ভ্রমণকথা

শালবনে পাতার মিছিলে

বসন্তে পাতা ঝরে। কোকিল ডাকে। আমের মুকুলের গন্ধে মন মাতে। চোখ রাঙে শিমুলের লাল ফুলে। মন হারিয়ে যায় অন্য কোনোখানে। হারিয়ে যাওয়ার আকুতি যখন আকাশছোঁয়া তখনই আমন্ত্রণ পাই দিনাজপুর যাওয়ার। ঐতিহাসিক স্থান তো আছেই, শালবন আছে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। পাতা ঝরার এই সময়ে শালবন নাকি অন্যরকম।

বিরলের প্রাকৃতিক শালবনটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বন্ধুবর বাবুর বাড়ি বিরলে। মুঠোফোনে তার শালবনের বর্ণনায় মজে যাই আমরা। আরেক বন্ধু মুনড়বাও আগ্রহ দেখায়। তাই শহরের কোলাহলকে বিদায় জানিয়ে দুই বন্ধু রওনা হই দিনাজপুরের উদ্দেশে। দিনাজপুর শহরটি বেশ পরিপাটি। বন্ধুপত্মীর জন্য মিষ্টি কিনতে গিয়ে খানিকটা ঘুরে দেখি।

শহর থেকে বিরল সদরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। অচেনা জায়গায় রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। আমরা একটি রিকশায় চেপে বসি। ভাড়া মাত্র ৭০ টাকা। দিনাজপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনর্ভবা নদী। ব্রিজ দিয়ে পুনর্ভবা পেরিয়ে চলতে থাকি দক্ষিণমুখে, বিরলের রাস্তায়। দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলের মাঠ। ধান লাগাতে ব্যস্ত সবাই। এক কৃষক ক্লান্তি কাটাতে আঞ্চলিক ভাষায় গাইছিল ‘তুই যদি মোর হলু হয় বন্ধু, মুই হনু হয় তোর।’ রাস্তার লাগোয়া আমগাছগুলোতে জেঁকে ধরেছে মুকুল। তা থেকে মনের আনন্দে মধু নিচ্ছে মৌমাছিরা। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। মন কেমন করে ওঠে। গান ধরে মুন্না ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ।’

চারপাশের দৃশ্যতে মন রাঙিয়ে একসময় পৌঁছে যাই বিরলে। বন্ধু পরিবারের আতিথেয়তায় ক্লান্তি দূর হয়। দুপুরে খাওয়ার পর গরুর খাঁটি দুধের এক কাপ চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠি। উপজেলা সদর থেকে শালবন মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। বাবুর জিপে চড়ে বেরিয়ে পড়ি। খানিক সামনে যেতেই গাড়ির গতি কমে। তাকিয়ে দেখি, রাস্তার পাশে দুটি পাকা কবর। শহরমুখী বাসগুলো কবরের সামনে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। যাত্রীরা কবরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে পয়সা। ড্রাইভার জানালেন, এটি মুল্লুক দেওয়ানের মাজার। এখানকার সবাই তাকে সত্যপীর বলেন। মাজার পেরিয়ে ছুটে চলি সীমান্তমুখী রাস্তা ধরে। পৌঁছে যাই কালিয়াগঞ্জ বাজারে। দেখে মনে হলো, হাট বসেছে। নানা জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে আদিবাসীরা। নিজেদের ভাষায় কথা বলছে তারা।

বাজার পেরিয়ে বাঁয়ের রাস্তা ধরে আমরা এগোই। কিছুটা গিয়েই দূরে শালবন দেখতে পাই। জলরঙে আঁকা কোনো ক্যানভাস যেন। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আমরা ঢুকে পড়ি বনের ভেতর। শুকনো পাতায় পা রাখতেই মড়মড় শব্দে শালবনের নীরবতা ভাঙে। গাছগুলোতে অনেক পাখির কলকাকলি। কোকিল, টিয়া, ঘুঘু, ময়না আরও কত কি! তাদের আনন্দ-আড্ডায় মুখরিত চারপাশ। বনের মধ্যে একটি গাছ দেখে আমরা থমকে দাঁড়াই। অজগর সাপ আকৃতির একটি গাছ জড়িয়ে রেখেছে বেশ কিছু শালগাছকে। স্থানীয়রা গাছটিকে বলে ‘বাদেনা’।

হঠাৎ চারপাশ থেকে অদ্ভুত ধরনের শব্দ পাই। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ধেয়ে আসছে। আমরা ভড়কে যাই। এটি আসলে বাতাসে শালপাতা নড়ার শব্দ। মুনড়বার ভাষায় পাতার মিছিল। প্রাকৃতিক নিয়মে শালবীজ পড়ে বন তৈরি হওয়ার কারণেই নাকি বনটিকে প্রাকৃতিক শালবন বলা হয়। বিট অফিসার শরিফুল তেমনটিই জানান। শালবনটি প্রায় ২৮৬৭ একর এলাকাজুড়ে। বনের মধ্যে শালগাছ ছাড়াও রয়েছে আমলকী, সর্পগন্ধা, বহেড়া, হরীতকী, চিরতাসহ নানা ধরনের ঔষধি গাছ। একটি ছোট্ট রেস্ট হাউসও রয়েছে এখানে। রেস্ট হাউস ছাড়িয়ে আমরা প্রবেশ করি পাশের শালবনে। এর নাম মিরা বন। বনের মধ্য দিয়ে খাল আকৃতির নদী চলে গেছে ভারতে। বনটিতে একসময় দেখা মিলত বাঘসহ হিংস্র সব জানোয়ারের। এখন মেলে শেয়াল, খরগোশ, বন মোরগ ইত্যাদির।

মিরাবনে ঢুকেই হারিয়ে যাই অন্যরকম দৃশ্যের মধ্যে। কোনো গাছেই যে পাতা নেই! জমিনে বিছিয়ে থাকা শালপাতা কুড়াচ্ছিল আদিবাসী নারীরা। ওঁরাও সম্প্রদায়ের মলানী টিগ্গার কাছে শুনতে পাই শালপাতার কথা। আদিবাসীরা এই পাতা দিয়ে তৈরি করে হাড়িয়া খাওয়ার চোঙ আর অতিপ্রিয় পাতার বিড়ি। মিরা বন থেকে আমরা চলে আসি ভটিয়া বনে। এই বনের একটি গাছকে পূজা করে আদিবাসীরা। গাছটির নাম খিল কদম। আমরা মনোযোগ দিয়ে গাছটি দেখতে থাকি। খানিক এগিয়ে কয়েকজন আদিবাসী শিকারির দেখা পাই। তাদের হাতে কয়েকটি মৃত খরগোশ ও ঘুঘু। তাদের পেছন পেছন আমরাও পা বাড়াই। ততক্ষণে সূর্য ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। আমরা আর বনে থাকি কেন? তবে শুনেছি রাতের বনও ভারি সুন্দর। অন্যবারের জন্য তা তোলা রইল।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৪ মার্চ ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

  1. আপনার ওয়েবসাইটের খোঁজ পেয়েছি আজকেই। ঘুরে ফিরে দেখছি। বেশ সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট। ভালো লেগেছে।
    দিনাজপুরে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। আপনার এই পোস্ট পড়ে সেখানকার শালবন সম্পর্কে জেনেছি। পরিকল্পনা করে যাবো একদিন – আশা করছি।
    একটি বিষয় – এই ওয়েবসাইটের ছবিগুলো লোড হচ্ছে না। এই পোস্টের ছবিও দেখতে পারলাম না। দেখতে পারলে ভালো লাগতো।
    ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সাইডের সমস্যাটি নিয়ে কাজ চলছে। হয়তো খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button