কলাম

ডেঙ্গুর দায় এড়াতে পারে না সিটি করপোরেশন

ঢাকা মহানগরের প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে মে মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৮৪ জন, জুন মাসে ১ হাজার ৭৭০ জন এবং জুলাই মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৬১ জনে। সরকার বলছে, ডেঙ্গুতে মারা গেছে পাঁচজন। কিন্তু গণমাধ্যমে খবর এসেছে ২২ জনের মৃত্যুর। যার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃতের সঠিক হিসাবটি জানতে চায় নগরবাসী। সরকারের উচিত এ বিষয়ে সঠিক তথ্য নাগরিকদের কাছে তুলে ধরে আস্থার জায়গাটি তৈরি করার চেষ্টা করা। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ে চলছে নানা টালবাহানা।

২০০০ সালে প্রথম ঢাকায় বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ৫ হাজার ৫৫১ জন। মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। পরের বছরগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমতে থাকলেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রতি বছরই। ফলে ডেঙ্গু রোগে নাগরিকদের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়েছে বছর বছরই। এই নগরে ডেঙ্গুকে মেনে নিয়েই কি আমাদের বাঁচতে হবে? এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মুখেই!

এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকেই আক্রান্ত হন আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ফলে জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের দুদিন আগেই তাকে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। বাজেটের দিনে হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদে গেলেও কিছুক্ষণ পর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অগত্যা প্রধানমন্ত্রী তার হয়ে বাজেট উপস্থাপন করেন, যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। পরদিন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনেও ছিলেন না অর্থমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সেটাও সামলেছিলেন। পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনে অফিস করেছিলেন মুস্তফা কামাল। নতুন মন্ত্রণালয় পাওয়ার পরও সেখানেই বসতেন তিনি। এখন কোথায় অফিস করবেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সরাসরি বলেন, ‘অফিস এখন দুই জায়গায় করব। কিন্তু ওখানে (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়) বেশি মশা। এ পর্যন্ত দুবার কামড় দিয়েছে, একবার চিকুনগুনিয়া ও আবার ডেঙ্গু। এটা কোনো কথা হলো…! আমি ওই জন্য ভয়ে ওখানে যাচ্ছি না।’ শুধু অর্থমন্ত্রীই নন। যার পরিবারে ডেঙ্গু রোগী ছিল বা আছে তিনি জানেন এ রোগের যন্ত্রণা। যার সন্তান এ রোগে মারা গেছে, সে বোঝে এর কষ্ট কতটুকু!

অর্থমন্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্তের দায় কাউকে না দিলেও ‘এটা কোনো কথা হলো…!’ এমন উক্তি করে মনের ভেতর পুষে রাখা ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রকাশ করেছেন। তার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের বিষয়ে মেয়রদ্বয়ের কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে আসেনি। এর দায় কি তারা নেবেন, নাকি অর্থমন্ত্রীর অফিস বা পরিবারের মশক নিধনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করবেন?

চিকিৎসকরা বলছেন, চলতি বছরে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গিয়ে এই হার কতটা বাড়বে, তা নিয়েও আতঙ্কিত তারা। আতঙ্কিত নাগরিকরাও। কিন্তু সরকার বা সিটি করপোরেশন কি আগে থেকে জানত এ বছরের ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে? জানলে তারা সেটা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। ঢাকা শহরের ৯৩ ওয়ার্ডে আমরা জরিপ চালিয়েছিলাম গত জানুয়ারিতে। তখনই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছিলাম। এই লার্ভা থেকেই কিন্তু এডিস মশা জন্মাবে। আর সেটা উল্লেখযোগ্যই ছিল।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালকের কথাই যদি সত্য হয়, তবে সিটি করপোরেশনের মেয়ররা এ বিষয়ে কেন আগে থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিলেন না? সরকারি দপ্তরগুলো এ বিষয়ে কেন উদাসীন ছিল? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।

সিটি করপোরেশনের মশক নিধনের ওষুধের মাত্রা ও কার্যকারিতা নিয়ে যে খবরগুলো গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তা আমাদের আতঙ্কের মাত্রা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নাগরিক হিসেবে যেমন হতাশ হয়েছি, তেমনি অসহায়ও বোধ করছি। দুই বছর ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, সিটি করপোরেশনের ছিটানো ওষুধে মশা মরছে না। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা গত বছর মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেন। তারা দেখেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশার যে ওষুধ ছিটানো হয়, তা অকার্যকর। তাতে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা মরে না। এ বিষয়ে গবেষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাও। কিন্তু সব জেনেও ওষুধ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়নি সিটি করপোরেশন। বরং ১০ বছর ধরে তারা একই মাত্রাতেই মশার ওই ওষুধ ব্যবহার করে আসছে। অতিসম্প্রতি মশা মারার ওষুধ ও এর মাত্রা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মশা মারার নামে ফগার মেশিনে বা স্প্রে দিয়ে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটিয়ে আসছিল, তা কি নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা ছিল না? তাদের এই উদাসীনতায় কয়েক বছরে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা কষ্ট ভোগ ও মৃত্যুবরণ করেছেন, তার দায় কি সিটি করপোরেশন এড়াতে পারবে?

প্রায় প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, তখনই মেয়ররা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু তার আগে মশক নিধনের বিষয়ে আমরা তেমন জোরালো কর্মসূচি দেখতে পাইনি। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় নগর কর্র্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ‘সর্বশক্তি’ দিয়ে সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র। এ জন্য ৬৭টি মেডিকেল টিমও গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় ৪৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যকর্মীরা অবস্থান নিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন বলে জানান তিনি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনে ডিএসসিসি একটি হটলাইনও (০৯৬১১০০০৯৯৯) চালু করেছে। যেখান থেকে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় পরামর্শও প্রদান করা হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের জন্য এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।

পাশাপাশি আমরা চাই মেয়ররা প্রকাশ্যে পরবর্তী বছরে মশক নিধনের পদক্ষেপগুলোও নাগরিকদের সামনে প্রতিশ্রুতি আকারে তুলে ধরুক। বর্তমান সরকার নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন সেবার কলসেন্টার বা হটলাইন চালু করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে নগরের কোথায় মশার ওষুধ ছিটানো প্রয়োজন নাগরিকরা যেন সারা বছর তা জানাতে পারে এবং সিটি করপোরেশনও যেন দ্রুত সেখানে মশক নিধনের মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারে, সে কারণে সিটি করপোরেশনের উচিত জরুরি ভিত্তিতে কলসেন্টার চালু করা। এ বিষয়ে দুই মেয়র উদ্যোগী হবেন- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২২ জুলাই ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button