ষমতায় আছে। নেতারাই বলছেন ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে দলে কিছু আগাছা ঢুকেছে। ঘটনা ঘটার পরে এমন উক্তি না করে, কোন আগাছা, কার মাধ্যমে দলের ভেতর এসেছে, সেই তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেননা আগাছা কখনো মূল গাছটিকে বাড়তে দেবে না।

সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন ঘটনা ঘটার আগেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত জিরো টলারেন্সের মানসিকতা নিয়ে আবরার হত্যাকারীদের অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। এতে অন্তত সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতি আস্থাশীল হবেন।

আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসছে বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের নানা ঘটনা। এতে প্রশ্ন উঠছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েও। ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ খোলা একটি ওয়েবপেজে বুয়েটে নির্যাতন ও র‌্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা ১৬৬টি অভিযোগ তুলে ধরেছেন। যার বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসন কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। বুয়েটের হলগুলোতে নিয়মিতই নির্যাতনের ঘটনা ঘটার বিষয়টি স্পষ্ট হয় কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৈরি করা ওই ওয়েবপেজ থেকে। যাতে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের চিত্র নানাভাবে তুলে ধরেছেন। ওয়েবপেজের ১১৪ নম্বর অভিযোগে এক শিক্ষার্থী বলছেন, ‘শের-ই-বাংলা হলের ৩১২ নম্বর রুমের ১৮ ব্যাচের আমরা চারজন ওয়েট করতেছিলাম, কখন আমাদের কমন রুমে ডাকা হবে। সাধারণত রাত সাড়ে ১১ থেকে ১২টার মধ্যে র‌্যাগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু প্রায় সাড়ে ১২টা বেজে গেলেও আমাদের ডাকা হচ্ছিল না বলে ধরেই নিয়েছিলাম যে ওই দিন র‌্যাগ দেওয়া হবে না। এর কিছুক্ষণ পরেই ফোন এলো, “ভাইরা কমনরুমে ডাকছে…।” চুলে পানি দিয়ে চারজন মিলে গেলাম কমনরুমে। সেখানে সবাইকে মোটামুটি নির্যাতন-গালাগালি করা হলো। এরপর ১১ জনকে সিলেক্ট করা হলো ছাদে ওঠানোর জন্য। সেই ১১ জনের মধ্যে আমি এবং আমারই রুমমেট ছিল। স্টাম্প দিয়ে পেটানো, চড় মারা, লাথি মারাসহ বিভিন্নভাবে টানা ৫ ঘণ্টা নির্যাতন চলে আমাদের ওপর। র‌্যাগ খেতে খেতে ফজরের আজান দিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না, নিঃশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হচ্ছিল, চোখ দিয়ে অবাধে পানি পড়ছিল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার রুমমেটের চোখেও পানি। চারপাশে আজান দিচ্ছিল, আর তার মধ্যেই জানোয়ারগুলো আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল। মন চাচ্ছিল ওই মুহূর্তে টিসি নিয়ে বুয়েট থেকে চলে যাই। সেদিন যেই কুকুরগুলো জানোয়ারের মতো আচরণ করেছিল, তাদের সবাই এখন জেলে, কয়েক জনের রিমান্ডও হয়েছে দেখলাম। এদের সবারই ক্যারিয়ার শেষ, ফাঁসিও হতে পারে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে… আল্লাহ তাহলে আমার আর্তনাদ শুনেছিলেন। কষ্ট একটাই, হারালাম আবরার ফাহাদ ভাইয়ের মতো মেধাবীকে।’

দিনের পর দিন বুয়েটে আক্রান্ত এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর নির্যাতনের ঘটনাগুলো পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অথচ বুয়েট প্রশাসন জেনেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থী মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন সব অত্যাচার। তাদের বুকের ভেতর জমে আছে চাপা ক্ষোভও। র‌্যাগিংয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০০৯ সালে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে র‌্যাগিং বন্ধে কঠোর নির্দেশনা জারি করে। এ ছাড়া তারা একটি টোল ফ্রি হেল্পলাইনও চালু করেছে, যেখানে কল করে র‌্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারে। তাদের মতো হেল্পলাইন কার্যক্রমটি আমাদের দেশেও দ্রুত চালু করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নির্যাতন ও র‌্যাগিং বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোকে সুস্পষ্ট ও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর লাশ আমরা দেখতে চাই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ হোক। সব শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হোক নিরাপদ।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১২ অক্টোবর ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button