মুক্তিযুদ্ধ

রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

২৫ মার্চ ১৯৭১। গণহত্যা শুরু হয় ঢাকায়। সে খবর আমরা পাই লোকমুখে। বুঝে যাই–দেশটা এমনি স্বাধীন হবে না। যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা আনতে হবে। জামালপুরে তখনও আর্মি আসেনি। কিন্তু আমরা উদগ্রীব। ট্রেনিং করেই যুদ্ধে নামব। তাই এক রাতে কাউকে কিছু না বলেই ঘর ছাড়ি। কামালপুর বর্ডার পাড় হয়ে চলে যাই ভারতে।

প্রথমে নাম লেখাই মাহেন্দ্রগঞ্জ ইয়ুথ ক্যাম্পে। আমাদের তখন পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পে। আটাশ দিন ট্রেনিং করায় ইন্ডিয়ান আর্মিরা। সামরিক ট্রেনিং, খুব সহজ ছিল না। ট্রেনিং শেষে কয়েকটা কোম্পানিতে ভাগ করা হয়। আলফা কোম্পানির কমান্ডের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠানো হয় পুরাখাসিয়ায়। এগারো নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর ছিল ওটা। তখন দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের আলম ভাই।

আমরা গেরিলা অপারেশন করতাম। হিট অ্যান্ড রান–ছিল মূলমন্ত্র। ম্যাকসিমাম অস্ত্র ছিল এলএমজি, এসএলআর আর গ্রেনেড। তারিখটা ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। একটা ফাইটে রওনা হই ইসলামপুরে। ৬৫জন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডে আমি। পাকবাহিনীর একটা ক্যাম্প আক্রমণ করেই ওদের আর্মসগুলো নিয়ে আসব। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।

নৌকায় রওনা হই সন্ধ্যার দিকে। রাত কেটে যায় নদীতেই। ভোরে ইসলামপুর এসে আত্মগোপন করে থাকি। বিকেলের দিকে যাই অ্যাটাকে। ওদের ক্যাম্প ছিল একটু উঁচুতে। ঢালু রাস্তায় কিছুটা নিচে আমরা অ্যামবুশ করি। সবুজ ফায়ার হলেই বুঝতে হবে উইথড্রো। তখন সবাই কোথায় একত্রিত হবে? সেটাও বলা ছিল।

প্রথম আমিই ফায়ার ওপেন করি। শুরু হয় গোলাগুলি। খুব কাছে গিয়ে এক পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে ফেলি দিই। একটু দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগোতে যাব, অমনি একটা গুলি এসে লাগে আমার বাম পায়ের থাইয়ে। প্রথম কিছুই বুঝতে পারিনি। বাড়ি লাগছে–মনে হলো। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্তে ভেজা। থাইয়ে আঙুল দিতেই গা কাটা দিয়ে ওঠে। বুঝে যাই মাংস ছিড়ে গর্তের মতো হয়ে গেছে। পিনপিন করে রক্ত বেরুচ্ছিলো তা দিয়ে। তখনও তুমুল গুলি চলছে। ওদের অস্ত্রের মুখে আমরা টিকতে পারি না। এভাবে চললে সবাই মারা পরব। তাই তখনই উইড্রোর সিগন্যাল দিই।

ভিডিও: পা দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছিল- বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান

আমার পায়ের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। দাঁড়াতে পারছিলাম না। ফাস্টএইড নিয়ে এগিয়ে আসে সহযোদ্ধা মুজিবর আর জহিরুল মুন্সি। ওরা আমায় নৌকায় তুলে নেয়। ভোরে নৌকা ভেড়ে বর্ডারে। চোখ মেলতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল তাহের। সেক্টর কমান্ডার হয়েও আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে উনি চলে এসেছিলেন। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন।

বড় একটি পিড়ির মধ্যে শুইয়ে দুইদিকে দড়ি বেঁধে সহযোদ্ধারা আমায় নিয়ে যায় মাহেন্দ্রগঞ্জে। পা দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছিল। চিকিৎসার জন্য যেতে হবে তুরাতে। রাতে একটা ট্রাকে আমাকে তুলে দেওয়া হয়। ট্রাক চলছে। ঝাকুনিতে পায়ের ব্যথ্যাও বাড়ছে। যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল জীবন চলে যাবে। কী যে কষ্ট পেয়েছি! এখনও মনে হলে চোখ ভিজে যায়। তুরা মিলিটারি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলে মাসখানেক। হাসপাতালে বসেই ভাবতাম– দেশটা ঠিকই একদিন স্বাধীন হবে। আমাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। তাই-ই হয়েছে। আমরা পেয়েছি ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর লাল-সবুজের পতাকা। এটা যে কত বড় পাওয়া বুঝাতে পারব না ভাই।

পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি গুলি তাঁর বাম পায়ের থাইয়ে বিদ্ধ হয়

মুক্তিযুদ্ধে রক্তাক্ত হওয়ার ইতিহাস এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসে আলাপ চলে একাত্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

ফজলুল হক ও লতিফুন হকের ছোট সন্তান হাবিবুর রহমান। বাড়ি জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার মেষেরচর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মেষেরচর প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন বকশিগঞ্জ এন এম (নুর মোহাম্মদ) হাই স্কুলে। ১৯৬৫ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে। অতঃপর চলে যান ঢাকায়, বিএসসিতে ভর্তি হন কায়েদে আজম কলেজে। ওই সময়ই যুক্ত হন রাজনীতিতে। কলেজ ছাত্রসংসদে ছাত্রলীগের এলাহি-ইব্রাহিম কেবিনেট থেকে তিনি ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুক্ত ছিলেন তখনকার সকল ছাত্র আন্দোলনেও। এরপর চলে আসেন মিরপুর বাংলা কলেজে। সেখানে ছাত্রসংসদের জিএস হন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিএসসি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।

বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করেন হাবিবুর রহমান। ঠিক এভাবে– ‘ব্রহ্মপুত্রে পানি বাড়লেই রাতের বেলায় কোচা নিয়ে আমরা বের হতাম। হাতে থাকতো একটা মশাল। বড় বড় মাছ আলো দেখলেই থমকে দাঁড়াত। সে সুযোগটাই নিতাম। গ্রামে নাটক হতো তখন। টিপু সুলতানের পার্ট করেছি একবার। এখন তো ওইরকম অনুষ্ঠান হয় না। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই বলেই ছেলেমেয়েরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল যুগ। পাশে বসে ছেলেমেয়েরা এখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে না, মেসেজ আদান প্রদান করে। এভাবে কি ভাববিনিময় হয়! এটা তো খুব ভাল লক্ষণ না। প্রযুক্তি কাজে লাগান কিন্তু অকাজে কেন?’
‘মানুষ তখন এতো স্বার্থপর ছিল না। শিক্ষা ব্যবস্থাটা ছিল ভাল। স্কুলেই সব পড়া শেষ করতে হতো। বকশিগঞ্জ এন এম হাইস্কুলে বিনয় বাবু স্যারের কথা মনে পড়ে। বাংলা পড়াতেন জয়কান্ত বাবু। ছাত্রদের কীভাবে ভাল হবে সেই চিন্তাটা শিক্ষকদের মধ্যে তখন ছিল। এখন তো টিচাররা অধিকাংশই কমার্শিয়াল। ভাল শিক্ষক না হলে তো ভাল ছাত্রও তৈরি হবে না। এ কারণেই আমাদের নৈতিক উন্নতিটা তেমন হচ্ছে না। শেখার জন্য না, সবাই এখন লেখাপড়া করে পাশ করার জন্য। এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে এই যোদ্ধা বলেন–‘অর্থনৈতিক বৈষম্য তো ছিলই। এখানের আয় দিয়ে উন্নত হতো পশ্চিম পাকিস্তান। তখন বিহারী আর পাকিস্তানিদের গুরুত্ব সব জায়গায় ছিল বেশি। আর্মিতে অধিকাংশই ছিল ওদের লোক। ওই সময় আর্মিতে কমিশনড র‌্যাংকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আইসিএসবি থেকে আউট হয়ে যাই। কেন? কোন কারণ নেই। ছুটে যাই বাঙালি অফিসার খলিলুর রহমান স্যারের (পরবর্তীতে জেনারেল হন) কাছে। উনি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর আশপাশ দেখে বললেন–‘হইছো তো বাঙাল। চাকরি হইব কেমনে?’

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি হাবিবুর রহমানের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। রেসকোর্স ময়দানে তিনি খুব কাছ থেকে শোনেন ভাষণটি। ভাষণের প্রতিটি কথাই উদ্দীপ্ত করে তাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেই ধরে নেন স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। এর জন্য যা কিছু করার করতে হবে তাদেরই। তাই তিনি গ্রামে ফিরে যান। ওখান থেকেই চলে যান ট্রেনিংয়ে।

এগার নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর পুরাখাসিয়ার আওতায় কামালপুর থেকে ডালু পর্যন্ত এলাকায় একাধিক অপারেশন করেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। আহত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তিনি আবার রনাঙ্গণে ফেরেন। সাব সেক্টর কমান্ডারের টুয়াইসি হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করেন।

তুরাতে চিকিৎসা শেষে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলেন যুদ্ধাহত হাবিবুর রহমান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালবাসায় আবেগ আপ্লুত হন তিনি। কী ঘটেছিল সেখানে। শুনি তার জবানিতে– আমি তখন ক্রেচে ভর দিয়ে হাঁটি। কলকাতায় গিয়েছি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর বাসায়। একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এসেছে–এমন খবর পেয়ে আশাপাশের মানুষ দেখতে আসে আমায়। মায়ের বয়সী এক বৃদ্ধা সামনে হাঁটু গেড়ে ভক্তি দেয়। আমি তো অবাক! ‘খালা’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরি। বলি– ‘কি করেন এটা? আমার তো পাপ হবে।’ শুনে উনি মুচকি হেঁসে বলেন–‘ভগবান কোথায় থাকে বাবা। ভগবান তো তোমরাই। তোমরাই তো মানুষের জন্য যুদ্ধ করতেছো।’ কথাগুলো মনে হলে এখনও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।

কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে সহযোগিতার আবেদনের পর ডিফেন্স সেক্রেটারী নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পত্র

ওই বৃদ্ধার বাড়ি ছিল পাশেই। উনি তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। যেখানে বসতে দেন তার পাশেই পূজোর ঘর। পূজো ঘরের দেওয়াল টাঙ্গানো ছিল বঙ্গবন্ধুর বড় একটি ছবি। দেখে অবাক লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য অকাট্য ভালবাসা ছিল ভারতীয় বাঙালিদেরও।’

বেড়াতে এসে খরচের টাকা শেষ হয়ে যায় হাবিবুরের। কয়েকজনের পরামর্শে তখন কলকাতায় অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে আহত হিসেবে সহযোগিতার আবেদন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী আবেদনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেন। সে প্রেক্ষিতে তৎকালীন ডিফেন্স সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও জারি করা হয়। কিন্তু সহযোগিতা নেওয়ার আগেই এই সূর্যসন্তান ফিরে যান ক্যাম্পে।

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান যোগ দেন রক্ষীবাহিনীতে। তিন মাস ট্রেনিং শেষে লেফটেনেন্ট হিসেবে ফিরতেই বড় দায়িত্ব পান। গ্রেটার ফরিদপুরে রক্ষীবাহিনীর ইনচার্জ ছিলেন। সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও ওই সময় রক্ষীবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এই বীর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তাঁর ভাষায়– ‘স্বাধীনের পর অনেক আর্মস ছিল লুকানো। বিশেষ করে ফরিদপুরে সিরাজ সিকদার, অরুনা সেন, শান্তি সেন গ্রুপের কাছে আর্মস ছিল বেশি। ওদের কোন আদর্শ আমরা খুঁজে পাইনি। লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। এমন গ্রুপ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করতাম আমরা। এখন যেমন র‌্যাব করছে। ওই সময়ও এমনটা প্রয়োজন ছিল। তা না হলে দেশে অরাজকতা তৈরি হতো। আইন-শৃঙ্খলা ঠিক থাকতো না। তখন হয়তো সেনাবাহিনী নামাতে হতো। তাই রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।’

ভিডিও: রক্ষীবাহিনী না হলে দেশে অরাজকতা তৈরি হতো- বলছেন মুক্তিযোদ্ধা ও রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার মো. হাবিবুর রহমান

আপনাদের কাজ কি ছিল?

‘আর্মস রিকভারি করাই ছিল রক্ষীবাহিনীর প্রধান কাজ। আমরা এলএমজিসহ অনেক আর্মস উদ্ধার করেছি। আক্রমণের মুখেও পড়েছিলাম। যশোর ও কুষ্টিয়ার রিক্রুট শেষে ফিরতি পথে ফেরিতে সিরাজ সিকদার গ্রুপ আক্রমণ করে। একটা গুলি মাথায় স্পর্শ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। ঘাড়ে একটা কোপের দাগ এখনও আছে।’

রক্ষীবাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে, অত্যাচারও চালিয়েছে–এমন কথা প্রচলিত আছে? এটা কতটা সত্য?

তিনি বলেন– ‘এটা একেবারেই মিথ্যে আর অপপ্রচার। রক্ষীবাহিনীতে ছিলেন ম্যাকসিমাম মুক্তিযোদ্ধারাই। তারা কেন মুক্তিযোদ্ধাদের মারবে? যারা আর্মস লুকিয়ে রেখেছিল তারাই এমন বিভ্রান্তি রটাতো। তবে কিছু কিছু জায়গায় কোনো ভাল মানুষও ফেঁসে গিয়েছিল। এমন ছোটখাট ভুল হয়েছে। কিন্তু রক্ষীবাহিনী নিয়ে যে তথ্যগুলো এখন প্রচার করা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন।’

একটি ভুলের উদাহরণ টেনে রক্ষীবাহিনীর এই কমান্ডার বলেন– ‘লেফটেনেন্ট হয়েও আমরা বড় দায়িত্ব পেয়েছিলাম। ফলে ভুল ক্রুটি হয়েছে। একবার আমার কাছে একটা চিঠি আসে। লেখা– ‘ওমুকের বাড়ির ওই ঘরে গর্ত খুড়লেই আর্মস পাবেন। সে খুব খারাপ মানুষ।’ কে লিখেছে? দেশপ্রেমিক নাগরিক।
চিঠি পেয়েই আমি ফোর্স পাঠালাম। দেখা গেল কিছুই নাই। যে লোকটার কথা চিঠিতে লেখা হয়েছে সে ওই এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত লোক। ওই লোককে আমরা কিছু বলিনি। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ায় চারদিকে তখনই রক্ষীবাহিনীর দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে এ ধরণের কিছু ভুল হয়েছে আমাদের। শেখ কামালকে মুখে মুখে যারা ব্যাংক ডাকাত বানিয়েছিল তারাই নিজেদের স্বার্থে রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার চালায়।’

সেনাবাহিনীর অফিসাররা রক্ষীবাহিনীকে কীভাবে দেখতো, কোন দ্বন্দ ছিল কি?

‘দ্বন্দ ছিল না। তবে সেনাবাহিনীর অফিসারদের ধারণা ছিল সরকার আমাদের বেশি ফেভার করছে। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু তা ছিল না। আমার ব্যাটালিয়ানে তখন সরকারিভাবে রক্ষীবাহিনীর সৈন্যপ্রতি (ফ্রেশ) বরাদ্ধ ছিল দৈনিক চুরানব্বই পয়সা। আর সেনাবাহিনীর এগার ব্যাটালিয়ানের সৈন্যপ্রতি (ফ্রেশ) বরাদ্ধ ছিল দৈনিক এক টাকা চুয়াল্লিশ পয়সা। তাহলে ফেভার কোথায় দিল!’

পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সেনারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিন্দু পরিমাণ কৃতজ্ঞতা দেখায়নি বলে মনে করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ বঙ্গবন্ধুর উদারতার কারণেই ফিরতে পেরেছিল তারা। সে ইতিহাস জানাতে একটি অজানা ঘটনার কথা তুলে ধরেন হাবিবুর রহমান। তাঁর ভাষায়– ‘আমি তখন রক্ষীবাহিনীতে, বঙ্গভবনে ডিউটি করি। একদিন সেখানে আসেন জিয়াউর রহমান ও জেনারেল শফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু তখন পাইপ টানছেন। তাদের দেখে বললেন– তোরা? তারা বলেন কেবিনেট সেক্রেটারির কাছে একটা চিঠি দিয়েছি। আপনার সাইন লাগবে স্যার। বঙ্গবন্ধু বলেন– ‘আমার সাইন লাগবে। এদিকে আয়।’ বঙ্গবন্ধু বসেই জানতে চান কী বিষয়? তারা খসড়া দেখিয়ে বুঝিয়ে বলেন–‘আর্মি রুলে বাঙালি সেনা যারা পাকিস্তানে সারেন্ডার করেছে তাদের আর চাকরি থাকে না। সেই অর্ডার এটি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন– ‘চাকুরি থাকে না মানে।’ তারা বলেন– ‘অ্যাজ পার রুল তারা তো সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন–‘তাহলে তারা কি করবে? চাকুরি গেলে তাদের বউ বাচ্চা কী খাবে? বঙ্গবন্ধু চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ান। বলেন– ‘না না এই সাইন আমি করব না।’ তারা বলেন– ‘স্যার অন্য জায়গায় অ্যাডজাস্ট করব।’ তিনি বলেন– ‘যে চাকরি আছে সেটাই তো তোরা রাখতে পারস না। দিবি কখন? হাজার হাজার মানুষকে চাকরি দিতে পারলে সেটা নিয়ে আয়।’

ওই সাইন বঙ্গবন্ধু দিলেন না। আর এ কারণেই যারা রিপেট্রিয়েট হয়ে পাকিস্তান থেকে ফিরলো তারাও সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুযোগ পেল। এই ইতিহাস কয়জনে জানে বলেন। বঙ্গভবনে এটা আমার সামনে ঘটেছে। দেখেন, বঙ্গবন্ধু কী রকম মানুষ ছিলেন। পাকিস্তানে আত্মসমর্পন করেছে কিন্তু ওরাও তো বাঙালি। দেশের মানুষ। ওদের বউ-বাচ্চা কী খাবে। চাকরি না থাকলে পরিবারসহ পথে বসতে হবে– এইসব ভেবেই বঙ্গবন্ধুর চোখ ভিজে গিয়েছিল। তার প্রতিদানে কি দিয়েছে ওরা?

ভিডিও: বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর না করাতেই পাকিস্তানে আটক সেনারা চাকরি করতে পেরেছিল- বলছেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রক্ষীবাহিনীকে বাতিল করে সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে এমআই ক্লিয়ারেন্সের নামে আটকে যায় এই যোদ্ধার প্রমোশন। ফলে মেজর হিসেবেই তিনি অবসর নেন।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান অকপটে বলেন–‘রক্ষীবাহিনী থেকে এসেছি। কিছু বৈষম্য তো ছিলই। জিয়াকে ভীষণভাবে ঘৃণা করতাম। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও উনি রাজাকারদের পূর্ণবাসিত করেছেন। তার আমলেই এমআই ক্লিয়ারেন্সের নামে প্রমোশন আটকে যায়। একটু আপোস করলেই প্রমোশন পেতাম, করিনি। বিএনপির আমলে আর্মস ফোর্সেস ডের দাওয়াতে গিয়েছিলাম একবার। রাজাকার মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ কাছে এসে হ্যান্ডসেক করতে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি হাত বাড়াইনি। সবার সামনেই বলেছিলাম, সরি, ফ্রিডম ফাইটার হয়ে রাজাকারের সাথে হাত মিলাতে পারব না।’

মুক্তিযুদ্ধে রক্তাক্ত হয়েও এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা সরকারি স্বীকৃতি এখনও পাননি। কেন? মলিন মুখে তিনি বলেন– ‘আবেদন করেছি অনেক আগে। বছর খানেক ধরেই শুনছি যাচাই বাছাই হবে। এটুকুই জানি। আমি দেশের জন্য ব্লাড দিয়েছি। সরকার ভাতা দিবে, কি দিবে না এটা বড় কথা নয়। স্বীকৃতিটা তো দিবে।’

যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

‘আগে পাইনি। তবে এখন আশাবাদি। স্বাধীন দেশে সব মানুষ মিলেমিশে একত্রে থাকবে– এটাই ছিল স্বপ্ন। মানুষ তো এখন বদলে গেছে। সবাই ছুটছে নিজের চিন্তায়। দুর্নীতি তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে নেতারা খুব সৎ ছিল। তারা মানুষের জন্য পলিটিক্স করতো। এখন কোটি টাকা খরচ করে ক্ষমতায় এসেই তারা তা উঠায়। রাজনীতিতে বিজনেসম্যানরা বেশি এলে তা রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছে। এটা করতে পারলে সত্যি দেশ বদলে যাবে। তবে দলের অসৎ লোকদের বিরুদ্ধেও কঠোর হতে হবে।’

প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে সরকারের বিশেষ কর্মসূচী নেওয়া উচিত বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। তার যুক্তি– ‘জিয়াউর রহমান, এরশাদ আর খালেদা জিয়ার আমলে মনে হয়েছে দেশটা এমনি এমনি এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা তখন প্রজন্মের কাছে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম তখন উচ্চারণও করা হতো না। এভাবে কয়েক প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল শিক্ষা পেয়েছে। তাই এখন একাত্তরের সত্যিকারের বীরত্বের ইতিহাস তাদের জানাতে হবে। তাহলেই প্রজন্ম সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান আশায় বুক বাঁধেন প্রজন্মের কথা ভেবে। একদিন তাদের হাত ধরেই দেশটা উন্নত হবে। স্বাধীনতাও তখন অর্থবহ হবে। তাই প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাটি–‘তোমরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করো। সত্যিকারভাবে দেশটাকে এগিয়ে নিও। দেশের মানুষকে ভালবেসো। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান ।
ট্রেনিং: আটাশ দিন ট্রেনিং করেন ভারতের আসামে, তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পে।
যুদ্ধ করেছেন: এগার নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর পুরাখাসিয়ার আওতায় কামালপুর থেকে ডালু পর্যন্ত এলাকায় একাধিক অপারেশন করেন। এছাড়া জামালপুর এলাকায় গেরিলা অপারেশনও করেছেন।
যুদ্ধাহত: ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে ইসলামপুরে এক অপারেশনে তিনি বাম পায়ের থাইয়ে গুলিবিদ্ধ হন।

ছবি ভিডিও: সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩ আগস্ট ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button