কলাম

আপনার ছেলে শিশুটি কি নিরাপদে আছে?

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত উদিসা ইসলামের একটি চমৎকার রিপোর্ট পড়ে এই লেখায় উদ্বুদ্ধ হলাম। ‘মেয়ে ও ছেলে শিশু ধর্ষণের বিচার একই আইনে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে– চলতি (২০১৯) বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১০টি ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় এসেছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার ছেলে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৩। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অনূর্ধ্ব ১৬ বছর বয়সী শিশুরা। বাস্তবে এ সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। কেননা লোকলজ্জা আর সামজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ে অনেক ছেলে শিশু ও তার পরিবারের কষ্টের চাপা কান্নার খবরগুলো ওঠে আসেনি পত্রিকার পাতায়।

ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হলে আগে ৩৭৭ ধারায় মামলা হতো। কিন্তু বর্তমানে ছেলে বা মেয়ে শিশু হোক, ধর্ষণের মামলা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’ অনুযায়ীই হয়। যা হয়তো অনেকেরই অজানা।

কিন্তু কাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় ছেলে শিশুরা? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বাস্তব একটি ঘটনা তুলে ধরছি।

বছর খানেক আগের ঘটনা। ঢাকা মহানগরেই বাস করে আমার এক বাল্যবন্ধু। সফল ব্যবসায়ী সে। সারাদিন কাটে ব্যস্ততায়। তাই একমাত্র ছেলেটিকে তেমন সময় দিতে পারে না। কিন্তু ছেলের লেখাপড়ার বিষয়ে এতটুকু ঘাটতি রাখতে রাজি নয় সে।

ছেলে ছয় বছর পেরোতোই ব্যবস্থা হয় আরবি শিক্ষার। স্থানীয় স্কুলের এক আরবি শিক্ষককে রাখা হয় এ কাজের জন্য। প্রতিদিন দুপুরে দু’ঘণ্টার জন্য পড়াতে আসেন তিনি। নিরিবিলি একটি কক্ষে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। মাস খানেক পরেই বেঁকে বসেন বন্ধুর ছেলে শিশুটি। বাবা-মাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সে, এ হুজুর ভালো নয়, আমি তার কাছে পড়ব না। এমন অভিব্যক্তি ছিল ছেলে শিশুটির।

শিশু বলে বাবা-মা তার কথায় গুরুত্ব দেয় না। বরং শিশুটির ওপরই রাগ করে তারা। আরবি না পড়ার অজুহাতেই হুজুর সম্পর্কে খারাপ ধারণা দিচ্ছে সে। এমনটা ভাবে তার বাব-মা।
এভাবে ওই শিশুটিকে অবিশ্বাস করে তারা। শুধু তাই নয়, আরবি পড়াকে গুরুত্ব দিয়ে পাড়ানোর সময়টাতে তারা কক্ষের দরজাটিও বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করে। এভাবেই বন্ধুর ছেলে শিশুটির আরবি পড়া চলতে থাকে বছর খানিক।

এদিকে ওই শিশুটি ক্রমেই শারীরিকভাবে রোগাপাতলা হতে থাকে। খাওয়া-দাওয়াও কমে যেতে থাকে তার। ডাক্তার দেখিয়েও কোনও ফল হয় না। শিশুটিও তার মনের কথা খুলে বলে না বাবা-মায়ের কাছে। শারীরিক অবস্থা দেখে ক্রমেই চিন্তিত হয়ে পড়ে বন্ধুটি। কিন্তু এক দুপুরে উন্মোচিত হয় সবকিছু। সবাই জেনে যায় প্রকৃত ঘটনা।

শিশুটিকে ধর্ষণের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে ওই শিক্ষক। খানিক উত্তম-মধ্যমের পরেই তিনি স্বীকার করেন যে, শিশুটির ওপর তার এই পাশবিকতা চলেছে গত এক বছর। নীরবে মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করেছে শিশুটি। কারও কাছে মুখ না খুলতে নানাভাবে শিশুটিকে ভয় দেখাতো ওই শিক্ষক। এভাবে শিশুটির এক-একটি দুপুর ছিল এক-একটি অভিশাপ। ফলে শারীরিকভাবে সে অসুস্থ হতে থাকে।

পরে বিষয়টি গণমাধ্যমেও উঠে আসে। তবে সামাজিকতার ভয়ে বন্ধুটি ওই শিক্ষককে পুলিশে ধরিয়ে দিতে বা মামলা করতে এতটুকু পিছ পা হয়নি। কিন্তু ওই ছেলে শিশুটি মানসিক ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় একবছর।

বন্ধুর চোখ দুটো বারবার ভিজে যাচ্ছিল তারই শিশুটিকে অবিশ্বাস বা তার কথাকে গুরুত্ব না দেওয়ার অপরাধের জন্য। তার মুখে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল, ‘অভিভাবক হিসেবে নিজের শিশু সন্তানের অস্বস্তিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই আমার শিশুটি এই পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। তাই এই দায় আমাদেরও।’ বন্ধুর এই আত্মোপলব্ধি আজও আমাকে নাড়া দেয়।

ওপরের ঘটনাটিতে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে শুধু মেয়ে শিশুরাই ধর্ষণের স্বীকার হয় না বরং অগণিত ছেলে শিশুরাও এর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। ছেলে শিশুদের ধর্ষণের বিষয়টিকে আমরা প্রায় বিবেচনার মধ্যেই রাখি না। স্কুলে বা পরিবারে মেয়ে শিশুটির করণীয় বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেওয়া হলেও ছেলে শিশুটি কীভাবে ধর্ষণকারীর হাতে থেকে রক্ষা পেতে পারে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা পায় না। ফলে নিরাপদ থাকছে না আমাদের ছেলে শিশুরাও।

২০৪১ সালে হবে উন্নত বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নময় পথে এগুচ্ছে সরকার। কিন্তু উন্নত বাংলাদেশ মানে আসলে কী? খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে শুধু উন্নয়ন করা! নাকি ন্যায় বিচার, মানুষের অধিকার ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা?

সারা পৃথিবীতে শিশু অধিকারের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করা হয়। তাই শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিষয়গুলোকে উন্নত দেশে স্পর্শকাতর বিবেচনা করে জিরো টলারেন্স হিসেবে মানা হয়। কিন্তু আমরা কি এগুচ্ছি সেই পথে?

শিশু ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা অতি দ্রুত নিশ্চিত করে তা কার্যকরের কোনও দৃষ্টান্ত আমরা খুব কমই দেখি। বরং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আইনের নানা ফাঁকফোঁকর দিয়ে নিশ্চিত জীবনে ফিরে এসেছে অনেক ধর্ষক।

ফলে বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির কারণে সমাজে ক্রমাগত বাড়ছে শিশু ধর্ষণজনিত অপরাধ। এমনটা তো আমরা প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই রাষ্ট্র শিশু ধর্ষণের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাক। শিশু ধর্ষণের কঠিন শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত হোক।

শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনেকেই নানা কর্মসূচি নিয়ে পথে নেমেছেন। কেউ কেউ দাবি তুলেছেন অতি দ্রুত এই অপরাধের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার। যেন সহজে কেউ এই অপরাধের কথা চিন্তাও করতে না পারে। এটা যেমন প্রয়োজন তারচেয়ে অনেক বেশি দরকার পারিবারিক, সামজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতার। কেননা শুধু আইন দিয়েই এই অপরাধীদের থেকে আমরা আমাদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবো না।

ছেলে বা মেয়ে শিশু ধর্ষক আসলে কারা? আপনার আমার সম্পর্কের মুখোশ পরা কোনও পরিচিতজন। কখনও সে ভাই, কখনও কাকা, কখনও নানা-দাদা কিংবা ওঁৎ পেতে থাকা কোনও হায়নারূপী মানুষ। যার কাছে আমাদের শিশুটি খুব সহজভাবেই যেতে আগ্রহী। আপনার ও আমার সম্পর্কের মাঝেই ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনও ধর্ষক। ঘটনা ঘটার আগে যাদের আমরা সহজে চিহ্নিত করতে পারি না। যখন তার পশুরূপটি উন্মোচিত হয় তার আগেই আমাদের শিশুটি ক্ষতবিক্ষত হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে।

এইসব গুপ্ত ও বিকৃত মানসিকতার মানুষের থাবা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে পরিবারের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে সচেতনতা। আপনার ছেলে বা মেয়ে শিশুটিকে বিশ্বাস করুন, তার কথাকে গুরুত্ব দিন, তার আত্মরক্ষার কৌশলটি তাকে শেখান। ছেলে শিশু বলে ধর্ষিত হবে না—এই ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি শিশুটির পরিবার যেন হয় তার সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। এই বোধটি শিশুর মনে গেঁথে দিতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবাইকেই। শুধু মেয়ে শিশুটিই নয়, এদেশে ছেলে শিশুটিও নিরাপদ থাকুক।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ৭ জুলাই ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button