কলাম

কে কাকে ঠকাচ্ছে?

গত রমজানের ঘটনা। ইফতারে খাওয়ার জন্য শেওড়াপাড়া বাজার থেকে কিনে আনি একটি তরমুজ। দামও কম ছিল না। ভেতরটা মিষ্টি ও লাল হবে—এই গ্যারান্টি দিয়েই দোকানি তরমুজ বিক্রি করছিলেন। অনেকের মতো আগ্রহী হয়ে আমিও কিনলাম একটি। ইফতারে তরমুজের একাংশ সবাই মিলে খাওয়া হলো। সত্যিই খুব মিষ্টি আর লাল ছিল। ভালো একটা তরমুজ কিনতে পারার তৃপ্তিতে আনন্দিত হলাম।

কিন্তু একটি ঘটনা আমার মন থেকে সব আনন্দকে সরিয়ে গভীর চিন্তার মেঘ জমিয়ে দেয়। কেন? তরমুজ খেতে গিয়ে অসাবধানতাবশত একটি টুকরো পড়ে যায় সোফার ওপরে। ঘণ্টাখানেক পরে সেটি আবিষ্কার করেই চিন্তিত হয়ে পড়ি। কেননা, সোফার কাপড় থেকে কোনোভাবেই তরমুজের লাল রঙটিকে তোলা যাচ্ছিল না। পরে সাবানে ধুয়েও লাল রঙটিকে পুরোপুরি তুলতে পারিনি। কারখানায় ব্যবহৃত শক্তিশালী লাল রঙই কোনোভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তরমুজের ভেতর। যা আমরা পরিবার মিলে দিব্যি খেয়ে হজম করেছি। ভাবছিলাম কাপড়ের রঙটিই সাবানে তোলা যাচ্ছিল না, তাহলে ওই রঙ আমাদের দেহের ভেতরটায় কতটা ক্ষতি করেছে! এরপর থেকেই তরমুজ খাওয়ার প্রতি এক ধরনের অনীহা চলে আসে। কিন্তু এই নগরে ভেজাল ও ক্যামিকেলমুক্ত কী খাবো আমরা?

সবাই দাবি করি, আমরা উন্নত দেশের পথে হাঁটছি। কিন্তু পৃথিবীর এমন একটি উন্নত দেশও আপনি পাবেন না, যেখানে নাগরিকদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য, সঠিক চিকিৎসা আর শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্র আপস করেছে। এই তিনটি বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক চাপও থাকে না ওইসব দেশে। বরং তারা কঠোরভাবে নাগরিকদের তা নিশ্চিত করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে তার ঠিক উল্টোটা।

এও দাবি করা হয় বাংলাদেশ মুসলিম দেশ। রমজান তাই এখানে সংযমের মাস। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের ক্ষেত্রে কতটা সংযমী হচ্ছেন? বরং তাদের কাছে রমজান হচ্ছে অধিক মুনাফা লাভের মাস। মাহে রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর  ও সমৃদ্ধিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো রমজান। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই সময়টাতেই মানুষকে ভালো খাওয়ানো, লাভ কম করে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সওয়াব কামানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে রমজান এলেই পণ্যের দাম হু ‍হু করে বেড়ে যায়। আবার একশ্রেণি অধিক লাভের নেশায় যেন মেতে ওঠে। তারা খাদ্যের শুধু অধিক মূল্যই নেয় না, বরং আরও লাভের আশায় ভেজাল মেশায়। তাহলে তারা আসলে ইসলামের কোন সংযম পালন করছেন?

প্রতি রমজানেই সরকার ঘটা করে মোবাইল কোর্ট নামায় জনসাধারণের খাবারের মান ঠিক রাখার চেষ্টায়। এরপর একে একে গণমাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ভেজালের যে খবরগুলো আসতে থাকে তা আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। ছোট, মাঝারি, বড়—কোনও জায়গায়ই খাদ্যের মান সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তার অর্থ হচ্ছে আপনি রমজানে অল্প বা বেশি টাকা খরচ করেও এই নগরে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাবেন না। অনেকেরই প্রশ্ন, শুধু রমজান কেন, নাগরিকদের খাদ্যমান নিশ্চিত করতে সরকার কেন সারা বছরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে না? মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় থাকবে না কোনও রাজনৈতিক চাপ—সেটিও সরকারের নিশ্চিত করা উচিত।

ক্ষতিকর হওয়ায় সম্প্রতি ৫২টি পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত, যা পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হয়নি এখনও। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এসব ক্ষতিকর পণ্য এতদিন পর্যন্ত কীভাবে বাজারে ছিল। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাহলে কী কাজ করেছে? এতদিন এই ক্ষতিকর পণ্যগুলো খেয়ে নাগরিকদের যে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তার দায় তাহলে কে নেবে? আদালত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য কিন্তু আমরা পাইনি। যদি পণ্যগুলো ক্ষতিকর হয় তবে রাষ্ট্রের উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

একজন আরেকজনকে ধারালো অস্ত্র বা গুলি করে হত্যা করলো। সেটি যেমন হত্যা তেমনি একজন ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা লাভের আশায় খাবারে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করে তিলে তিলে মানুষের শারীরিক ক্ষতি করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। সেটাও কিন্তু এক ধরনের হত্যা। আবার এই হত্যাকারীর টার্গেট গ্রুপ নেই। তারা ভেজাল খাদ্যের মাধ্যমে সব বয়সীকেই অসুস্থ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। ফলে তার অপরাধ হত্যাকারীর চেয়েও অনেক বেশি। তাই খাদ্যে ভেজাল যারা দেয় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা উন্নত বাংলাদেশকে অনুভব করতে পারবো। এ বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও বিশেষ প্রয়োজন।

নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণি যদি এসব ভেজাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকেন তবে ভেজাল দেওয়ার সাহস তাদের কমে আসবে। যারা খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারা কি ভেবে দেখেছেন আসলে তারা কাকে ঠকাচ্ছেন?

মাছে ভেজাল, মাংসে ভেজাল, ফলে ভেজাল, দুধেও ভেজাল, শাকসবজিতে ভেজাল। এসব খেয়ে আপনি যখন অসুস্থ হবেন তখন ওষুধ কিনতে গিয়েও কিনে আনবেন নকল ওষুধ। তা খেয়েই মৃত্যুর ঝুঁকি যাবে বেড়ে। মাছওয়ালা মাংস খায়, মাংসওয়ালা কেনে ফল আর মাছ, ফলওয়ালা দুধ কেনে, ওষুধওয়ালাও কেনে মাছ, মাংস আর দুধ। তাহলে কে কাকে ঠকাচ্ছে? কে কার ক্ষতি করছে?

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: ৪ জুন ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button